পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সামনে একাদশ সংসদের নির্বাচন। তাই সকলের কথাবার্তায়ই এখন ভোটের প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মেলনেও তিনি ভোটের প্রসঙ্গ তুলেছেন। সকলকে বলেছেন উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট দিতে। নৌকায় ভোট দেয়া মানে তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়া।
ইদানিং প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় একাদশ সংসদের নির্বাচনে তাঁর দলকে ভোট দেয়া বা না দেয়া নিয়ে তিনি একটু বেশী-বেশীই কথা বলছেন। তিনি বলেছেন জনগণ তাঁর দলকে সমর্থন দিয়েছে বলেই তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছেন। তারা যদি সমর্থন না দেয়, তা হলে তিনি ক্ষমতাসীন হবেন না। এ নিয়ে তাঁর কোন দু:খবোধ নেই। প্রধানমন্ত্রীর একথা শুনে মনে হতে পারে তিনি বুঝি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছেন।
কিন্তু অতীত ইতিহাস কী বলে? অতীত ইতিহাস যা সাক্ষ্য দেয়, তার সাথে কিন্তু এ ধারণার একটুও মিল নেই। নিয়মিত অবাধ নির্বাচনের সাথে গণতন্ত্রের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক। বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র জোরদার হতে পারছে না তার বড় একটা কারণই হচ্ছে এদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ একদা এদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও এখন যে কারণেই হোক, সে ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে।
একথা কেন বলছি, তা বুঝাতে অতীতের ইতিহাসের উপর একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। তার আগে একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। পাকিস্তান আমলে দেশ পরিচালনায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অতিরিক্ত প্রভাব থাকায় বাস্তবে গণতন্ত্র কখনও কার্যকর হতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গণতন্ত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দু:খের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল।
পরবর্তীকালে কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে এই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। এটা বাস্তবে সম্ভব হয় বোধ হয় এই বিবেচনায় যে, উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি।
সংবাদপত্র পাঠকমহলের স্মরণ থাকার কথা, এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের একটানা দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদবিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে বহুদিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকলেও পরে এক পর্যায়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। তবে ততদিনে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রী হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী নির্বাচনে।
এদিকে এক পর্যায়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হয়। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারেও একমত হয় যে, নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপ্রতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন আবার এর মধ্যে ‘কারচুপি’ আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে যখন দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয় নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বিএনপি, অবলীলাক্রমে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলে ফেললেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে! তবে সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এ স্ববিরোধী মন্তব্যকে গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হল। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা হলেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাই যে গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থাধীনে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পর পর পালাক্রমে দুই প্রধান দল বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলে। এরপর একপর্যায়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হয়। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে এটা দুই প্রধান দলের মধ্যকার অতীত সমঝোতার লংঘন অভিযোগ এনে সে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দান করে বিএনপি।
দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম নির্বাচন বয়কট করায় সে নির্বাচন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। জনগণও সে নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সাধারণত যেখানে আমাদের দেশের লোকেরা ভোটের দিন সকল কাজ ফেলে প্রথম ভোটের লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত, সেখানে ভোটের নির্ধারিত সময়েও অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র থাকে প্রায় ফাঁকা, জনশূণ্য।
বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরের কথা, সরকারী দলের অনেক নেতাকর্মীও ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ তেমন অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন তারা ভোট কেন্দ্র না গেলেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে। বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই শাসক দলীয় প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সীলমেরে শাসকদলের প্রার্থীদের অকল্পনীয় বিপুল ভোটে ‘বিজয়ী’ করে তোলার সুযোগ লাভ করে। এভাবে তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী ঘোষিত হন, যদিও ভোট দানের নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল প্রায় জনশূণ্য, যে কারণে জনগণ এ নির্বাচনের নাম দেয় ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ শাসন করছে, সে সরকার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল। আরও লক্ষ্যযোগ্য, দেশের একটি প্রধান দল (বিএনপি) কর্তৃক বর্জিত এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে অধিকাংশ (১৫৩) আসনের নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থী ছাড়া অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জনগণের সমর্থন ছাড়া এভাবে নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হওয়ায় আমাদের শাসকদলের নেতাদের কোন লজ্জাবোধও নেই। জাতীয় সংসদে ভাষণ দান করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের আবোল তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য যাদের দৃষ্টিতে আবোল তাবোল মনে হতে পারে, তারা যে আদৌ গণতন্ত্রের বিশ্বাস করেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আসলে কোন দেশে গণতন্ত্রকে বাস্তবে কার্যকর ও জোরদার করে তুলতে হলে সংশ্লিষ্ট সকল নেতা ও দলকে আন্তরিকভাবে গণতন্ত্রমনা ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকার চালাচ্ছে যে দলটি সেটির মধ্যে এই মনোভাবের নিতান্ত অভাব। যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকা এবং যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে রেখে দেশে ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত রাখা যাদের লক্ষ্য, তাদের দ্বারা আর যাই হোক গণতন্ত্রের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
বর্তমানে যে দলটি দেশে ক্ষমতাসীন রয়েছে তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, যে কোন মূল্যে প্রকৃত বিরোধী নেতা ও দলকে রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করা। অতীতে যে নেত্রী তিন তিন বার অবাধ নির্বাচনে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, সেই বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি বর্তমান সরকারের মনোভাব শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, অমানবিকও বটে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তাঁর একভাষণে দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পুনরায় নৌকায় ভোট দিতে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মারফৎ ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি তার শাসনামলে তিনি তাঁর শাসনের যে নমুনা দেখিয়েছেন, তাতে এ আশংকা করা অন্যায় হবে না যে, তিনি পুনরায় ক্ষমতা যাওয়ার সুযোগ পেলে দেশে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে দেশে তাঁর বিজাতীয় মুরুব্বীদের আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকাই অধিক। তবে দেশের জনগণের প্রকৃত মনোভাব যাই থাক তিনি যদি চান তিনি পুনরায় ক্ষমতায় যাবেন তাহলে তাঁর অতীত ইতিহাস থেকে বলতে পারি তাঁর প্রতি জনগণের প্রকৃত মনোভাব যাই হোক, তিনি দেশে গণতন্ত্রত ধ্বংস করে হলেও ক্ষমতায় ঠিকই চলে আসবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।