পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্ম প্রকাশ ঘটলো। এটি আরও আগেই ঘটা উচিত ছিল। বড় দেরি হয়ে গেছে। তবুও ঐ যে কথায় বলে, Better late than never. দেরি হলেও একটি ভালো দিক হলো, শেষ পর্যন্ত একটি বৃহত্তর ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করেছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একের পর এক নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ইতোপূর্বে আমি অন্যত্র একটি লেখায় মন্তব্য করেছিলাম যে, ‘মাহি বি চৌধুরীর কারণে বৃহত্তর ঐক্যে কামাল হোসেনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, বি চৌধুরীর কমছে।’ অন্যত্র আর একটি লেখায় বলেছিলাম, ‘বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বাঞ্চাল/ শীঘ্রই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করছে জাতীয় যুক্তফ্রন্ট।’ এছাড়াও ফেসবুকে আমার আইডিতে আমি দুইটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেগুলোতে আরও পরিষ্কার করে ঐ বিষয়টি বলেছি। প্রথম স্ট্যাটাসটি দেই ২৬ সেপ্টেম্বর। স্ট্যাটাসটির শিরোনাম ছিল, ‘জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের চক্রান্ত/ আওয়ামী লীগের প্রক্সি দিচ্ছেন বি চৌধুরী ও মাহি বি চৌধুরী।’ দ্বিতীয় স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলাম ৫ অক্টোবর। শিরোনাম ছিলো, ‘বৃহত্তর ঐক্য গঠনে বি চৌধুরী ও মাহি বি চৌধুরীর রহস্যময় ভূমিকা।’ অবশেষে সেই বি চৌধুরী এবং মাহি বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই বৃহত্তর ঐক্য গঠিত হলো। কথায় বলে, গরিবের কথা নাকি বাসি হলে ফলে। আমি, এই অধম বেচারা ১৬ দিন আগে সকলকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। বড় বড় নেতারা সেটি বুঝলেন, তবে ১৬ দিন পর। রাজনীতি যেমন আনন্দময়, তেমনি বড় নির্মম। নিরেট সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অবাঞ্ছিত বস্তুকে সার্জিক্যাল অপারেশন করে রিমুভ করতে হয়। সেটিই এবার করা হলো। বি চৌধুরী, বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান এবং যুগ্ম মহাসচিব বি চৌধুরীর পুত্র মাহি বি চৌধুরী সৃষ্ট অবাঞ্ছিত বস্তুটি সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে রিমুভ করা হলো।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটিও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ নিয়েছেন মাত্র দেড় দিন আগে শুক্রবার ১২ অক্টোবর রাতে। ঐ দিন জেএসডি প্রধান আ স ম আব্দুর রবের উত্তরার বাড়িতে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠক ছিল। বৈঠকে বিএনপির তরফ থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। দুই নেতা উপস্থিত ছিলেন না। এরা হলেন ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা ড. কামাল হোসেন এবং যুক্তফ্রন্ট নেতা বি চৌধুরী। ঐ সভাতে যদিও ৭ দফা এবং ১১ দফার খসড়া চূড়ান্ত হয় তবুও ঐ সভাতেই বিকল্পধারার বেরিয়ে যাওয়া বা বহিষ্কৃত হওয়ার ঘণ্টা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল স্পষ্ট শুনতে পান। ঐ সভাতেই সাব্যস্ত হয় যে, বিএনপিসহ বৃহত্তর ঐক্যফ্রন্টের নেতারা খুব শীঘ্রই তাদের দাবি এবং লক্ষ্য আদায়ের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য সবগুলো বিভাগীয় সদরে জনসভা করবেন। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব গ্রাউন্ড ওয়ার্ক কমপ্লিট করা দরকার। কারণ, বিএনপি এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার সব নেতাই অনুভব করছেন যে, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৬ মাস আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। এর মধ্যে বিগত দুই মাস সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনী প্রচারণায় মোটেই নামতে পারেনি। মামলা এবং হামলায় তারা পর্যুদস্ত। পাইকারি হারে গ্রেফতার এবং বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তারা পলাতক। এর মধ্যেও এখনো যেসব নেতা কর্মী বাইরে আছেন তারা হুলিয়া মাথায় নিয়েই রাজপথে নামতে চান। বিএনপি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে যে, রাজপথে নামার সময় যে ঐক্য প্রক্রিয়ার সমস্ত শরিককে নিয়েই মাঠে নামবে। ঐক্য প্রক্রিয়াও অনুভব করছিল যে, তার মাঠে নামার সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দাবি এবং আদর্শ চূড়ান্ত না হওয়ায় বৃহত্তর ঐক্যফ্রন্টের অবয়ব বা সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন যখন দাবি এবং লক্ষ্য স্থির হয়ে গেছে তখন তারা দেশবাসীর কাছে কর্মসূচি দিতে পারে। সেই কর্মসূচি নিয়েও শুক্রবারের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শনিবার বেলা ৩ টায় ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠক হবে এবং সেই বৈঠকে ৭ ও ১১ দফার খসড়াটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হবে। অতঃপর একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
সকলেই যখন তাড়াতাড়ি রাজপথে নামার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলেন তখনই ঘটে বিপত্তি। গত ১৩ অক্টোবর শনিবার ইংরেজি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, আলোচ্য বৈঠকে মাহি বি চৌধুরী বলেন যে তারা স্বাধীনতা বিরোধী কোনো শক্তির সাথে কোনো ঐক্য গড়বেন না। এর জবাবে তাৎক্ষণিক ভাবে মান্না বলেন যে, তারা স্বাধীনতা বিরোধী কোনো শক্তির সাথে ঐক্য করছেন না। তারা ঐক্য করছেন বিএনপির সাথে। ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্ট মোতাবেক, যদি জাতীয় যুক্তফ্রন্ট আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যায় তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য কি হবে সেই বিষয়টি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
দুই
গত ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপি, বিকল্প ধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য এবং গণফোরাম এক মঞ্চে মিলিত হয় এবং এক সাথে কাজ করার অঙ্গীকার করে। ফলে সাধারণ মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এর পরেই দেখা দেয় ভিন্ন মত বা ফাটল। তখনও জাতীয় যুক্তফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক রূপ পায়নি। তাই সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার আগে ড. বি চৌধুরীর পুত্র এবং বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তাদের সাথে বিকল্প ধারা কোনো ঐক্য করবে না। এর মাধ্যমে মাহি বি চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামী এবং পরোক্ষভাবে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করেন। কারণ ২০ দলীয় ঐক্য জোটে জামায়াত বিএনপির মেজর পার্টনার। তিনি আরও দাবি করেন যে, বৃহত্তর ঐক্যে জামায়াতকে তো আনা যাবেই না, উপরন্তু ২০ দল থেকেও জামায়াতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। মাহি বি চৌধুরী আরও দাবি করেন যে, পার্লামেন্টে ভারসাম্য সৃষ্টি করার জন্য ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০টি আসন বিএনপি পাবে এবং অবশিষ্ট ১৫০টি আসন যুক্তফ্রন্ট ও বৃহত্তর ঐক্য জোটের শরিকরা পাবে। রবিবার ১৪ অক্টোবর ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক, মাহি বি চৌধুরীর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন জেএসডির প্রধান আ স ম আব্দুর রব এবং নাগরিক ঐক্য প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না। তারা বলেন, এই রকম শর্ত চাপিয়ে দিয়ে ঐক্য করা সম্ভব নয়।
১২ অক্টোবর শুক্রবার জেএসডি প্রধান রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে মাহি বি চৌধুরী পুনরায় তার প্রস্তাব অর্থাৎ স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক ছেদ এবং আসন ভাগাভাগির প্রস্তাব তুললে, ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক, মাহমুদুর রহমান মান্না সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, এসব শর্ত অবাস্তব। রবের বাসায় মাহির সাথে রব এবং মান্নার মতদ্বৈধতা চাপা থাকেনি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ভাবতে থাকেন যে, যতই দিন যাবে ততই বিকল্পধারা বিশেষ করে মাহি বি চৌধুরী এবং তার প্রভাবে তার পিতা বি চৌধুরী নিত্য নতুন সমস্যা সৃষ্টি করবেন। কারণ মাহি বি চৌধুরী ইতোমধ্যেই কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক টিভি চ্যানেল ৭১-এ এই ব্যাপারে একাধিক বার কথা বলেছেন। তারা অন্তর থেকেই অনুভব করেন যে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো, যদিও বিকল্প ধারাকে বাদ দিলে জাতীয় যুক্তফ্রন্টের গোয়াল শূন্য হবে না।
তিন
এই পটভূমিতে শনিবার ১৩ অক্টোবর বিএনপি, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য এবং কামাল হোসেনের গণফোরাম সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিকল্প ধারাকে সাথে নিয়ে এগুনো আর সমীচীন হবে না। এই চিন্তা ধারার ফলে গত শনিবার ১৩ অক্টোবর ড. কামালের বাসায় যে বৈঠক নির্ধারিত ছিল সেটি বাতিল করা হয়। সেই চিন্তা ধারার কারণেই শনিবারই মির্জা ফখরুল, আ স ম রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের সাথে আরও দুই একজন নেতাকে নিয়ে মতিঝিলে ড. কামালের চেম্বারে তার সাথে দেখা করেন। মির্জা ফখরুল ড. কামালের চেম্বারে প্রবেশ করেন বেলা ৩টায়। বেরিয়ে আসেন ৩টা ৩০ মিনিটে। অতঃপর তিনি মতিঝিলেই অবস্থিত ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের চেম্বারে যান। সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বিকাল ৪টায়। সেখান থেকে বেরিয়ে পুনরায় তিনি ড. কামালের চেম্বারে প্রবেশ করেন।
চিত্রের অপর পিঠ। বেলা পৌনে ২টার দিকে ড. কামালের চেম্বারে প্রবেশ করেন আ স ম রব এবং ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ৩টার কিছুক্ষণ পর সেখানে যান মাহমুদুর রহমান মান্না। মির্জা ফখরুল এই ফাঁকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের চেম্বারেও প্রবেশ করেন। এভাবে বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ড. কামালের চেম্বারে বিভিন্ন নেতার আসা যাওয়া এবং বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় যে আজই অর্থাৎ শনিবারই বিকেলে প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্স করা হবে এবং বিকল্প ধারাকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সাংবাদিক সন্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এভাবেই শনিবার ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায় প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের অবসান এবং জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে জন্ম নেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাছে জনগণের প্রত্যাশা বিপুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন ছিল তেমনি হরণ করা বাক, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং পদদলিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করাও কম কঠিন নয়। এই কঠিন কাজটিই করতে হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে। সুতরাং তাদের দায়িত্বকে ইংরেজি ভাষায় Herculean task (হারকুলিয়ান টাস্ক) বলা হলে অতিশয়োক্তি হবে না। শুধু গণতন্ত্রকেই হরণ করা হয় নাই, ক্রসফায়ার, গুম, খুন, অপহরণ প্রভৃতি ভয়াবহ অপরাধ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বলা যেতে পারে সারাদেশে কায়েম হয়েছে এক ত্রাসের রাজত্ব। সেই ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটাতে হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে। এমনি শত শত কাজ রয়েছে তাদের সামনে। ১০ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করা চাট্টি খানি কথা নয়। তারপরেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সেগুলো করতেই হবে। এখন অবাধ, সুষ্ঠ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আদায় করার জন্য ১ সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক পথে ঐক্য ফ্রন্টকে রাজপথে নামতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।