পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কুমিল্লায় পূজামন্ডপে কুরআন অবমাননার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হওয়ার সংবাদও এসেছে। কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কুমিল্লার মন্দিরগুলো পরিদর্শনের সময় জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক অভিযোগ করে বলেছেন, ‘সব মন্দিরেই একই অভিযোগ যে পুলিশ আসেনি। সকাল থেকে যখন একের পর এক হামলা হচ্ছে, তখন তারা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু পুলিশ আসেনি। চাঁন্দমনি কালী মন্দিরে মই টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন দেয়া হয়। সেখানে চার ঘণ্টায়ও পুলিশ আসেনি’ (১৫ অক্টো. ২০২১, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস)। প্রশাসনের এমন গা-ছাড়া ভূমিকা অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। ঠিক এমন উত্তপ্ত সময়ে হঠাৎ করে উসকানিমূলক ভাষায় সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক ছুঁড়ে দিয়েছেন এক প্রতিমন্ত্রী। দেশে যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা ইস্যুতে নাগরিক ক্ষোভ ও হাতাশা চরমে উঠেছে, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি অহেতুক বিতর্ক তৈরির কী কারণ থাকতে পারে?
কুরআন অবমাননার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত লেগেছে; কিন্তু পাশাপাশি এটাও আমাদের বুঝা দরকার যে, দেশব্যাপী অকাম্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। কারণ, পূজামন্ডপে সকলের সামনে এভাবে মূর্তির পায়ের ওপর কুরআন রাখলে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যে বা যারা কুরআন অবমাননার কাজটা করেছে, তারা জেনেবুঝে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তা করেছে। কোনো সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দু বা মুসলিমের এ ধরনের কাজ করার কথা নয়। এটি কোনো একটি সংঘবদ্ধ অপশক্তির পরিকল্পিত কাজ, যারা এটার ফায়দা তুলবে, সন্দেহ নেই। সুতরাং, এ ঘটনাকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা দিয়ে বুঝতে চাওয়া ঠিক হবে না। বরং এর নেপথ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের মামলায় চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামিকে সম্প্রতি ইউপি চেয়ারম্যান পদে আ’লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে (১৩ অক্টো. ২০২১, ডেইলি স্টার)। তাই, কখনো মুসলমানদের আবার কখনো হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা নিছক সাম্প্রদায়িকতাপ্রসূত নয়, বরং কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক।
ঢাকা ট্রিবিউনের ১৪ অক্টোবরের এক রিপোর্টে জানা যায়, বান্দরবানের লামায় কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন লামা উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক, পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম, উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক মো. শাহীন ও ওলামা লীগের নেতারা। সেই প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে লামা উপজেলার কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে প্রতিবাদকারীদের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশত আহত হয়। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৪০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলে জানা গেছে। এ থেকে বুঝতে কষ্ট হয়না, দাঙ্গাবাজ আসলে কারা। যারা ধর্মপ্রাণ ও নিরীহ সাধারণ প্রতিবাদকারী তারা এসব সংঘবদ্ধ ভাঙচুর ও লুটপাটের সাথে জড়িত নয়।
সংবাদমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে মন্দিরে যেসব হামলা ও লুটপাটের খবর ইতোমধ্যে এসেছে, সেসব হামলায় অংশগ্রহণকারী শত শত তরুণ বয়সী মুসলমান যুবকদের কারা এত দ্রুত সংগঠিত করেছে তা তদন্তের দাবি রাখে। এ বছরের মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটে প্রায় কয়েক শতাধিক লোক সংঘবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল। প্রথমে ‘হেফাজতের সমর্থকদের’ দায়ী করা হলেও পরে পিবিআই-এর তদন্তের মাধ্যমে মূল হোতা গ্রেপ্তার হয়, যে কিনা সেখানকার ইউপি সদস্য এবং স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি! (২০ মার্চ ২০২১, ঢাকা ট্রিবিউন)।
বাংলাদশে এ ধরনের দৃশ্যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর ফায়দা তোলে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। বিশেষত আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের গল্প পুুঁজি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোর প্রয়াস চালায়। এ কারণে অনেকেই আগামী ত্রিপুরা নির্বাচনের সাথে কুমিল্লার কুরআন অবমাননার ঘটনার সম্পর্ক খুঁজছেন। ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্য সরকার বিজেপি নানা অপকর্ম ও অপশাসনের দরুন ব্যাপক সমালোচনায় জরাগ্রস্ত। এমনকি সম্প্রতি ত্রিপুরা রাজ্যের সুরমা আসনের বিজেপির বিধায়ক আশিস দাস দল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আশিস অভিযোগ করে বলেছেন, The BJP is fostering “political anarchy and chaos” in Tripura and the people are unhappy with the performance of the state government. (05 Oct. 2021, NDTV)। সুতরাং, সামনের ত্রিপুরা নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সাথে বিজেপি ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে এমন সম্ভাবনা ক্রমশ ম্রিয়মান। তাই পরবর্তী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ক্ষমতালোভী বিজেপি তার চিরাচরিত মুসলিমবিরোধী প্রপাগান্ডাবাজির ওপর নির্ভর করতে পারে। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলিম। আর মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোতে ওস্তাদ বিজেপি। সুতরাং, এমন ধারণা একেবারেই অমূলক নয় যে, বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের গল্প ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করতে এদেশে নতুন করে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রে বহিরাগত উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদীদের মদদ থাকতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষায় ‘জরুরি হস্তক্ষেপ’ করতে মোদীর প্রতি আহবান জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী (১৪ অক্টো. ২০২১, বিবিসি বাংলা)।
বাংলাদেশে হিন্দু এবং মুসলমান- উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি রাজনৈতিক স্বার্থের খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। দাঙ্গা লাগায় কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আর শিকার হয় সাধারণ হিন্দু-মুসলিম উভয়ই। কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাস্তায় গুলি খায় প্রতিবাদী ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা আর এ সুযোগে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়গুলো গুপ্ত হামলা বা স্যাবোট্যাজের শিকার হয় ক্ষমতাবানদের মদদপুষ্ট দ্বারা।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসলে এদেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের বেশিরভাগই শুধু ধর্মীয় অনুভূতিটার ব্যাপারেই সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে রাখেন। এর নেপথ্যে ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার, ফ্যাসিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর যে নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থ বা এজেন্ডা থাকতে পারে, সেটা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তারা কোনো কৌশল নেন বলে প্রতীয়মান হয়না। তাছাড়া সংখ্যালঘু ইস্যুটা দেশে ও বিদেশে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তারওপর এদেশে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের চাপে রাখতে রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অথচ সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদেরকে কার্যকর কোনো কৌশলগত নীতি বা অবস্থান নিতে দেখা যায় না। অন্যদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় এমনভাবে অভিযোগ করতে থাকেন, যেন এদেশের মুসলমানরা তাদের পর করে রেখেছে এবং নির্যাতন করছে, যা মোটেই সত্য নয়। হিন্দু নেতৃবৃন্দের উচিত মুসলমানদের সহমর্মী ভাবা এবং ইসলামপন্থীদের সাথে লিঁয়াজো রক্ষা করা। কিন্তু না, তারা যথারীতি একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহল দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বারেবারে ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকেন।
কতৃত্বপরায়ন শাসনের অন্যতম উপায় হলো ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি। সমাজে যতবেশি বিরোধ ও বিভক্তি তৈরি হয়, শাসকশ্রেণি ততই লাভবান হয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে প্রধানত হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি ও বিরোধ জারি রেখে প্রায় দু’শো বছর তাদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসন ধরে রাখতে পেরেছিল। সেই একই ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতি অনুসারে পুরো বাংলাদেশকে আরো আগেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের মেরুকরণের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন হিন্দু ও মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার চূড়ান্ত আয়োজন চলছে।
জার্মানির বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক জোহান ওফগ্যাংগ ভনের কালজয়ী উচ্চারণ: Divide and rule, the politician cries; unite and lead, is watchword of the wise. অর্থাৎ, রাজনীতিবিদরা চায় জনগণকে বিভক্ত করতে এবং শাসন করতে; কিন্তু বুদ্ধিমানরা চেষ্টা করে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং নেতৃত্ব দিতে। সুতরাং, জাতি হিসেবে আমাদের এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সবচে জরুরি। আমরা বিপজ্জনক ক্রান্তিকাল পার করছি। আমাদের জাতীয় ঐক্যের মূলে ক্রমাগত কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। আমাদের তৃণমূল সমাজে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান যথেষ্ট গৌরবের। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে এই গৌরব ধুলায় মিশিয়ে দিতে চায় স্বৈর-ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের মিলিত অপশক্তি। সুতরাং, আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে দেশের দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদগণ, নেতৃস্থানীয় আলেম-ওলামা ও সচেতন তরুণ সমাজের উচিত চলমান পরিস্থিতি শান্তকরণে যতদ্রুতসম্ভব ঐক্যবদ্ধভাবে তৎপর হওয়া।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।