পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা ২০১৮-তে মৃত্যুর যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীল উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধিকরণে সমীক্ষাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশ দূষণের কারণে গড় মৃত্যুর হার হচ্ছে ২৫.৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের কারণে মৃত্যুর হার হচ্ছে ২৭.৭ শতাংশ। এইখানে আমরা সবার সেরা। সবচেয়ে কম মত্যুর হার হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়, যা হচ্ছে ১৩.৭ শতাংশ। পরিবেশ দূষণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মৃত্যুর হার হচ্ছে যথাক্রমে ভারত ২৬.৫ শতাংশ, নেপাল ২৫.৫ শতাংশ, পাকিস্তান ২২.২ শতাংশ, আফগানিস্তান ২০.৬ শতাংশ, ভুটান ১৭.৭ শতাংশ। বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। শুধু শহর অঞ্চলে দূষণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের জীবনে এই ক্ষতির হিসাব আরও ভয়াবহ। দূষণের কারণে কেবল ২০১৫ সালেই শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ, যা সড়ক দুর্ঘনায় মৃত্যুর ১০ গুণ।
দূষণে বাংলাদেশ এগিয়ে: প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ২০১৫ সালে মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশের কারণ পরিবেশ দূষণজনতি অসুখ-বিসুখ। বাংলাদেশে এ হার প্রায় ২৮ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশের শহরগুলোতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ সীসা দূষণের ঝুঁকিতে বসবাস করে। বসতি এলাকায় ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত ব্যাটারিসহ শিল্প বর্জ্যরে কারণে ওই দূষণ ঘটছে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেকটর রাজশ্রী পারালকার বলেন, শহরগুলোতে পরিবেশ দূষণের জন্য বাংলাদেশেকে উচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। আর শিল্পগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করাতে হবে।
রাজধানীতে দূষণে বছরে ১৮ হাজার মৃত্যু: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষণের কারণে শুধু রাজধানী ঢাকায় ২০১৫ সালে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর ৫ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এ দূষণ রাজধানীতে বসবাসকারী, বিশেষত শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও রফতানি খাতের শ্রমিকদের এমন ক্ষতি কারণে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
ঢাকার চারপাশের চারটি নদীকে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ নদীগুলোর তীরে ৭১৯টি ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রতি টন কাপড় তৈরি ও রং করতে ২০০ টন বর্জ্য পানি তৈরি হচ্ছে, যা নদী ও জলাশয়ে পড়ে পানি দূষিত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদের মতে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পরিবেশসম্মতভাবে শিল্প কারখানা স্থাপনের আগ্রহ বাড়ছে। এ ধারা আমাদের ধরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ পরিমাপ করে দেখা গেছে, এখানে মানমাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ক্ষুদ্র বস্তুকণার অস্তিত্ব রয়েছে। শীতকাল অর্থাৎ অক্টোবর থেকে বাতাসে ওই বস্তুকণার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়, যা মানবদেহে প্রবেশ করে নানা প্রাণঘাতী রোগ তৈরি করছে। বায়ুতে দূষণকারী উপাদানের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত পাঁচটি উৎস থেকে এগুলো আসে। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ আসে ইট ভাটা থেকে, ১০ শতাংশ যানবাহনের ধোঁয়া থেকে, ৮ শতাংশ করে আসে মাটি ও সড়কের ধূলা থেকে। ৭ শতাংশ আসে কাঠসহ নানা ধরনের বস্তু পোড়ানো থেকে।
জলাভূমি ধ্বংস ও জলাবদ্ধতা: প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বড় ও ছোট শহরগুলোতে পরিবেশগত ক্ষতি বাড়ছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে রাজধানীর প্রায় ৭৫ শতাংশ জলাভূমি ধবংস হয়ে গেছে। এসব জলাভূমিতে উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে। আর শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পাবনার মতো ছোট শহর ৯০ দশকে গড়ে উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে এ শহরের অর্ধেকে জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে। শহরের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত ইছামতি নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর ২৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে বৃহত্তর ঢাকার ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। বসতি এলাকায় ২৭ শতাংশ এলাকাও ডুবে যায়। মূলত নদী খাল ও জলাভূমি দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে পড়তে পারছে না। আর তা শহরের মধ্যে জমা হচ্ছে।
দূষণ থেকে বাচার উপায়:
১. দূষণ কেন হচ্ছে? কী কারণে আমাদের শহরগুলো দিনে দিনে দূষণের শিকারে আক্রান্ত হচ্ছে? বিষয়টি তলিয়ে দেখা দেশের স্বার্থে খুবই প্রয়োজন। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনটি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের প্রিয় দেশটি দিনে দিনে দূষণের ভারে তলিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ কীভাবে দূষণ থেকে মুক্ত থেকে এগিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের দেখতে হবে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের শহরগুলোতে ৩০ হাজার মানুষ মারা গেলো, সংখ্যাটি বেশ বিরাট। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন দূষণের মূল কারণ। বাংলাদেশের প্রতিটি শহর বেড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। তাই পরিকল্পনা গ্রহণ এই অবস্থা থেকে বাঁচার প্রাথমিক পদক্ষেপ।
২. ‘পানি দূষণ’ বাংলাদেশের শহরগলোতে দূষণের অন্যতম সূচক। পানি দূষণ নানাভাবে হচ্ছে। বিশেষ করে শিল্প কারখানা থেকে দূষিত পানি পানি দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার শিল্প কারখানাকে পানি দূষণ থেকে মুক্ত রাখার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাতে ঠিকমত কাজ হচ্ছে না। শিল্প মালিকগণ ঠিকমত পানি দূষণমুক্ত হওয়ার জন্য তাদের প্রকল্প চালু করছে না। অর্থ বাঁচানোর জন্য তাতে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ বা অন্যান্য উপকরণের ব্যবস্থা করছে না। সরকারকে এ ব্যাপারে সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে। শিল্প মালিকগণকে পানি দূষণ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সঠিক আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
৩) শহরগুলোতে দূষণের মূল কারণের আর একটি হচ্ছে ইটভাটা, শহর ও শহরতলীতে ইট তৈরির কারখানা রয়েছে অগুনিত, এদের দূষণের ফলে শহরজীবন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে ইট তৈরি করা গেলে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। ইতোমধ্যে সরকার বড় শহরগুলোতে বায়ু দূষণের পর্যবেক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করেছে। শুধু যন্ত্র স্থাপন করে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
৪) শহরগুলোর বস্তি থেকে ও নানা বর্জ্য বায়ু দূষণ হচ্ছে। শহরের বস্তিগুলি অত্যন্ত অপরিকল্পিত, নোংরা। শহর থেকে বস্তি সরাতে হবে। বসবাসের উপযোগী করে শহরকে গড়তে হবে। বস্তিবাসী মানুষের জন্য বাস-উপযোগী বস্তি তৈরি করতে হবে। শহরে কোনো বস্তি রাখা যাবে না।
৫) যে পাঁচটি কারণে বায়ূ দূষণ হচ্ছে এর অন্যতম কারণ হচ্ছে শহরের যানবাহনের দূষিত ধোঁয়া থেকে। ১০ শতাংশ বায়ু দূষণ হচ্ছে যানবাহনের দূষিত ধোঁয়া থেকে। আমাদের শহরগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল করে অনেক বেশি। এই সকল অকেজো গাড়ির ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করছে। তাতে জীবনযাপন করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি, ত্রু টিযুক্ত গাড়ি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
৬) বায়ু দূষণ পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। শহরগুলোতে জলাশয় নাই বললেই চলে। সকল জলাশয় ভরাট করে বড় বড় ইমারত তৈরি করা হয়েছে। সরকারের বলিষ্ঠ কোনো নিয়ম না থাকার ফলে সহজে জলাশয় ভরাট করে আবাসন তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইন মানা হচ্ছে না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ আইনকে নিজের হাতে তোলে নেয়। তারা নিয়ম কানুন না মেলে নিজেদের স্বার্থে জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করে যাচ্ছে। বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছে। এ জন্য প্রয়োজন আইনের শক্ত প্রয়োগ। আইনকে নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। সকলের জন্য আইন সমান, এই নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
মানুষ সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে চায়। শুধু দূষণ নয়, সকল প্রকার অনাচার, অন্যায়, অবিচার থেকে মানুষ বাঁচতে চায়। সকলে তার চেষ্টাও করে। সরকারও মানুষের কল্যাণে সব কিছু করছে। কিন্তু এই করার চাহিদা অনেক বেশি। মানুষের প্রবল পাওয়ার আশার চেয়ে সরকারের প্রচেষ্টা অনেকক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। সরকারকে আরও বেশি পারদর্শী, দক্ষ ও সক্ষম হতে হবে। সরকারের কর্মপরিকল্পপনা আরো নিখুঁত ও বাস্তবায়ন দ্রুতায়িত করতে হবে। মানুষের চাহিদা পূলণের জন্য আরও বেশি দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। দক্ষ জনবল ছাড়া শুধু পরিবেশ অধিদপ্তর কেন, সরকারের কোন কর্মকান্ড মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। নিষ্ঠাবান দক্ষ, সুশিক্ষিত দেশপ্রেমিক জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভাসিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।