Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুলিশের দিব্যদৃষ্টি এবং রাখাল বালকের গরু খোঁজা

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আমাদের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে অভিযোগের অন্ত নেই। বিভিন্ন সময়ে এ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের নানা অনৈতিক কাজ সমালোচনার ঝড় তুলেছে। পুলিশের খাতায় পুলিশেরই বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমে ওঠার খবরও আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। কখনো কখনো পুলিশ এমন সব বিতর্কিত কাজ করে, যা সরকারকে প্রচন্ডভাবে বিব্রত করে। এ নিয়ে সরকারের শীর্ষমহল বা সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায় থেকে ক্ষোভ এবং সতর্কবার্তা উচ্চারণ করতেও দেখা গেছে। কিন্তু তাতে তেমন ফলোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। আর সেজন্যই এখনও পুলিশকে এমন সব কাজ করতে দেখা যায়, যেগুলো শুধু লজ্জ্বাকরই নয়, জনমনে ক্ষোভেরও জন্ম দেয়।
আমাদের ‘কীর্তিমান’ পুলিশের সর্বশেষ বিস্ময়কর কৃতিত্ব হলো তারা মৃত মানুষকে ককটেল ছুঁড়তে দেখেছে। ঘটনাটি ঘটেছে খোদ রাজধানীতে গত ৫ সেপ্টেম্বর। চকবাজার থানা-পুলিশের দায়ের করা এক মামলায় বলা হয়েছে, ওইদিন নাজিমউদ্দিন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচার শুরু হয়। সে বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেলা ১১ টার দিকে বেচারাম দেউরির আজগরি মঞ্জিলের সামনে জড়ো হয়। সেখানে তারা বিক্ষোভ মিছিল করে। পুলিশ বাধা দিলে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটায়। এ মামলার বাদি উক্ত থানার এস আই কামালউদ্দিন। মামলায় যে ৩৭ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন চকবাজার থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবদুল আজিজুল্লাহ, যিনি প্রায় আঠাশ মাস আগে ২০১৬ সালের মে মাসে পরলোকে চলে গেছেন। ওই একই মামলায় আসামী করা হয়েছে আবদুল মান্নাফ ওরফে চাঁন মিয়া নামে একজন বিএনপি সমর্থককে, যিনি গত ৪ আগষ্ট থেকে হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। একই ধরনের আরো একটি মামলা হয়েছে গত ৩ সেপ্টেম্বর একই থানায়। সে মামলায় আসামী করা হয়েছে ৭০ জনকে, যাদের মধ্যে ৩৯ জনের নামোল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ নম্বর আসামী হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক খতিবুর রহমান, যিনিও হজ পালনের জন্য গত ১০ আগষ্ট সৌদি আরবে গিয়ে এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। এদিকে এ মামলা সম্পর্কে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘৫ সেপ্টেম্বর আজগরি মঞ্জিলের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের অবস্থান করতে তিনি দেখেন নি। চকবাজার থানা বিএনপির নেতাকর্মীরা কারাগারে গিয়ে নৈরাজ্য করবে, এমন শক্তি তাদের নেই।’ উল্লেখ্য, পুলিশের মামলায় বর্নিত ঘটনাস্থল থেকে আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রহমানের বাসার দূরত্ব কম-বেশি এক শ’ ফুট।
একই দিনে গাজীপুর সদর থানায় এবং শ্রীপুর থানায় পৃথক দু’টি মামলায় আসামী করা হয়েছে এমন দু’জন ব্যক্তিকে, যারা ঘটনার দিন দেশেই ছিলেন না। তাদের একজন হলেন গাজীপুর জেলা বিএনপিসাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম, যিনি তার ছেলের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। অপরজন শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজ কাইয়া। তিনি নিজের চিকিৎসার জন্য এক সপ্তাহ আগে থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন। এমনি ধরনের আরেকটি মামলার কাহিনী শোনালেন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন। তিনি এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ইস্তফা দিয়ে বিএনপি ও রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। অথচ তাকে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার একটি মামলায় আসামী করেছে পুলিশ। গত ৩ সেপ্টেম্বর দায়ের করা ওই মামলায় পুলিশ বলেছে, নাশকতা সংঘটনের জন্য গোপন সভা থেকে গ্রেফতারকৃত একজন জানিয়েছে, সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন তাদের সাথে সম্পৃক্ত। আক্ষেপ করে তিনি এ নিবন্ধকারকে বললেন, রাজনীতি থেকে দূরে আছি কত বছর, অথচ এখন একটি রাজনৈতিক মামলার আসামী হয়ে গেলাম! ঘটনাগুলো চাঞ্চল্যকর সন্দেহ নেই। ইতিপূর্বে ঘটনাস্থলে না থেকেও মামলার আসামী হওয়ার নজির থাকলেও, মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ককটেল ছোঁড়ার অভিযোগ এটাই প্রথম। বলা নিষ্প্রযোজন, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার কারণেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা ওই মামলাগুলো দায়ের করেছে। এ ধরনের দিকনির্দেশনা ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে পুলিশ সব সময়ই পেয়ে থাকে। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ট্র্যাডিশনে পরিনত হয়েছে। যখন যে দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকে, তখন সে দল পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর সেজন্যই বিভিন্ন সময়ে স্বনামধন্য রাজনীতিকদের অদ্ভ‚ত সব মামলার আসামী হতে দেখা গেছে। যেমন ১৯৯৯ বা ২০০০ সালে পুলিশ চট্টগ্রামে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে একটি রেঁস্তোরা থেকে তিন পাত্র হালিম ও ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে মামলা করেছিল। আবার সাবেক উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে যেমন প্লেট চুরির মামলা হয়েছে, তেমনি সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ভ্যানিটি ব্যাগ চুরির মামলাও দিয়েছে পুলিশ। এসব মামলা যে কোনো বিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও এ ধরনের মামলা অতীতে হয়েছে, এখন হচ্ছে এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন না ঘটলে হয়তো ভবিষ্যতেও হবে।
পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। জনগণের জানমালের সুরক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তাদের। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী-ক্যাডার নয়। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের সরকারগুলো তাদেরকে দলীয় পেটোয়া বাহিনীর মতো ব্যবহার করে। এ অভিযোগ কোনো রাজনৈতিক দলই অস্বীকার করতে পারবে না, যারা এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বা আছে। ক্ষমতাসীনদের পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা জন্ম দিচ্ছে নানা অঘটনের। সরকারি আনুক‚ল্য পাবার আশায় কিছু পুলিশ সদস্য অতিভক্ত হয়ে যায়। তাদেরেকে কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে, আর বেঁধে আনতে বললে মারতে মারতে আনে। এর ফলে ঘটে নানা বিপত্তিকর ঘটনা, যেগুলো একটি সরকারের জন্য হয়ে উঠে চরম বিব্রতকর। পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের বিশেষ আনুক‚ল্য পেয়ে এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য হয়ে উঠে বেপরোয়া। তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না, আইনকে থোড়াই কেয়ার করে। কিছু পুলিশ কর্মকর্তার দেখা সব সরকারের আমলেই পাওয়া যায়, যাদের আচরণ ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ’-এর মতো। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে এরা শেখ হাসিনার চেয়ে বড়ো আওয়ামী লীগার বনে যায়, আবার বিএনপি সরকারে এলে বিএনপি প্রেমে এরা বেগম খালেদা জিয়াকে পেছনে ঠেলে দিতে চায়। দুভার্গ্যজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এদের ‘অতিভক্তি’তে আপ্লুত হন এবং ভুলে যান যে, সরকারে না থাকলে এরাই খড়গহস্ত হয়ে উঠতে দ্বিধা করবে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার একটি লাইন হলো-‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বল তার শত গুণ।’ আমাদের দেশের সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের চরিত্রে আমরা সে রকম দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। আমরা জানিনা, বিএনপির সমাবেশে লাঠিচার্জ বা সেখান থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও মামলার কোনো নির্দেশনা সরকারের তরফ থেকে পুলিশকে দেয়া আছে কীনা। হয়তো সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। এ ধরনের নির্দেশ দেয়া অস্বভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠে তখনই, যখন বিনা কারণে পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। যে ক’টি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তার একটিতেও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা জনজীবনে বিঘ্ন ঘটানোর প্রমাণ নেই। বিএনপি কর্মীরা জমায়েত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের ওপর। কোথাও আবার কোনো ঘটনা ছাড়াই দায়ের করে দিয়েছে মামলা। বিএনপির তরফ থেকে এসব মামলাকে ‘গায়েবী মামলা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এসব মামলা করার সময় পুলিশ যে বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলছে, তা ওই মৃত ব্যক্তি এবং বিদেশে অবস্থানরতদের আসামী করার ঘটনা থেকেই স্পষ্ট। বলাই বাহুল্য, এমন ঘটনা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
মৃত ব্যক্তিকে ককটেল ছুঁড়তে দেখেছে পুলিশ, এরচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা আর কী হতে পারে! কেউ কেউ বলছেন, বোধকরি আমাদের কিছু পুলিশের দিব্যদৃষ্টি খুলে গেছে। তাই তারা এখন দেখতে পায় মৃত ব্যক্তি পৃথিবীতে কী করছে! অনেক আগে শোনা এবং অনেকেরই জানা একটি চুটকি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা ঝোঁপের আড়ালে বসে প্রেমালাপ করছে। মুগ্ধ প্রেমিক প্রেমিকাকে বলছে-তোমার চোখে আমি সারা পৃথিবী দেখতে পাই। ঝোঁপের আড়ালেই বসেছিল গরু হারিয়ে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত এক রাখাল বালক। প্রেমিকের কথা শুনে সে লাফ দিয়ে এপাশে এসে বলল- ভাইজান, একটু দেখবেন, আমার গরুটা কোথায় আছে?
এ প্রসঙ্গে একজন মন্তব্য করলেন, যেহেতু পুলিশ এখন মৃত ব্যক্তিকে মিছিলে দেখতে পায়, তাহলে তো ভালোই হলো। আমরা এখন পুলিশের কাছে গেলেই জানতে পারবো আমাদের পরলোকগত স্বজনরা কে কেমন আছেন, কী করছেন! সহত প্রশ্ন, এখন দিব্য দৃষ্টি যাদের, তারা কেন সাগর-রুনীর হত্যকারীদের খুঁজে পায়না? কেন হদিস করতে পারেনা কুমিল্লার হতভাগ্য তরুণী সোহগী জাহান তনুর খুনি কে বা কারা? এসব প্রশ্নে জবাব দেয়ার কেউ কি আছে?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশ


আরও
আরও পড়ুন