পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ১০ বছরেও তিস্তাচুক্তিসহ ভারতের সাথে যৌথনদীর পানিবন্টন ইস্যুর কোন সুরাহা করতে পারেনি সরকার। পানিচুক্তির মত একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সাথে দেশের যে কোন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মানদন্ড অনেকাংশে নির্ভরশীল। গঙ্গা ও তিস্তার পানিবন্টন ইস্যুতে ভারতের অনিচ্ছা, টালবাহানার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সদিচ্ছাও প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১০ বছরে বা তার আগের সরকারগুলোকে অভিন্ন নদীর পানিবন্টন ইস্যুতে তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শক্ত অবস্থানের কারণে গঙ্গার পানি বন্টনে একটি সমতাভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠলেও তার ধারাবাহিকতায় এরশাদ তেমন কোন ভ‚মিকা নিতে পারেনি। একইভাবে ভারতের অনিচ্ছার কারণে বিএনপি ও জোট সরকারও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোটের ক্ষমতায় আসা এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে ক‚টনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে ভারতের ভ‚মিকার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। উইকিলিক্স পেপার এবং ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও ক‚টনীতিকদের লেখালেখিতে সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে তা আরোও স্পষ্ট হয়েছে। গত ১০ বছরে ভারতে ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনীতিতে বড় ধরনের পালাবদল ঘটলেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। কংগ্রেসের সাথে আওয়ামীলীগের ঐতিহাসিক সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের সময়ও যথাযথভাবে ধরে রাখতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি। এই ১০ বছর ধরেই ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের অনন্য উচ্চতায় আসীন হওয়ার গল্প শুনেছে দেশের মানুষ। প্রনব মুখার্জি, মনমোহন সিং, নরেন্দ্র মোদি, শেখ হাসিনা ভারত ও বাংলাদেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যখনই সফর বিনিময় করেছেন, তখনই প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল গঙ্গা ও তিস্তার পানি বন্টনচুক্তি। বাংলাদেশে মনমোহন সিংয়ের প্রথম সফর থেকে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার শেষ সফর পর্যন্ত তিস্তাচুক্তি না হওয়ার পেছনে প্রায় একই রকম অজুহাত ও আশাবাদ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ সময়ে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে এমন অনেক কিছুই আদায় করে নিয়েছে যা’ পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে এবং বাংলাদেশের প্রথম ৪০ বছরেও পাওয়ার আশা করতে পারেনি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং প্রায় বিনাশুল্কে ভারতের ট্রানজিট করিডর দেয়ার মত বাংলাদেশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও ভারত বাংলাদেশের পানির ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে ন্যুনতম সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পশ্চিমাবিশ্ব যখন বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপযোগি পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিল তার সবই ব্যর্থ হয়েছিল ভারতীয় ক‚টনীতিকদের একতরফা আগ্রসী ভ‚মিকার কারণে। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অনড় এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে ক‚টনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে ভারতীয়দের নগ্ন ভ‚মিকাও সারাবিশ্ব দেখেছে। এভাবেই বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক নতুন মাত্রা ও উচ্চতায় উপনীত হয়। জনগণের সাথে জনগণের স্থায়ী সুসম্পর্ক গড়ে উঠে উভয় দেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের প্রশ্নে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব মানুষের স্থায়ী স্বার্থের চেয়ে বিশেষ দলকে ক্ষমতায় রেখে তাদের মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করাই যেন ভারতের বাংলাদেশ নীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দিক থেকে এ নীতি পুরোপুরি সফল। তিস্তার পানি বন্টন, বাণিজ্য বৈষম্য ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে সব কিছু আদায় করে নিতে তারা পূর্ণ সকল হয়েছে। দেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার বা কার্যকর সংসদ থাকলে এটা হয়তো সম্ভব হতো না।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সম্ভাব্য তফশিল ও তারিখ অনুসারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০০৬ সালের সম্ভাব্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। প্রথম বারের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত এক-এগারো সরকারের সরকারের বিশেষ রোডম্যাপ অনুসারে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেষ হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা যায়নি শুধুমাত্র ভারতীয়দের কারণে। এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর ভারত ফ্যাক্টর নতুন করে আলোচ্য বস্তুতে পরিনত হতে দেখা যাচ্ছে। এবারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে জটিল ও ঘোলাটে। এহেন বাস্তবতায় একদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জন অন্যদিকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় থাকার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার রাজনৈতিকভাবে কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত নয় বলেই ধরে নেয়া যায়। যদিও শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। বিরোধিদল বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি একতরফা অথবা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়েই এখনো এগোচ্ছে সরকার। নির্বাচন যে সরকারের অধীনেই হোক, শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট এবং যুক্তফ্রন্ট,বিকল্পধারা, ডক্টর কামাল, বি.চৌধুরীসহ কথিত জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সমন্বয়ে আওয়ামীলীগ বিরোধি নির্বাচনী মহাঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় থাকতে হলে তাদের সাজানো প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং আগামী দিনের উন্নয়নের রোডম্যাপ হাতে নিয়েই ভোটের মাঠে নামতে হবে। তবে ক্ষমতায় আঁকড়ে থেকে নিজেদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগনের সাড়া পাওয়া যে কঠিন হবে তা হয়তো সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের বুঝতে বাকি নেই। বিএনপির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সিটি নির্বাচনগুলো অংশগ্রহণমূলক হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসনের ভ‚মিকার কারণে গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল ও রাজশাহী সিটিতে কেন্দ্র দখলবাজি, সিলমারার চিত্র লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এতকিছুর পাশাপাশি সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী থাকার পরও সিলেটে বিএনপি প্রার্থীর বিজয়কে সরকারের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র থাকার প্রমান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। হাজার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি ও জেলা পরিষদ নির্বানে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বিজয় নিশ্চিত করার পর সিলেটে বিএনপি’র বিজয়কে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিজয় এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে করার যৌক্তিক প্রমান হিসেবে হাজির করার কার্ড তেমন কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছেনা।
বর্তমান সরকার দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাত, বিদ্যুত ও জ্বালানী খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে যথেষ্ট সফল হয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এসব খাতে সরকারের অবদানকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার চিন্তা করছে সরকার। তবে মানুষ এখনো অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের অধিকার সংরক্ষণকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বিরোধিদল সমর্থিত মূলধারার প্রধান গণমাধ্যমগুলো সরকারী খড়গের নিচে ধরাশায়ী হওয়ার পর গণমাধ্যমে জনগন মূলত সরকারের উন্নয়নের একতরফা ফিরিস্তিই শুনে ও দেখে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গত ১০ বছর ধরে সরকারের একতরফা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডাও কম হয়নি। এতকিছুর পরও যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সরকারের গদি নড়বড়ে করে দেয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, এতদিন ধরে চলা স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা এবং উন্নয়নের মূলা সরকারের পক্ষে জনমত গঠনে তেমন কোন কাজে লাগেনি। দাবী মেনে নেয়ার পরও আন্দোলন দমনে সরকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছাড়াও ছাত্রদের উপর অব্যাহত পুলিশি হয়রানি তুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগের জন্য বড় ধরনের বিপত্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের বাস্তবতায় সরকারীদলের নেতাকর্মীরা অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিই হয়তো সরকারকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের আওতায় একটি একতরফা অথবা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করছে। সরকারী জোটের বাইরে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও জোট, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষিত নীতি ও প্রত্যাশার বিষয়টি অগ্রাহ্য করে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের এমন ডেসপারেট ভ’মিকা দেশকে বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিরোধিদলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি ভোটার বিহিন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মানুষ আশা করেছিল রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে সরকার। ৫ জানুয়ারীর দশম সংসদ নির্বাচনকে একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার রক্ষার নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেও এমন প্রতিশ্রæতি শোনা গিয়েছিল। সরকারের সেই অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ানোর নেপথ্য বিষয় নিয়ে অনেক কিছুই বলা যায়। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা এখানে কাজ করেছে তা সম্ভবত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগের ক্ষমতা হারানোর ভয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এখানে এতটা ভয় পাওয়ার কিছুই থাকতো না যদি দেশে আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা থাকতো। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা হারানোর পর চারদলীয় জোটের কর্মীরা সারাদেশে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদের উপর তান্ডব চালিয়েছিল, আওয়ামীলীগের এমন অভিযোগের কিছু হলেও সত্যতা আছে। তবে বিএনপি পক্ষের দাবী হচ্ছে নির্বাচনের পর তাদের কর্মীদের পক্ষে বাড়াবাড়ি যা হয়েছে তা আগের পাঁচ বছরের আওয়ামী শাসনে জুলুম-নির্যাতনের একটি প্রতিক্রিয়া। এমন প্রতিক্রিয়াকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলে দেশে আইনের শাসন ও জননিরাপত্তার আইনগত সাংবিধানিক নিশ্চয়তার কোন মূল্যই থাকছেনা। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষে এসে এখন আওয়ামীলীগের কোন কোন নেতা ক্ষমতা হারানোর পর আগের চেয়েও বড় ধরনের সংঘাত ও নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা করছেন। দলের শীর্ষ স্থানীয় একাধিক নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যে রোহিঙ্গার পরিণত হওয়া, উপার্জিত অর্থকড়ি ফেলে পালানো, প্রথম দিনেই ১ লাখের মৃত্যু ও অন্তত ১০ লাখের মানুষের প্রাণ যাবে ইত্যাদি আশঙ্কার কথা ফুটে উঠেছে।
ক্ষমতাসীনদের এই ভীতি, সম্ভাব্য সংঘাত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরীর স্বার্থেই দেশে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংঘাত-সহিংসতা এবং নির্বাচনে দখলদারিত্বের চির অবসানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই দেশের বেশীরভাগ মানুষ একটি রাজনৈতিক সমঝোতাকে সমর্থন করছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংসদ বহাল রেখে নিজেদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে শাসকদের এসব আশঙ্কা আরো বেড়েই চলেছে। এ মুহূর্তে দেশে আওয়ামীলীগ বিরোধি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি ডক্টর কামাল, ডা. বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দল ও জোটের সমন্বয়ে এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সফল হলে দেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধি অভ্যুত্থানের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাদের ঐক্য প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্র বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য বলে মনে মন্তব্য করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ সব সময়ই ঐক্যবদ্ধ। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, সত্তুরের জাতীয় নির্বাচন ও একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন ইত্যাদি প্রতিটি আন্দোলনে আওয়ামীলীগের গৌরবময় ভ’মিকা ছিল। সেই আওয়ামীলীগের নেতারা জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীকে পুলিশ দিয়ে মোকাবেলার যে কৌশল গ্রহণ করেছে তা’ তাদের দলীয় ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। গত ৪৭ বছরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যেটুকু এগিয়েছে তার সাথে দেশের সব জনগোষ্ঠি ও সব রাজনৈতিক শক্তির অবদান রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন সরকারের কাজের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। এই উন্নয়ন কোন নির্দ্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা এখনকার প্রেক্ষাপটে দেশের জন্য সবচেয়ে কাঙ্খিত ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জনগনের এই আকাঙ্খাকে অগ্রাহ্য করার কোন অজুহাত মানুষের কাছে সামান্যতম গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেনা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এটাই হচ্ছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ফোকাল পয়েন্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ মেয়াদে ক্ষমতাসীন। বিরোধিদল ও মত দমন করে রাজনৈতিক আন্দোলন দূরের কথা, ঘরোয়া কর্মসূচি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে দেশে এক প্রকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কায়েম করে দেশ পরিচালনা করেছে। বৈদেশিক মূদ্রায় দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার, আইনের শাসন ও জননিরাপত্তা নিয়ে অসন্তোষ ও দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়নে আশাব্যঞ্জক সাফল্যের কৃতিত্ব সরকারের রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করলে এ সাফল্য আওয়ামীলীগের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য অনেক বড় মাইলফলক হিসেবে কাজে লাগতে পারে। নির্বাচনের মাঠ, প্রশাসন নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতার কলকাঠি নিজেদের অধীনে রেখে অভিসন্ধির নির্বাচন একবার হয়েছে, বাধ্য হয়ে জনগন মেনেও নিয়েছে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন, রফতানী বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোটারবিহিন নির্বাচনের বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যত লিপ সার্ভিস দিলেও ভারত ও চীনের মত প্রতিবেশীদের ভ‚মিকায় মিয়ানমারের প্রতিপক্ষে বাংলাদেশের বন্ধুহীন অসহায় অবস্থাই ফুটে উঠেছে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সব রাজনৈতিক দল ও জনগনের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সরকার ও জনগনের ঐক্যই কেবল এ ধরনের পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে। কোন দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়; আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেই বাস্তবায়িত করবে। এহেন বাস্তবতায় আওয়ামীলীগ বিরোধি জাতীয় ঐক্যের চিন্তার পাশাপাশি আওয়ামীলীগ ও জোটসহ সবদলের মধ্যে রাজনৈতিক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন আরো ত্বরান্বিত হওয়া সম্ভব হতে পারে। এটাই জনগণের মূল প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।