শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কবিতায় ‘সুরিয়ালিজম্’ বা ‘পরাবাস্তবতা’ বিংশ শতাব্দীর অভিনব সাহিত্য উপাদান। ‘মানুষের মনের চেতন ও অচেতন অবস্থার ঊর্ধ্বে যে একটি অবচেতন বিরাজ করে সে অবচেতনের গহীন থেকে উঠে আসা বাস্তবের অধিক বাস্তব আপাত অবাস্তবই পরাবাস্তবতা’। অবচেতন মনের ক্রিয়া কল্পনানির্ভর সাহিত্য হচ্ছে পরাবাস্তব সাহিত্য।
ফরাসী সাহিত্যিক গিওম আপলেনিয়ের (১৮৮০-১৯১৮) ১৯১৭ সালে প্রথম ‘সুরিয়ালিষ্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর ‘টাইরেসিয়াস-এর স্তন’ নাটক সম্পর্কে। সুতরাং সাহিত্য চক্র থেকেই ‘পরাবাস্তব’ অভিধানটির সূচনা। কিন্তু ইউরোপ বিশেষত প্যারিসের সাহিত্য থেকে চিত্রকলা, ভাষ্কর্য ইত্যাদিতে পরাবাস্তবতা সংক্রমিত হয়েছে। ফরাসী দেশে পরাবাস্তবতার উৎসরণ ঘটলেও জার্মান ও ইংরেজি সাহিত্যের ধারাও একে সহায়তা করেছিলো। কবিতার পরাবাস্তবতার সূচনায় রয়েছেন জ্যঁ আতুর র্যাবোঁ (১৮৫৪-৯১), জেরার দ্য মেরভাল (১৮০৮-৫৫) প্রমুখ।
প্রাথমিক পর্যায়ে পরাবাস্তববাদী কাব্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আঁদ্রে ব্রেঁতো (১৮৯৬-১৯৬৬)। এ ধারার তিনি প্রবীণ ব্যক্তিত্ব। ফ্রান্স থেকে পরাবাস্তবতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। সাহিত্য প্রতীকীপন্থা বিশুদ্ধ বাস্তবতাকে ভেঙে-চুরে তছনছ করে দিয়েছিলো এক সময়। তারপর ভবিষ্যৎ বঙ্গ-দাঙ্গাবাদের হৈ চৈ পার হয়ে শুরু হলো পরাবাস্তববাদের যাত্রা। শতাব্দীর সূচনায় সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর ‘নব্য মনোঃসমীক্ষণে’ তত্তা প্রচার করেন। তার আবিস্কৃতির ফলে পরাবাস্তবতার আহরণ কেন্দ্র উন্মোচিত হয়।
‘পরাবাস্তবতা’ শোভন চিৎ প্রবাহী পদ্য রচনার চেষ্টায় বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কবিতার মধ্যেই প্রথম পরাবাস্তবতার ল²ণ দেখা যায়। তাঁর কবিতায় এক প্রবাহমান অনুভবের বাধা বন্ধনহীন বিস্তার লক্ষ্য করার মত। বাইরের তথা সমাজ বাস্তবতার দ্ব›দ্ব কোলাহলকে পাশ কাটিয়ে তিনি তী² অনুভ‚তিশীল হৃদয়ের মুখ্য বিষয় করে তুলেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় ব্যক্তিমনের অর্ন্তলোক উদ্ঘাটনের চেষ্টা লক্ষণীয়। জীবনের নির্লিপ্ত বাস্তবতার চেয়ে আলো আঁধারীর কুহুক যেন মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় সমকালীন সমাজসত্য অন্নেষণের পাশাপাশি পরাবাস্তবতার স্ফূরণ ঘটেছে ফল্গুধারার মত।
আবদুল মান্নান সৈয়দ (জন্ম : ৩ আগস্ট ১৯৪৫-মৃত্যু : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) ষাটের দশকের সবচেয়ে শিল্পসচেতন কবি। ‘তাঁর কবিতায় অন্তর্জগতই প্রধান, বর্হিপৃথিবী নিজ গৌরবে নয় বরং তাঁর নিজ প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রতিফিলিত।’ পরাবাস্তববাদী চাতুর্যকে সবিশেষ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৭), ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসার’ (১৯৬৯), পরাবাস্তববাদী কবিতা’ (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রন্থের অসংখ্য কবিতায় তিনি পরাবাস্তববাদের জগতে নিবিড়ভাবে পদচারণা করেছেন। বিংশ শতব্দীর প্রথম দশকে গিওম আপলিনেয়ার বা আন্দ্রে বে্রঁতো ফরাসী সাহিত্যে পরাবাস্তববাদের সুর তুলেছিলেন; বাংলা সাহিত্যে ঠিক পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে সে ধারার পূর্ণ যৌবন লাভ করে। ইতোপূর্র্বে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, অমীয় চক্রবর্তীও পরাবাস্তববাদ সাহিত্য ধারায় বিচরণ করেছেন চরম সার্থকতায়।
আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় এক প্রবাহমান অনুভবের বাধা বন্ধনহীন বিস্তার লক্ষ্য করার মত। বাইরের তথা সমাজ বাস্তবতার দ্ব›দ্ব কোলাহলকে পাশ কাটিয়ে কবিতাকে তিনি তী² অনুভ‚তিশীল হৃদয়ের মুখ্য বিষয় করে তুলেেেছন। তাঁর অনুভব- তরঙ্গে ভাসমান শব্দকণাগুলো স্বাধীনভাবে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকে নিঃশেষে প্রকাশ করার আনন্দে প্লাবিত হয়েছেন। নিদ্রার আবেশনামা পৃথিবীতে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ে, কুয়াশা নেমে আসে পিঙ্গল মৃত্তিকায়, কবি তখন জেগে থাকেন একাকী অন্ধকারে। নিস্তব্দ প্রহরের কণ্ঠস্বর এসে বাজে তার কানে। হৃদয়ের গভীর অন্তঃপুরে এবং অনুভব সমুদ্রে বিচিত্র তরঙ্গসমূহকে সাজিয়ে তুলেছেন সুনির্বাচিত শব্দের স্নিগ্ধ ও শিল্পিত বিন্যাসে নির্মাণ করেছেন শাশ্বতের ছোয়া পাওয়া সৌন্দর্যের এক অপূর্ব আনন্দলোক। সেই আনন্দে যেমন আসক্তির উম্মাদনা আছে, তেমনি আছে নিরাসাক্তির বৈরাগ্যও।
বস্তুত, বাংলাদেশের কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে পরাবাস্তববাদ নবরূপ লাভ করেছে। তাঁর বিভিন্ন কবিতা কালোত্তীর্ণ চিন্তার যুক্তিতে বিভাসিত। “পরাবাস্তববাদ রোমান্টিকতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে এমন দাবী ভিত্তিহীন মনে হয় এজন্য যে এ ধরনের কাব্যতত্তা কমবেশী রোমান্টিকতারই অপরপিঠ- কবিতার বিশদ বিশ্লেষণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে এদের অভিনবত্বটুকু খাঁটি, খাঁটি প্রচলিত কাব্যরীতি অস্বীকার করে অর্ন্তজগত এবং বর্হিজগকে একাকার করে কবিকে স্বপ্নের মায়াবী ভ‚বনে পৌঁছাতে চেয়েছে। পরাবাস্তবতায় তাই আপাত-বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে, জীবন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে সে আবছা রোমান্টিকতার আলো- আাঁধারে পৌঁছেছে। ক্রিস্টোফার কডওয়েলের বিচারে ‘বুর্জোয়াতন্ত্রের অবশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি পরাবাস্তবতা।” (আহমদ রফিক, কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা, অনন্যা, ২০০১, পৃষ্ঠা- ৭৫)।
মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতার ঐতিহ্যে পরিভ্রমণ না করে ইউরোপীয় কাব্যরীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ পাঠে এ কথা অনিস্বীকার্যভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তার কবিতায় পরাবাস্তবতা, ধোয়াশা ও কুহেলিকা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষত, ‘শিল্পের জন্য শিল্প এবং সৌন্দর্যই শিল্পের প্রধান অভিষ্ট’-এমন চেতনা তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। ফলে তিনি নির্বিঘ্নে অবগাহন করেছেন পরাবাস্তবতার জগতে। তাঁর ‘জীবনানন্দ’ নামক কবিতায় তিনি জীবনানন্দকে বিভিন্ন প্রেক্ষণ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অনুধাবন করেছেন। এ অনুধাবনের প্রক্ষেপ আর বর্ণনাভঙ্গি পরাবাস্তব চেতনা সমৃদ্ধ :
‘‘দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে
চোখের সবুজ প্রিজমের ভিতর থেকে লাফিয়ে পড়েছে ফড়িং
হেমন্তের শিশিরের সুঁই ঘিরে ধরেছে তাঁর পদযুগল
কোন আদিম দেবতার কাছে নতজানু
ধূসর মানুষের মতো
দেখি তাঁর বিড়বিড় স্বাগত উচ্চারণ থেকে
বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যাবেলার সবগুলো তারা
দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।”
(জীবনানন্দ) (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।