পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
’৯১-এর পর প্রত্যেক সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এরশাদের পতনের আগেই সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তবে এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন শেষ হতে না হতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায়। দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব, অনাস্থা, অবিশ্বাস ও একগুঁয়েমি মনোভাবের কারণে দেশের রাজনীতি স্থিতিশীল হতে পারেনি। ৯১-এ ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ’৯৬ সালে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামীলীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন- সংগ্রাম শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে ১৫ ফেব্রুয়ারীর একতরফা নির্বাচন এবং সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযুক্ত করতে হয়। সংগত কারণেই আশা করা হয়, সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে থাকবে। ’৯৬- এ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট নিজের মতো করে নির্বাচন করতে চাইলে আওয়ামী লীগ তা না মেনে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। ‘নীলনকশা’র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। সঙ্কটের সুরাহা যখন কোনভাবেই হচ্ছিল না, তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং সরকারকে স্বাগত জানায়। এ সরকার তার আন্দোলনের ফসল বলেও ঘোষণা দেয়। সেনাসমর্থিত রসরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তিন- চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। যে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়, পরবর্তীতে কোর্টের রায় উল্লেখ করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তারাই তা দ্রুত বাতিল করে দেয়। উল্লেখিত তথ্যগুলো সকলেরই জানা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার যুক্তি হিসেবে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সরকার অনির্বাচিত। তাদের দ্বারা নির্বাচন করা গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থী। কাজেই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নির্বাচন হবে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে। বলা বাহুল্য, সে সময় সরকারের এই ব্যাখ্যা, গণতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তা অসম্ভব। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এমন কোনো সুসম্পর্ক বা একে অপরকে বিশ্বাস করার মতো সম্পর্ক কোনো কালেই গড়ে ওঠেনি। এক দলের অধীনে আরেক দল নির্বাচনে বিজয়ী হবে- এমন বাস্তবতা ও বিশ্বাস কখনোই ছিল না এবং এখনো নেই।
দুই.
আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বর্তমানে যে কঠোর অবস্থান তা থেকে তার সরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার এবং দাবি অনাদায়ে আন্দোলন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে চলেছে। ফলে দেশ যে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আবর্তিত হবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। দেশের রাজনীতি সংঘাত- সহিংসতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হবে। অথচ ক্ষমতাসীন দল চাইলে এই সমস্যার সমাধান সহজেই করা যায়। তা না করে দলটির আচরণে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যে কোনো উপায়েই হোক তার আবার ক্ষমতায় আসতে হবে। দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য বেশ ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে। তার প্রধান বিএনপিকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। আন্দোলন করলে শক্ত হাতে দমন করা হবে বলে জোর গলায় হুশিয়ারি দিচ্ছেন। এতে এ মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে তা অনুমাণ করা যায়। কারণ নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া বিএনপি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি জোট ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তারা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামতে পারে। অন্যদিকে সরকারও তার প্রশাসন দিয়ে তা দমন যে করবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। এছাড়া সরকারের সামনে সহজ পথ নেই। অথচ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া খুবই সম্ভব ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যখন আদালত বাতিল করেছিল এবং পরবর্তী দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছিলেন তখন বিষয়টি যদি ক্ষমতাসীন দল বিবেচনায় নিত তাহলে রাজনীতিতে একটা আমূল পরিবর্তন আসত এবং বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সে সময় অন্তত একটি নির্বাচন হবে, এই অপশন রাখলেও রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন দেখা যেত। তখন প্রত্যেকটি দলই পরবর্তী দুই বা একটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হবে বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিতে পারত। এতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হতো। অন্যদিকে সরকার শুরু থেকেই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমে বিরোধীদলকে দূরে ঠেলে না দিয়ে এবং তাদের উপর দমন- পীড়নের মাধ্যমে নির্মূল করার প্রক্রিয়া অবলম্বন না করত এবং তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দিত, তবে রাজনৈতিক পরিবেশ সহনশীল হয়ে উঠত। এর কোনটিই না হওয়ার ফলে বর্তমানে মন্ত্রী-এমপিরা তাদের অধীনে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, তা সফল হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একদিকে প্রধান বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো, মিটিং-মিছিল করতে না দেয়াসহ দলন-পীড়নে কোনঠাসা করে ফেলা, অন্যদিকে নির্বাচনের আহবান এক ধরনের প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এখানে সরকারের গোয়ার্তুমিই প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক সরকার সমর্থক বিভিন্ন টক শোতে বলছেন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোন না কোন সময় নির্বাচন শুরু করতেই হবে। তারা উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেম টেনে আনছেন। তারা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন না, ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে নির্বাচন করতে হলে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন, সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহবস্থান নিশ্চিত করা জরুরী। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন করে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয় না। সেখানে সরকার ও বিরোধী দলের মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও পারস্পরিক সহবস্থান ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয় না। তারা শুধু দল ও তার নেতা-কর্মীদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে না। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাকে দেশপ্রেমিক বলা হয় না বা দপ্তরবিহীন হয়েও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেখা যায় না। তারা দেশের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে দলকে নয়, দেশকে প্রাধান্য দেয়। আমাদের সরকারের মধ্যে এ চিন্তার অনুশীলন হতে দেখা যায় না। এ কারণেই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সরকারের মনে যদি এ শুভবুদ্ধির উদয় হয়, বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার জন্য তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে হয়রানীর জন্য দেয়া মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি এবং বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দেয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হওয়া সম্ভব। তবে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের যে কঠোর মনোভাব, তাতে এমন আশা করা এখন পর্যন্ত অবান্তর। আবার বিগত প্রায় দশ বছর ধরে বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীন দল যে আচরণ করেছে, তাতে তাদের মনের ক্ষোভ দ্রæত নিরসন হবে এবং তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, এমন আশা করাও কঠিন। যেমনটি বর্তমান সরকারের নেতা-কর্মীরাও বিগত জোট সরকারের আচরণের কথা এখনও স্মৃতিচারণ করেন। তবে কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী হয় না, যদি সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের শুভবুদ্ধির উদয় হয় এবং সমাধানে এগিয়ে আসে। এজন্য রাজনীতিতে শীর্ষ নেতাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং নিয়মিত কথা বলার চর্চা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কথা ও আলাপ-আলোচনা হলে সমস্যার সমাধান দ্রুত হয়। রাজনীতিতে ক্ষীণস্বরে হলেও সংলাপের বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একবার বলেন বিএনপির সাথে সংলাপ হতে পারে। আবার পর মুহূর্তেই তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন প্রয়োজন নেই। তবে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বরাবরই সংলাপের বিষয়ে আগ্রহী। তাদের এই আগ্রহকে সম্ভবত সরকার বিএনপির দুর্বলতা ভাবছে। এ কারণেই সংলাপের কথা বলেই তা বাতিল করে দিচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সংঘাত-সংর্ঘষ এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই। তাদের মতে, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সব সময়ই সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপকে বৃহৎ পরিসরে দেখা উচিত। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকার যদি শুরু থেকেই আন্তরিকভাবে বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেত, তবে রাজনৈতিক এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হতো না।
তিন.
রাজনীতি তো বটেই যে কোনো সংঘাত, সমস্যায় কথা বলা জরুরী। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতের বিরোধিতা থাকলেও দেশের স্বার্থে পারস্পরিক সমঝোতা থাকা দরকার। দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে বিরোধ লেগেই আছে। এক দল আরেক দলকে ঘায়েল করার জন্য হেন কোনো চেষ্টা নেই, যা করে নাই। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যেন বিএনপিকে সহ্যই করতে পারে না। ফলে রাজনীতিতে বরাবরই এক ধরনের উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারই যথেষ্ট নয়, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সংস্কার প্রয়োজন। এই উদ্যোগ ও মানসিকতা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সে সরকার প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে দলীয়করণ করে। প্রশাসনকে প্রশাসনের মতো চলতে দেয় না। দলীয় আনুগত্যের নিরিখে প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার প্রশাসনকে যেভাবে দলীয়করণ করেছে, অতীতে এমন দলীয়করণের নজির নেই। প্রশাসন আর দল এক করে ফেলা হয়েছে। প্রশাসনে কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মীকে পর্যন্ত দলীয় লোকের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। এমনকি যে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা, তাকেও ক্ষমতাসীন দলের কথামতো চলতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল বাদে বাকি সব রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছে, তখন দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের কথামতোই ইভিএম ব্যবহারে পাগলপারা হয়ে উঠেছে। যদিও একজন নির্বাচন কমিশনার এর বিরোধিতা করে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তার এই মতামত উপেক্ষা করেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যরা ইভিএমের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যরা সরকারের মনোভাবকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলও তাদের এ সিদ্ধান্তকে বাহবা দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন দলীয়করণ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন মুখে যতই নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলুক না কেন, তার কাজে-কর্মে তার প্রতিফলন খুব কমই ঘটছে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে শুনসান নীরবতার মাধ্যমে যে ধরনের অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে কোনো ধরনের কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি। তারা পুরোপুরি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের মর্জি মাফিক নির্বাচনগুলো করেছে। তার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। এ পরিস্থিতি যদি বজায় থাকে তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তা একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তো আরও ভাল বুঝছে। এই বোঝাবুঝি থেকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা অপরিহার্য। দলীয় আনুগত্যের প্রশাসন দিয়ে কোনভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। শুধু প্রশাসন নয়, নির্বাচন কমিশনকেও দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা প্রয়োজন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্দলীয় বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন হোক, বর্তমান সরকারের হাতেই থাকছে নির্বাচনের চাবিকাঠি। নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যে প্রশাসনকে সরকারের অনুগতদের নিয়ে সাজিয়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকারের পছন্দ অনুযায়ী পথে চলছে নির্বাচন কমিশন।
চার.
নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার এবং প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই, তা ইতোমধ্যে দেশবাসী দেখেছেন। সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। যদি তাই হতো, তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ’৯৬ এবং ২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি ও জোট সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো। তারা জানত, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সাজানো প্রশাসন দিয়ে কোনভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকার তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়েছিল বলেই সেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে, প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক এমন কোন আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়নি যে, একে অন্যের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। ক্ষমতাসীন সরকার যতই বলুক, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসনের উপর কোন হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা হবে না, তারা রুটিন ওয়ার্ক করবে- তাদের এ কথা সচেতন মহলে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বর্তমান প্রশাসন যেরূপে দলীয়করণকৃত এবং একপেশে অবস্থায় রয়েছে, তাতে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সরকারি দলের পক্ষে কাজ করবে। দলের প্রতি আনুগত্যের বাইরে দলীয় কর্মকর্তাদের কাজ না করাই স্বাভাবিক। এ বাস্তবতায় নির্দলীয় ও দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।