পবিত্র লাইলাতুল বরাত
![img_img-1719108356](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678112525_editorial-inq.jpg)
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এখন কোটিপতিদের ক্লাব বলে যতই পরিচিত হোক না কেন, একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এর ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের ভাবনার অন্ত নাই। বর্তমান সংসদ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সে বিষয়ে কোনো কথা রাজপথে-জনসমাবেশে বলা যায় না। বললে ক্ষেত্র বিশেষে জানমালের অনিরাপত্তার সম্মুখীন হতে হয়। এই সংসদের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতাসীন তার বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলা নিরাপদ নয়। সরকার অসহিষ্ণু ও মারমুখী। সরকারের প্রতিপক্ষদের সভা-সমাবেশ হলেই ভাংচুর, পুলিশের পারমিশন নাই এ অজুহাতে লাঠিচার্জ বা গ্রেফতার, এমনকি সরকারের ভিন্নমতের ৫/১০ জন একত্রিত হলেই নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার এবং সভা না করলেও কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ইত্যাদি অতি সাধারণ ব্যাপার। অনেকের বিশেষ কোন কথা শুনলে মাথার চুল দাঁড়িয়ে যায়, যাদের মাথার চুল প্রায় নেই তাদেরও। প্রতিপক্ষের সমালোচনা সহ্য করা গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। সরকার বিরোধী কথা বললে সরকার কতটুকু সহ্য করছে তা কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকারীদের প্রতি আচরণ থেকেই অনুমান করা যায়।
চলতি বছরের অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঘরে-বাইরে সকল সভাতেই তার দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। আর শরীক দল অর্থাৎ দৃশ্যমান শরীকদল এরশাদ ভোটের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। কিন্তু যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা স্বত্তে¡ও বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এখনো প্রকাশ করেনি। এর যৌক্তিক কারণ তিনটি। যথা: (১) ঠুনকো মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন কারারুদ্ধ, (২) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফিরতে পারছেন না ও (৩) বিএনপি’ই প্রথম ঘোষণা দিয়েছে যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সে জাতীয় নির্বাচনে যাবে না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। এ নিয়ে রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজে অনেক বিতর্ক থাকলেও এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন ইতোপূর্বে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যেভাবে পদলেহনে অভ্যস্ত, শুধুমাত্র এই পদলেহন সংস্কৃতির কারণে এদেশে কোন দিনই দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। পূর্বে যে দাবিটি ছিল শুধুমাত্র বিএনপি তথা ২০ দলের এখন বিষয়টি নিয়ে দাবি তুলেছেন সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শুধুমাত্র সরকারের নিকট যারা নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছে তারা ছাড়া। সরকারের সাথে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, জাতীয় পার্টি ছাড়া যাদের মাঠে কোন তৎপরতা দেখা যায় না। তবে দলীয় প্রধানরা রাজনীতিতে সক্রিয় এবং লক্ষণে এটাও মনে হয় যে, দিনে দিনে তারা মতিয়া চৌধুরীর মতো আওয়ামী লীগের সাথে বিলীন হয়ে যাবেন। মিসেস চৌধুরী এক সময়ে আওয়ামী লীগ তথা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতির কঠোর সমালোচক হয়েও এখন সরকারের প্রথম সারির নেতাদের পর্যায়ে রয়েছেন। সরকারের বাইরে যারা (ড. কামাল, মান্না, রব, কাদের সিদ্দিকী) এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছেন। তাদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কারো ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। কারণ তারা এক সময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন যখন ইনু, মেনন, মতিয়ারা ছিলেন আওয়ামী লীগের চরম সমালোচক।
একতরফা নির্বাচন এবং আসন্ন নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে করার জন্য সরকার সংবিধানকে ব্যবহার করছে। মনে হচ্ছে, সরকার সংবিধান ছাড়া কিছু বুঝে না এবং সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণও সরবে না। বিনা যুদ্ধে মেদেনীর সূচাগ্র পরিমাণ ভূমি ছেড়ে না দেওয়ার মতোই সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করার দীপ্ত শপথ বাক্য বার বার পাঠ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল আইউব ও জেনারেল ইয়াহিয়ার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ শুনেছি। তখন শুনেছি যে, জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। এখনো সেই একই ভাষণ শুনছি। অর্থাৎ সংবিধানে যা আছে সে মোতাবেকই রাষ্ট্র পরিচালনা বা ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। অতীতে জনতার দাবির মুখে সশস্ত্র জেনারেলদের সংবিধান রক্ষা করার শপথ টিকেনি। জনতার দাবির মুখে রাষ্ট্র পর্যন্ত খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে। সেখানে নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে সংবিধানের দোহাই তো একটি অজুহাত মাত্র। ইতোমধ্যে সংবিধান ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে।
সংবিধান কী? সংবিধান কি শুধুমাত্র একটি ছাপানো বই? না কি এটা একটি স্বর্গীয় বাণী যা ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না(!) অনেক রাষ্ট্রেই লিখিত সংবিধান নেই, তথাপিও এই সংবিধানই গণ মানুষের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ, যদি সংবিধানকে সঠিক অর্থে ব্যবহার করা হয়। সংবিধান নাগরিকদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। একদিকে সরকার জনগণের মুখ স্তব্ধ করার জন্য সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার যেমন- সভা-সমাবেশ করার অধিকার, মুক্তচিন্তার অধিকার, রাজনৈতিক সংগঠন করার অধিকার ইত্যাদির টুঁটি চেপে ধরছে, অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম ও দৃঢ় করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যার যার সুবিধামত সংবিধানের দোহাই প্রদান করা একটি সস্তা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংবিধান ক্ষমতাসীনদের ছেলের হাতে মোয়া হতে পারে না। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনই সংবিধান। প্লেটো তার প্রণীত রিপাবলিক বইতে উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্র একটি শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত হবে। অর্থাৎ দেশ শাসন বা প্রজাদের শাসন করার জন্য একটি গোষ্ঠী থাকবে। প্লেটোর এই সংজ্ঞা উন্মুক্ত গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তারই ধারাবাহিকতায় হিটলার একটি নাৎসী বাহিনী গঠন করেছিলেন যাদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে, এমনকি গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে পর্যন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ব্রিটিশ যে আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেছিল বর্তমান স্বাধীন দেশে এখনো তা অব্যাহত আছে। শাসকগোষ্ঠী আমলাদের দ্বারা তাদের ইচ্ছা মাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এতো হাঁক-ডাক করে সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কোন আমলাকে সরকারের অনুমতি ব্যতীত গ্রেফতার করা যাবে না। এতে নাৎসী বাহিনীর মতই একটি শাসক শ্রেণি তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যারা আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে। দুদকের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে দুদককে করায়ত্ত করেছে সরকার। এমতাবস্থায়, সরকারের দুর্নীতি সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রকাশ পেলেও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের মত রিমান্ড বা জিজ্ঞাসাবাদের কোন সুযোগ দুদকের আর থাকবে না। এটা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন সরকারের পুরাপুরি আজ্ঞাবাহ থাকার একদিকে পুরষ্কার, অন্যদিকে নির্ভয়ে চলার নিশ্চয়তা প্রদান। যে সকল রাষ্ট্র এখনো রাজতান্ত্রিক, অর্থাৎ রাজাই বিচার, আইন ও শাসনসহ সকল ক্ষমতার উৎস এবং রাজার (করহম) উত্তরাধিকারই রাজা, যেখানে গণমানুষের মতামতের প্রয়োজন হয় না এবং যেখানে মানুষ কাজ করবে আর বেতন পাবে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার আলোচনা/সমালোচনা করতে পারবে না- তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যে রাষ্ট্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে সে রাষ্ট্রে সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না, উচিৎও নয়। কিন্তু এ স্বেচ্ছাচারিতা সম্ভব হচ্ছে এ কারণে যে, দেশে রাজনীতি নেই। রাজনীতি হয়ে পড়েছে একটি পণ্যসামগ্রীর মতো যা অর্থের বিনিময়ে এখন ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। পূর্বে সমাজের বিবেকমান মানুষ যারা নীতিকে বিসর্জন দেননি, অর্থের বিনিময়ে মাথা বিক্রি করেননি সে সকল ত্যাগী মানুষ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো, কিন্তু জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, এখন ব্যাংক লুটেরা, ভূমিদস্যু, সুবিধাভোগী ও সুযোগ সন্ধানীদের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। ফলে এ দেশ ও জাতি রাজনীতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলি পাল্টাপাল্টি অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য ভূমিদস্যু ও ব্যাংক লুটেরাদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে। রাজনীতিতে ত্যাগী মাঠকর্মীদের স্থান বেদখল হয়ে পড়ায় রাজপথের রাজনীতি এখন চলে গেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। ফলে অপশাসন জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের বুকের উপর চেপে বসেছে। এ জন্যই আবারো একতরফা আরেকটি নির্বাচনের কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না, যদি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।