পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গুজব স¤প্রতিককালে সর্বাধিক অলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে দেশে। অবশ্য গুজবের উৎপত্তি আদিকালে। এর ব্যবহার মাঝে-মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। তবে গুজবের ব্যবহার বর্তমানের মতো এত ব্যাপক হয়নি এর আগে। আর এর দুর্বার বিস্তৃতি ঘটেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। শিশুদের অরাজনৈতিক, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনটির সুফল পাওয়া যাবে কি-না তা নিশ্চিত নয়। কেননা, আন্দোলনের পরও পরিবহন খাতের অবস্থা যা ছিল, তাই-ই রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে একটি বাস ধাক্কা দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সে ক্ষেত্রে অন্য গাড়ি বা সাধারণ মানুষের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল অব্যাহতই আছে। যা’হোক, আন্দোলনটি শেষাবধি কলঙ্কিত হয়েছে। আর তা করেছে বুড়া-হাবড়াদের কূ-রাজনীতি। এই রাজনীতি থেকেই গুজবের জন্ম, যা পর্যবেসিত হয়ে পড়েছে সরকার বনাম সরকারবিরোধী হিসেবে। সরকারবিরোধী গুজবকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে এর সাথে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাগার, চরিত্র হনন, মহা-আতংক ইত্যাদি হয়েছে ও হচ্ছে। যদিও রাষ্ট্রবিরোধী আর সরকারবিরোধী কর্ম এক বিষয় নয়। সরকারবিরোধী কর্ম বিশ্বের সব দেশেই হয় এবং তা প্রায় সময়ই। কিন্তু কোথাও তাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে সংশ্লিষ্টদের দমন-পীড়ন করা হয় না। আমাদের দেশে তা করা হয়। এতে সর্বসাধারণের কষ্টার্জিত অর্থে লালিত সরকারি লোকজনের অনেকেই অতি-উৎসাহী হয়ে নানা কর্ম করে, যা দলীয়করণের কুফল! যা’হোক, গুজব নিয়েও মহা-ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যেমন: সরকারবিরোধী গুজব সৃষ্টিকারীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা হচ্ছে। আর সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে গুজব সৃষ্টিকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তারা বীরের মতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা শরীক হয়েছে, তাদের মামলা, হামলা ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়া হয়েছে। আর যারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যা’হোক, এই গুজব দমন করার জন্য কয়েকদিন ইন্টারনেটের গতি অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এখন শোনা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর অভিমত স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হলে ফেসবুকসহ যে কোন কিছু বন্ধ করতে হবে’। তাই যদি হয়, তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশের কী হবে? ইতোমধ্যেই আলোকচিত্রী, অধ্যাপক ড. শহিদুল আলমের নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিকরণ হয়ে গেছে। এখানেই শেষ নয়, শিশুদের উপর আক্রমণের ব্যাপারে জাতি সংঘ, সেভ দ্য সিল-ড্রেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের উপর আক্রমণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়েছে। সরকার তাদের বিজ্ঞপ্তিসমূহ প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। অপরদিকে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপর আক্রমণকারীরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। এসবের পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে শংকা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের উপর আক্রমণের বিষয়টি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখন কী করে বসেন তা প্রেডিক্ট করা দুরূহ ব্যাপার। তাই তিনি আনপ্রেডিক্টটেবল পার্সন বলে বিশ্বে খ্যাত হয়েছেন। উপরন্তু তিনি যখন তখন যে সে দেশের উপর অবরোধ আরোপ করে বিশ্বের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে ফেলছেন। এই অবস্থায় যদি ট্রাম্পের খড়গ বাংলাদেশের উপর পড়ে, তাহলে কী তা আমরা মোকাবেলা করতে পারবো? চীন সরকার কিন্তু আমেরিকার অবরোধের পরিণতি নিয়ে তার দেশবাসীকে হুঁশিয়ারি জানিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো ও ইরান গলদঘর্ম হয়ে পড়েছে। এ দেশগুলো হয়তো কিছুদিন ট্রাম্পের অবরোধের ধকল সামলাতে পারবে। কিন্তু আমরা? আমাদের তো রোহিঙ্গা সংকট নিয়েই নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে। সে অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট সংকট যদি দেখা দেয়, তাহলে কি আমরা তা মোকাবিলা করতে পারবো?
গুজবের ন্যায় ভয়ানক ক্ষতিকারক হচ্ছে মিথ্যাচার। এ ক্ষেত্রেও একই চিত্র। যেমন: সরকারবিরোধী মিথ্যাচারকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেওয়া হচ্ছে। আর সরকারের বিপক্ষদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারকে বাহবা দেওয়া হচ্ছে। যেমন: স¤প্রতি এক দৈনিকে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল যে, অমুকের সঙ্গে তমুকের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। উক্ত বৈঠকের দিন, ক্ষণ ও স্থানও নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছিল। উপরন্তু উক্ত খবরের উপর ভিত্তি করে টিভিতে টকশো পর্যন্ত হয়েছিল। তাতে তমুকের চৌদ্দগোষ্ঠী নিপাত করা হয়েছিল গতানুগতিক অনুষ্ঠানের মতোই। কিন্তু পরে দেখা গেল উক্ত খবর ভুয়া, ডাহা মিথ্যা। কিন্তু ইতোমধ্যেই তমুকের চরিত্র কালিমালিপ্ত হয়েছে, যা মানহানিকর। তবুও উক্ত মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু উক্ত খবরটি যদি সরকারের বিরুদ্ধে হতো, তাহলে কী হতো? নিশ্চয় নানা শাস্তি নেমে আসত। তদ্রæপ শিশুদের আন্দোলন সমাপ্তির পরপরই এক দৈনিকে কতিপয় সন্ত্রাসীর বিশাল রামদা নিয়ে মানুষকে ধেয়ে যাওয়ার ছবি দিয়ে বলা হলো, এরা তমুক দলের লোক। এরা শিশু আন্দোলনে ঢুকে পড়ে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ছবিটি সা¤প্রতিক সময়ের নয়, কয়েক বছর আগের। তাও অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত ছবি। তাই বাদ প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। ফলে ছবিটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই তমুকের ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। কারণ, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে উক্ত ছবি। তবুও উক্ত মিথ্যাচারের কোন বিচার হয়নি। অপরদিকে, জঙ্গী দমনকালে জঙ্গীদের সাথে কিছু নিরীহ, নিরপরাধ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে ধরে জঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাগারে প্রেরণ ইত্যাদিও করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অনেকেই নির্দোষ বলে প্রমাণিত হয়ে অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছে আদালতে কিংবা তদন্তে।
তথ্য গোপন করাও অপরাধ। তবুও এ ক্ষেত্রে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা চলছে। তাই গুজবের মতো তথ্য গোপনের বিষয়টিও সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে হেলমেট বাহিনীর বিষয়টি। শিশুদের আন্দোলনের সময় পুলিশের সাথে বেশ কিছু মানুষ হেলমেট পরে আন্দোলনকারীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। অথচ পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়নি। এমনকি গ্রেফতার, রিমান্ড ইত্যাদি করা হয়নি। বরং শান্তিপূর্ণ শিশুদের উপর কোথাও কোথাও পুলিশ আক্রমণ চালিয়েছে। বহু সাংবাদিককে আক্রমণ করে আহত করেছে হেলমেট বাহিনী। পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি। দেশি মিডিয়া তাদেরকে দুর্বৃত্ত, বহিরাগত ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করেছে। অথচ বিদেশি মিডিয়া হেলমেটধারীদের নাম, পরিচয় ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। তাহলে কি দেশি মিডিয়া তাদের পরিচয় জানে না? নিশ্চয় জানে। জেনে-শুনেই তাদের পরিচয় গোপন করেছে। এটা তথ্য গোপন না আত্মসমর্পণ? স্মরণীয় যে, সাংবাদিকদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এমনকি অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনও। এ ব্যাপারে ভোয়ার খবরে প্রকাশ, ‘সাংবাদিকদের তিনটি আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের দ্রæত মুক্তির পাশাপাশি সংবাদকর্মীদের ওপর সহিংসতা বন্ধেরও দাবি জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্যে করে লেখা এক বার্তায় ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটের হেড অব অ্যাডভোকেসি রবি প্রাসাদ স¤প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর সংগ্রহরত সাংবাদিকদের ওপর বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনার বিষয়ে গভীর উদ্বেগে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে সেসব হামলার কিছু পরিচালিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোক এবং পুলিশের দ্বারা। একই বার্তায় আইপিআই আটক আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব অভিযোগ তুলে নিতে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো পদক্ষেপ কামনা করে। অপর এক যৌথ বিবৃতিতে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট এবং সাউথ এশিয়া মিডিয়া সলি-ডারিটি নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে স¤প্রতি আন্দোলন চলাকালে সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার দাবিও জানানো হয়েছে। এদিকে, শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ কর্মীরা সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানব বন্ধন করেছে।’ এর পরও সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি! সবশেষে আর একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য: সত্য প্রকাশ হলে, গুজব ছড়ায় না, ছড়ালেও তা কেউ বিশ্বাস করে না। তদ্রæপ অবস্থা মিথ্যার ক্ষেত্রেও। তাই সত্য প্রকাশ পেলেই গুজব, মিথ্যা সব বন্ধ হয়ে যাবে, আর না হলে যা হবার তাই-ই হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।