পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কানাডার জাতীয় গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণা থেকে জানা যায়, গুজব ছড়ানোর প্রবণতা মানুষের প্রবৃত্তিতেই রয়েছে। গুজবের এই প্রবৃত্তিগত বিষয়টি শনাক্তকরণের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এক বিশেষ ধরনের পরিমাপকযন্ত্র ব্যবহার করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ধরন অনুযায়ী সত্য খবর মানুষকে আশান্বিত, আনন্দিত ও বেদনাহত করলেও মিথ্যা খবর বা গুজব মানুষের মধ্যে বিস্ময় ও বিতৃষ্ণার মতো তীব্র আবেগ তৈরি করে।
গুজব হলো জনসাধারণের সম্পর্কিত যেকোনো ঘটনা, বিষয় বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোনো বর্ণনা বা গল্প। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি, যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে গুজব বিষয়টি আমাদের খুব বেশি করে ভাবাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আরও আধুনিক ও যৌক্তিক হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টোটি দেখা যাচ্ছে। কোনো একটি সংবাদ বা তথ্যের যাচাই-বাছাই ছাড়াই মানুষ সেটাকে বিশ্বাস করে ফেলছে। পরবর্তী সময়ে সেটি, মানুষ থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হয়ে ব্যাপকতা লাভ করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে সবাইকে কোনো না কোনোভাবে বহন করতে হচ্ছে।
আমেরিকার এমআইটির গবেষকরা গুজব-সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ ফলাফল বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশ করেছেন। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও এ ধরনের অন্যান্য অনলাইন সাইট ব্যবহার করে এই গুজব ছড়াচ্ছে। গবেষকরা তথ্য ও উপাত্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, টুইটারে নির্ভুল খবরের চেয়ে গুজব কমপক্ষে ছয় গুণ বেশি দ্রুত ছড়ায় এবং বেশি শেয়ার হয়। গবেষণার নমুনা পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা দেখেছেন, যেকোনো সত্য ঘটনা খুব কমই এক হাজারবারের বেশি শেয়ার হয়েছে। কিন্তু শীর্ষ গুজবগুলো প্রায় সবক্ষেত্রেই লাখের ওপরে শেয়ার হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে গুজব টুইটারে বেশি ছড়ালেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে টুইটারের চেয়ে ফেসবুকে গুজব বেশি ছড়ায়। গবেষকরা মানুষের এ ধরনের নেতিবাচক প্রবণতাকে ‘ডিজাস্টার ওয়ার্ড’ হিসেবে দেখছেন। এমআইটির স্লোয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক সিনান আরাল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, হতাশার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষই গুজব বেশি ছড়ায় এবং এর প্রভাব বেশি। কেন সাধারণ মানুষ গুজব ছড়ানোতে আসক্ত হচ্ছে এবং এটি কীভাবে রোধ করা যায়, সেটি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
প্রত্যেক মানুষের কোনো একটি বিষয় বিচার ও বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা থাকে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, মানুষ যেন ততই নিজের ব্যক্তিসত্তার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে কোনো না কোনো গোষ্ঠী, দল, দর্শন, নীতি ও আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। এতে করে মানুষের যৌক্তিক চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ধারণা ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এ সময়ে এসে মানুষ একে অন্যকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। মানুষে মানুষে বিশ্বাসের জায়গায় অবিশ্বাস জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষ বাস্তবতার চেয়ে তার আবেগ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। এর ফলে মানুষ কোনো একটি বিষয় বা ঘটনা মিথ্যা ও গুজব হিসেবে জানলেও সেটি তার বলয়ের স্বার্থ রক্ষায় সত্য বলে প্রচার করছে।
বাংলাদেশে এখন বহু মানুষের হাতে মোবাইল থাকার ফলে সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে যাওয়ার আশংকা বেশি তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অনেক উদাহরণও রয়েছে। যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তামান্না তানজিনা দেখতে পান তার ফেসবুক পাতা জুড়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে এমন ভুয়া খবরে সয়লাব। শুরুতে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব না দিলেও পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে তা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়াতে থাকে, এ বিষয়ে গুজব প্রতিরোধ এবং বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টিকে গুজব বলে চিহ্নিত করে বিবৃতি দেয়া হয়, যা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
অন্যের অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে কনটেইজন বা সংক্রমিত হওয়া বলা হয়ে থাকে। এটি অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। এর মাধ্যমে মানুষের যে আচরণগত পরিবর্তন ঘটে, তা তাকে গুজব বা মিথ্যা খবর প্রচারণার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই ধরনের আচরণকে ‘হোমোফিলি’ বলা হয়। জিআইজেএনের বিশ্লেষণে ছবিতে কারসাজি, ভুয়া ভিডিও, বিকৃতভাবে সত্যকে উপস্থাপন, নকল ও কাল্পনিক বক্তব্য, গণমাধ্যমের অপব্যবহার ও তথ্য বিকৃতি এই ছয়টি উপাদানকে গুজব ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আশার কথা, এই মাধ্যমগুলোরও উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব। ছবিতে কারসাজি যাচাই করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুগল সার্চের মাধ্যমে ছবির উৎস বের করা সম্ভব হয়না। সে ক্ষেত্রে টিআই নামের আরেক ধরনের রিভার্স সার্চ টুল ব্যবহার করা যেতে পারে। বাইডু, ইয়ানডেকস ও ফটোফরেনসিকস ওয়েবসাইটের এরোর লেভেল অ্যানালিসিস প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ছবির এডিট করা অংশটি শনাক্ত করা সম্ভব। ভুয়া ভিডিও শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ইউটিউব ডেটাভিউয়ার নামের ওয়েবসাইটটির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ভিডিও, ডেইলিমোশন, লাইভলিক বা ড্রপবক্সের ভুয়া বা এডিটকৃত ভিডিও যাচাইয়ের জন্য ইনভিড রিভার্স সার্চ টুল বা প্লাগইন ব্যবহার করা যেতে পারে। গুগল ম্যাপস, গুগল স্ট্রিট ভিউ অপশনগুলো ব্যবহার করেও ভিডিওর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব। সত্যের বিকৃতি শনাক্তকরণের জন্য গুগল এডভান্স সার্চ ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তির যেমন কল্যাণকর দিক রয়েছে, তেমনি তার অপব্যবহার একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেও দিতে পারে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের প্রথমেই কোনো একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলে তা বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। কারণ আমাদের কোনো একটি ভুল সিদ্ধান্ত গুজব হিসেবে ছড়িয়ে পড়লে তার বিরূপ ফলাফল মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর গিয়ে পড়বে। যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। গুজব আর ভুয়া সংবাদকে উপলক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নষ্ট হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানাবিধ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
যারা ১২-১৭ বছরের কিশোর, অ্যান্ড্রয়েড ফোনের কল্যাণে তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় ব্যবহারকারী। জরিপেও সাক্ষ্য মেলে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এই বয়সগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু এদেরকে গুজব আর ভুয়া সংবাদ বিষয়ে সচেতন করার কোনো ভালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। তাদের মধ্যে গুজব বিষয়ে এবং প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে পরিবারের ভূমিকা সবার আগে। এই সাথে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা।
গুজব আর ভুয়া সংবাদ পৃথিবীতে সব সময়ই ছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এগুলো ভিন্নমাত্রা অর্জন করেছে। এখন ফেসবুকের কল্যাণে কোনো গুজব যত তাড়াতাড়ি ডালপালা মেলতে পারে এবং যত দূর অবধি উড়াল দিতে পারে, তা অকল্পনীয়। বলা হয়, এই যুগে সত্যের কোনো বিষয়গত বাস্তবতা নেই, বরং নিজ নিজ মতামত, মতাদর্শ আর মূল্যবোধ দিয়েই মানুষ নিজ নিজ ‘সত্য’ বানিয়ে তোলে। দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি কোনো ক্ষেত্রে এমন দাড়াচ্ছে যে, অমুকের সত্যের সঙ্গে তমুকের সত্যের সংঘর্ষ লাগছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে এর পাদানি হিসেবে। অথচ শক্তিশালী এ মাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
শহরের বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের গ্রামবাংলায় আছে, তাদের ঘরে ঘরেও আছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ। শিক্ষাবিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার আগেই যোগাযোগ-বিপ্লবের অপব্যবহার করে গুজবে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন। ব্যহত হচ্ছে সামাজিক সুস্থতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহারে আমাদের নিজেদেরই সচেতনভাবে সম্মিলিত প্রয়াসে এগিয়ে আসতে হবে।
ফেসবুকের পেছনে যে প্রতিষ্ঠান আছে, তার পক্ষে গুজবের এই বিশ্বব্যাপী বিস্তারকে লাগাম পরানো সহজ কাজ নয়। এত এত দেশ, এত এত ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির মধ্যে বেড়ে ওঠা লাখো গুজবের মোকাবিলা কোনো অভিন্ন নিয়ম দিয়ে করা যাবেনা। এই দিশেহারা অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে তারা এখন রাষ্ট্রের ক্ষমতা-কেন্দ্রগুলোর আশ্রয় নিচ্ছে। তথ্য বিক্রির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে পৃথিবীর বহু দেশেই ফেসবুক ক্রমে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার সহায়ক শক্তি হয়ে উঠছে। অথচ কথা ছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক আমজনতার ক্ষমতায়ন করবে! এই প্রত্যাশা থেকেই মানুষ এহেন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরেছিল। এখন এই ব্যবস্থাই যেন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন।
গুজব ছড়িয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে একটি শ্রেণী। সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা তাদের প্রধান লক্ষ্য। সময়ের সাথে গুজবের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে গুজব প্রতিরোধে কৌশল নিয়ে এখনও তেমন গবেষণা হচ্ছেনা। যদিও সরকার গুজব প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে গুজব বন্ধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইন্টারনেট কেবল বিনোদনের জায়গা নয়, জ্ঞান আহরণের জায়গাও। আবার অপরাধ সংঘটনের জায়গাও বটে। অনেকে ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই ঝঞ্ঝাটময় জীবন ছেড়েছুড়ে দিয়ে অফলাইন জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করেন। তবে ইন্টারনেট যুগে জন্মানো তরুণ-তরুণীদের পক্ষে এটা ভীষণ কঠিন। তারাতো আমাদের মতো পরিণত বয়সে এসে ইন্টারনেটে দীক্ষা নেয়নি! এ কারণে তাদের জায়গা থেকেই বুঝতে হবে ব্যাপারটা।সমস্যার সমাধানও সেভাবেই করতে হবে সবার সহযোগিতায়, সম্মিলিতভাবে।
এ ভয়াবহ সমস্যা নিরসনে সুধীজনের মতামত এবং পরামর্শ হচ্ছে, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে গুজব যেমন প্রতিরোধ করতে হবে, তেমনি গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল থেকে গুজব প্রতিরোধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সচল রাখা। আইন থাকলেও সর্বস্তরের সুধীজনকে জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য এ সংক্রামক ব্যাধি নিরসনে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। ধ্বংসাত্মক এ ব্যাধি থেকে মানব জাতির মুক্ত হতেই হবে।
লেখক : ফেলোশিপ গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।