পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গাছপালা পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গাছপালার কোনো বিকল্প নাই। বৃক্ষ ও বনভূমি বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক বেশি হয়। এর ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফসল ভালো হয়। বৃক্ষ মাটির ক্ষয় রোধ করে উর্বরাশক্তি বাড়ায়। ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে। যেখানে বড় গাছপালা থাকে, সেখানে বর্জ্রপাত কম হয়। নদী ভাঙ্গনের হার সেখানে কমে যায়। মোটকথা গাছপালা না থাকলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে উঠতো। পৃথিবী মরুভূমি হয়ে উঠতো। এর ফলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হতো। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে গাছের ভূমিকা এক অনস্বীকার্য। সহজ করে বলা যায়, বাতাসে শ্বাস নিতে না পারলে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। বাতাস থেকে আমরা অক্সিজেন নিয়ে বাঁচি। গাছপালা থেকে আমরা নির্মল অক্সিজেন পাই আর আমাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছাড়া ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গাছপালা গ্রহণ করে নিজেদের খাদ্য তৈরির মাধ্যমে আমাদেরকে রক্ষা করে।
ভারসাম্যমূলক প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য দেশের মোট ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ। তবে বেসরকারী সংস্থাগুলো বলছে, তার চেয়েও কম। কোথাও কোথাও উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯ শতাংশ। আমাদের দেশে বৃক্ষ নিধনরোধে জনসচেনতামূলক একটি স্লোগান আছে, একটি গাছ কাটলে যেন দুটি গাছ লাগানো হয়। কিন্তু সর্বত্র চলছে এর বিপরীত। যেখানে তিনটি গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে লাগানো হচ্ছে একটি গাছ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জায়গা স্বল্পতার কারণে গাছ লাগানোই হচ্ছে না। বর্তমানে শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপক হারে নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের ঘটনা ঘটছে। রেহাই পাচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার ধারের গাছগুলো।
কিছুদিন আগে নাটোরের সিংড়ায় চৌগ্রাম রাজবাড়ীতে মেহগনি, নিম, আকাশমনিসহ ১০/১৫টি গাছ নির্বিচারে কেটে পাচার করে দেওয়া হয় বলে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়। গ্রামীণ পুলিশ ও স্থানীয় এলাকাবাসীর মাধ্যমে তা জানাজানি হয়। এলাকাবাসীর মতে, ঠিকাদারের সহযোগিতায় গাছগুলো বিক্রি করে অন্যত্র নিয়ে যাবার সময় আটক করা হয়। ঠিকাদারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, চৌগ্রামে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। সেখানে নির্মাণ কাজ চলাকালে কিছু গাছ ছিলো, সেগুলো সরকারিভাবে কাটা হয়। কিন্তু বাকি গাছ কীভাবে কাটা হয় তা জানি না। এই না জানার বিষয়টি সর্বমহলে ছড়িয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের যাকেই প্রশ্ন করা হয়, তিনিই বলেন, জানি না। ভাগ্যিশ, সরকারি এসব গাছ কাটার তথ্য সামান্যতেই লোকচক্ষুর সম্মুখে এসেছিল। তা না হলে হয়তো রাজবাড়ীর শতবর্ষী অবশিষ্ট গাছগুলো কেটে সাফ করে দেওয়া হতো।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ২০১৭ সালের ঘটনা। নাটোরের উত্তরা গণভবনের (নাটোর রাজবাড়ী) ভিতরে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া এবং মরে যাওয়া দুটি আম, একটি মেহগনিসহ বেশ কিছু গাছের ডালপালা কাটার টেন্ডারের নামে লক্ষ লক্ষ টাকার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হল, এসব ঠিকাদার সরকারি গাছ কর্তনের সাহস কোথায় পায়? খবরে উঠে এসেছিল, এইসব গাছ কাটার কাজে গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা, গণবভনের তত্ত্বাবধায়ক, বন বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তারা সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। তাজা গাছ কেটে নেওয়ার দৃশ্যের কারসাজির প্রমাণ সিসি ক্যামেরায় মিলেছিল বলে রাজবাড়ীর অনেক বৃক্ষই আজ অক্ষত আছে। নতুবা সেগুলোও এতদিনে পাচার হয়ে যেত। এভাবে সরকারি বৃক্ষ কর্তন ও পাচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যতটা না আর্থিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পরিবেশগত ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
দেশজুড়ে এভাবেই প্রতিনিয়ত সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। সড়ক ও রাস্তাধারের বৃক্ষগুলো দুর্বৃত্তরা কেটে নিয়ে রাতের আঁধারে পাচার করে দিচ্ছে। অনেক সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার ধারের গাছগুলো ঠিকাদারদের মাধ্যমে অবৈধভাবে কেটে বিক্রয় করে দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমেও এসব খবর আসছে। অনেকাংশেই প্রশাসন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তারপরও স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৃক্ষ নিধন ও পাচারের প্রসঙ্গটি সর্বত্র পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে বৃক্ষ নিধন ও পাচারের কাজগুলো একটু বেশিই হচ্ছে বলে সাম্প্রতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ ৩.৬ শতাংশে পরিমাণ নেমে এসেছে। তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর আবহাওয়ায় পড়তে শুরু করে দিয়েছে। দিনের বেলা দুঃসহ গরম আর রাতে প্রচন্ড শীত অনুভূত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের এলাকা উত্তরাঞ্চলের নাটোর জেলা (নাটোর জেলার লালপুর নামক স্থান)। আর আমরা সবাই এটা জানি যে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাবের তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতার অন্যতম কারণ দেশজুড়ে এই অকাতরে বৃক্ষ নিধন। বিপরীতে পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপন না করা।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার আধিক্যতার কারণে প্রতিনিয়ত বাসস্থানের জন্য গাছপালা কাটা হচ্ছে। গাছপালা লাগানোর পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া মানুষের চলাচলের রাস্তা প্রসার ও পাকাকরণের তাগিদেও রাস্তার ধারের গাছপালা কাটা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে গাছপালার বিস্তার কমিয়ে আনলে পরিবেশের কী হবে? মানুষেরই বা কী হবে? পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু যদি বলা হয়, বৃক্ষের অপর নাম জীবন; তাহলে অনেকের কাছেই হয়তো তা অবাক লাগতে পারে। একটু গভীরভাবে বিেেশ্লষণ করলেই এর সত্যতা অনুধাবন করা যাবে। পানি ব্যতীত কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এটা সত্যি কিন্তু সেই পানির প্রধান দুটি উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপকরণ হচ্ছে অক্সিজেন; যা বৃক্ষ সরবরাহ করে। আমরা নিঃশ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা পাই বৃক্ষ হতে। কোনো কারণে বিশ্ব যদি কয়েক দিনের জন্য পানিশূন্য হয়ে যায় তাহলেও অনেক প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ এবং অন্য কোন প্রাণীই এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রাণী জগতের টিকে থাকার জন্য বৃক্ষের উপস্থিতি কতটা অনিবার্য। এসব নানা কিছু বিবেচনাপূর্বক, প্রথমত সরকারকে সরকারি বৃক্ষ নিধন ও পাচার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাড়ির আঙ্গিনার বৃক্ষসমূহ অযথা না কাটার পরামর্শ দিতে হবে। সেই সাথে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে।
লেখক: পরিবেশবাদী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।