Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইউরোপে মানবপাচার থামছে না

গ্রিসে ৬ হাজার কারাবন্দি দেশে ফেরার আতঙ্কে! আইওএম সহায়তায় দেশে ফিরছে যুবকরা

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

স্বপ্নের দেশে পৌঁছে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাসে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে শত শত নিরীহ যুবক। ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে দেয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে গ্রামাঞ্চলের নিরীহ যুবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মানবপাচারকারী দালাল চক্র। এসব দালাল চক্রের সাথে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রও জড়িত রয়েছে। ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ না জুটলেও মাসের পর মাস কারাবন্দি দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে অনেককেই।

দালাল চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে গ্রিসে গিয়ে দেশটির কারাগারগুলোতে প্রায় ৬ হাজার বাংলাদেশি যুবক দেশে ফেরার আতঙ্কে ভুগছে। গ্রিস থেকে একাধিক সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। আবার ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতেও কেউ কেউ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা আইওএম এর আর্থিক সহায়তায় লিবিয়ার কারাগার থেকে মাঝে মধ্যেই শত শত ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
বিএমইটির সূত্র অনুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে গত ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৮ জন নারী পুরুষ কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এসব প্রবাসী কর্মীরা প্রতি মাসে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে।
সাউথ আফ্রিকায় প্রবেশের চেষ্টাকালে জাম্বিয়ার সীমান্তে গ্রেফতারকৃত ৮ বাংলাদেশি যুবক ৪৫ দিন জেল খেটে রোববার বিকেলে কাতার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট (কিউ আর ৬৩৪) যোগে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছেছে। জাম্বিয়ার সোকা জেলে এখনো ৮ বাংলাদেশি যুবক দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। অনাহার অনিদ্রায় কারাবন্দি যুবকদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জাম্বিয়ার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে ভুক্তভোগি নোয়াখালির মো. নূর আলম গতকাল এসব তথ্য জানিয়েছে। জাম্বিয়ার কারাগার থেকে ফেরত আসা যুবকদের মধ্যে রয়েছে, নোয়াখালির আরাফাতা, সাকিল, ঠাকুরগাঁয়ের ফরিদ ইসলাম, বি-বাড়িয়ার রাসেল ও নরসিংদীর মোবারক।
ভুক্তভোগীরা জানায়, দালাল চক্র সাউথ আফ্রিকায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে জনপ্রতি সাড়ে ৭ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রথমে দুবাইতে ভিজিট ভিসায় নিয়ে এক মাস আটকে রাখে। পরে বহু দেনদরবারের পর তানজানিয়ায় নিয়ে পাকিস্তানী দালালের হাতে তুলে দেয়। ঐ দালাল মাইক্রো বাসযোগে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জাম্বিয়ার টুনডুমা সীমান্তে নিয়ে গেলে জাম্বিয়ার সীমান্ত প্রহরির হাতে পাকিস্তানি দালালসহ সবাই গ্রেফতার হয়। দেশটির সোকা জেলে ৪৬ দিন এবং লোসাকার জেলে ২০ দিন থাকার পর আদালতের রায়ের সাজা ও জরিমানা দিয়ে তারা মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে। সোকা জেলে এখনো ৮ বাংলাদেশি যুবক মানবেতর জীবন যাপন করছে।
দালালদের খপ্পরে পড়ে স্বপ্নের দেশে বিদেশের কারাগারে অনাহার অনিদ্রায় দিন কাটিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার আর্থিক সহায়তায় দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশি যুবকরা। গত ২১ অক্টোবর ভোরে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় লিবিয়া থেকে ১৪৩ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে দুবাই হয়ে এসব অবৈধ বাংলাদেশি লিবিয়ায় গিয়েছিল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া এসব বাংলাদেশি দীর্ঘদিন বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্প ও জেলে আটক ছিল। দেশটির বিভিন্ন কারাগারে এখনো অনেক বাংলাদেশি যুবক দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এসব ভাগ্যান্বেষীদের দেশে ফেরার তথ্য জানিয়েছে লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস।
এক বার্তায় জানানো হয়, ত্রিপলীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় আইওএম এর ভাড়াকৃত লিবিয়ার বুরাক এয়ারের একটি ফ্লাইট ত্রিপলীর মেতিগা বিমানবন্দর থেকে ১৪৩ বাংলাদেশিকে নিয়ে ২০ অক্টোবর যাত্রা করে পরের দিন ভোরে ঢাকায় অবতরণ করে। এ অভিবাসীদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত অভিবাসীও ছিলেন। দালাল চক্র এসব যুবকদের ইউরোগের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়ার প্রলোভন দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়ায় নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
লিবিয়াস্থ বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রত্যাবর্তনকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের বিদায় জানান। এ সময় তিনি ফ্লাইটটি পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং প্রত্যাবাসনকৃতদের অনুকূলে লিবিয়ার ইমিগ্রেশন অধিদফতর হতে বহির্গমন ভিসা প্রাপ্তিতে দূতাবাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বিষয়টি তাদেরকে অবহিত করেন। এ ছাড়াও তিনি ফ্লাইটটি পরিচালনায় সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অভিবাসন অধিদফতরসহ আইওএমকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
এদিকে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের আশায় গ্রিসে গিয়ে অনিয়মিতভাবে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মীরা দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে ভুগছেন। চলতি অক্টোবর মাসেও গ্রিস থেকে কয়েকটি ফ্লাইটে প্রায় ৫০ জন অনিয়মিত বাংলাদেশিকে দেশে ফেরাত পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার গ্রিস থেকে বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ গ্রিস শাখার প্রধান সমন্বায়ক আরিফ রহমান আরেফ ইনকিলাবকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এতে কারাবন্দি বাংলাদেশিরা দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে ভুগছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশটির বিভিন্ন কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রায় ৬ হাজার অনিয়মিত কর্মী রয়েছে। এরা দালালদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশের জন্য দেশটিতে এসেছিল। তিনি বলেন, দেশটিতে প্রায় ১৫ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। গ্রিসের শ্রম মন্ত্রী মি. মিতেরাকি বাংলাদেশে গিয়ে কর্মী আনার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। এতে অনিয়মিত কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। উল্লিখিত চুক্তির মাধ্যমে অদ্যাবধি একজন কর্মীও বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে আসেনি। দেশটিতে অনিয়মিত কর্মীদের বৈধকরণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশ দূতাবাসও এ ব্যাপারে কোনো সাড়া শব্দ দিচ্ছে না।
গ্রিক সরকারের তথ্য মতে, ২০১৬ সালের পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে ১৯ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। সমন্বিত পুলিশি অভিযানে ১৯ বাংলাদেশিকে আটক করে সরাসরি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর ৬ মাস পর চলতি বছরের গত জুলাই মাসে গ্রিসের মিনেদি ক্যাম্প ও সাইপ্রাস থেকে ২৭ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। এর পর অনিয়মিত বাংলাদেশিদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছিল।
গ্রিক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ অনুমতি নিয়ে দেশটিতে বসবাস করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর বাইরে অনেকে রয়েছেন যাদের বসবাসের অনুমতি নেই বা আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলো থেকে এমন অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসেডিউর্স চুক্তি হয়। এ চুক্তির আওতায় অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
গ্রিস প্রবাসী নেতা আরিফ রহমান আরেফ বলেন, দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বর্তমানে খুবই আতঙ্কে আছে, পুলিশি ধরপাকড় অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে গ্রিক সরকার। একেক দিন একেক এলাকায় পুলিশ রেড দিচ্ছে, তার কারণে এখানকার ব্যবসায়ীরাও বিপদে পড়েছে রাস্তা ঘাট ফাঁকা জনশূন্য বাঙালি এলাকাগুলো, অনেকেই দোকানপাট বিক্রি করে গ্রিস ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমরা প্রবাসীরা মনে করি এই চুক্তি প্রবাসীবান্ধব বা প্রবাসীদের স্বার্থে হয়নি, আমরা শুরুতেও দাবি জানিয়েছি এখনো দাবি করছি গ্রীসে বসবাসরত ২০ হাজার কাগজ পত্রহীন শ্রমিককে আগে বৈধ করে নেয়া হোক এবং তারপর দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হোক। গ্রিস থেকে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের (পামে) সহসভাপতি আমানুল্লাহ জানান, দালাল চক্রের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি কর্মীরা অবৈধপথে গ্রিসে এসেছে। দেশটির গ্রামাঞ্চলের কৃষি খাতেই ৮ থেকে ১০ হাজার বাংলাদেশি অনিয়মিতভাবে কাজ করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। তিনি দেশটিতে বসবাসৃত প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশিকে বৈধতা লাভের জন্য বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এছাড়া বৈধ বাংলাদেশিরা ভিসার মেয়াদ নবায়ন করতেও নানা হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব বিষয়ে গ্রিসে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিব বিশ্বজিৎ কুমার পাউলের সাথে গতকাল মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউরোপে মানবপাচার থামছে না
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ