শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
হুমায়ূন আহমেদ [১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২]। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা ভাষার হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের হুমায়ূন আহমেদ। বাঙালি জাতির হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন যখন ছিলেন পৃথিবীতে; মনে হত বাংলা ভাষার এক প্রতিভাময়, শক্তিময় এক সন্তান বেঁচে আছে; মায়ের যে কোন বিপদে সে বাড়িয়ে দেবে সহায়তার হাত। সে যখন মারা গেল, মনে হল, বাংলাভাষা আজ এক যোগ্য সন্তানকে হারাল; আজ তাকে সহায়তা করার কেউ নেই। হুমায়ূন বেঁচে থাকতে বাংলা ভাষা ছিল বর্ণময়, গন্ধময়, লাবণ্যময়। আর তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা হারিয়েছে তার লাবণ্য ও জৌঁলুস। একটি পুষ্পবৃক্ষ থেকে যেন তার একমাত্র পুষ্পটি হঠাৎ খসে পড়ল মাটিতে।
হুমায়ূন বেঁচে থাকতে একশ্রেণির পাঠক অপেক্ষায় থাকতো, কবে বেরুবে তাদের প্রিয় লেখকের নতুন বই। নতুন বইটি বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আজ সেইসকল পাঠক হারিয়ে গেছে। এখন আর তারা দল বেঁধে অন্য কোন লেখকের বই কিনতে যায় না; গেলেও হুমায়ূনের পুরোনো বইগুলোই ঘুরেফিরে কিনে নিয়ে আসে। হুমায়ূনই তাদের প্রিয় লেখক; হুমায়ূনের জায়গায় অন্য কারো স্থান নেই।
আমাদের পরম সৌভাগ্য ও গৌরবের বিষয় যে, একজন হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে জন্মেছিলেন। বাংলাভাষার এমন তুমুল জনপ্রিয়, জননন্দিত, বরেণ্য লেখক শরৎচন্দ্র ছাড়া বোধহয় আর কেউ জন্মাননি। এমনকি বলা যায়, জনপ্রিয়তার বিবেচনায় তিনি শরৎচন্দ্রকেও হার মানিয়েছেন। বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আসিফ নজরুল হুমায়ূন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁর উপন্যাস ছিল সবকিছুর মধ্যে অনন্য। মাত্র ষাট-সত্তর পাতার ছোট্ট একটা গল্পে মানুষকে বিভিন্নভাবে অভিভূত করার যে ক্ষমতা ছিল তাঁর, তা আদতেই অতুলনীয়। সামান্য বর্ণনায় চরিত্রের গভীরতা আর দৃশ্যকল্প সৃষ্টিতে তাঁর পারঙ্গমতাও ছিল অনন্য। লেখক হিসেবে তিনি একই সঙ্গে সহজাত, সহজবোধ্য ও শক্তিশালী ছিলেন। ফলে সমাজের সব স্তরের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছিল তাঁর গল্প-উপন্যাস।
তাঁর লেখা সুনীল আর শীর্ষেন্দুকে হটিয়ে দিয়েছিল, তাঁর নাটকের ছোট সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধেও চেতনার পূণর্জন্ম ঘটিয়েছিল, তাঁর প্রতি মানুষের আগ্রহ ছাপিয়ে গিয়েছিল দেশি-বিদেশি সিনেমা-তারকাদেরও।
সব অর্থেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র মেগাস্টার! [দৈনিক প্রথম আলো-২০ জুলাই, ২০১৮]
বাংলা কথাসাহিত্যের আরেক জননন্দিত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ‘সত্যিকথা বলতে কি সে আমাদের বাংলা ভাষার গর্ব। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা ভাষার যে কয়জন লেখক বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে, সে তালিকায় অনেক ওপরে স্থান করে নিয়েছে হুমায়ূন আহমেদ। এমনকি কথাসাহিত্যে তার অবস্থান শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপরে। খুব সহজেই কঠিন ভাষাকে টুকরো করে পাঠকের বোধগম্য করে তুলতো। তার লেখার গভীরতা বিশাল। অনেক সময় অতি সহজ ও প্রাণোজ্জ্বল লেখার মধ্যে দিয়েও বিজ্ঞান, দর্শন ও রসায়নের অনেক অজানা শব্দচয়ন ও বাক্যচয়ন ব্যবহার করতো। যা সমসাময়িক অন্য কোনো লেখকের লেখায় দেখা যায় না। বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় লেখক রয়েছে। কিন্তু সে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তার মধ্যে অনেক রস-জ্ঞান যেমন আছে, তেমনি অনেক বিষয়ে তার গভীর পড়াশোনার বিষয়টি বেশি ধরা পড়ে।
সে বাংলাদেশের পাঠকদের হৃদয় জয় করে পশ্চিম বাংলায়ও এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছিল। তার হিমু চরিত্রটি এখানেও তুমুল জনপ্রিয়। তার নন্দিত নরকে পড়ার পর মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বইটি খুবই ভালো লেগেছিল। এমনকি এখানকার দেশ পত্রিকায় পত্রিকায় বইটি সম্পর্কে একটি কলামও লিখি। তখন তাকে চিনতাম না। কিন্তু সে কলামটির খবর সে ঠিকই পেয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সে আমাকে বলেছিল নন্দিত নরকে নিয়ে আমিই নাকি তার সাহিত্য জীবনের প্রথম সমালোচনা করি। যা তাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। এরপর থেকেই আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হত। এপার বাংলায়ও সে সমান জনপ্রিয় ছিল। তার জনপ্রিয়তা এতোটাই ছিল যে, দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় টানা আটবছর তার উপন্যাস ছাপা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার কোনো লেখকের ভাগ্যে এই ভালোবাসা জোটেনি। এতেই প্রমাণ হয় তার ভক্তকুলের পরিধি কত বড়।’
[দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২১ জুলাই, ২০১২]
বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ সত্যি এক বিস্ময়ের নাম। বাংলা সাহিত্যে তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন এবং তুমুল জনপ্রিয়তা মাথায় নিয়ে হঠাৎ চলে গেলেন। তাঁর এ চলে যাওয়াটা ছিল খুব আকস্মিক এবং অনাকাক্সিক্ষত। তাঁর মৃত্যুতে সমস্ত দেশ স্তব্ধ হয়েছিল; ভক্তকুল গুমড়ে কেঁদে উঠেছিল; প্রিয় হারানোর বেদনায় মুষড়ে উঠেছিল। একজন লেখকের জন্য মানুষের এতো ভালোবাসা থাকতে পারে!
এই নক্ষত্র থেকে তিনি চলে গেছেন; কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে তিনি কি চলে গেছেন? তিনি রয়ে গেছেন গণমানুষের হৃদয়ে। মানুষের হৃদয় থেকে তিনি কখনও হারিয়ে যাবেন না। হারিয়ে গেলে মানুষের ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে। ভালোবাসা কি কখনও মিথ্যে হয়?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।