পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম, নবুওয়াত লাভ এবং ওফাত এ তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ থাকতেও দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) এর খেলাফত আমলে কেন ইসলামী সন বা বর্ষপঞ্জী এ তিনটির কোনো একটির স্মরণে প্রবর্তন করা হল না? প্রশ্নটি নতুন নয়। সে আমলেই দেখা দিয়েছিল, তখন রসূলুল্লাহ (সা.) এর মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছিল এবং প্রমাণ হিসেবে সামনে এসে যায় যে, খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় একাধিক ক্ষেত্রে হিজরী সন ব্যবহার করেছিলেন, যা ছিল সাহাবায়ে কেরামের নিকট অকাট্য দলিল।
বিষয়টি আরও খোলাসা করে বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে এই কথা সত্য যে, খ্রিস্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লিপিবদ্ধ করার জন্য রসূলুল্লাহ (সা.) চুক্তিপত্রের নিচে হিজরতের ৫ম বর্ষ উল্লেখ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ চুক্তি রচনাকারী ছিলেন হজরত আলী (রা.)। সম্ভবত এ কারণেই ইবনে আসাকের বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে হিজরী সনের সূচনা হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সা.) এর আমলেই।
মুসলিম মিল্লাতের বৃহত্তম ঐক্যের স্থায়ী প্রতীক চান্দ্রবর্ষপঞ্জী বা হিজরী সনের প্রবর্তক ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। তাঁর ন্যায় দূরদর্শী অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নামের সাথে ইতিহাসের এই অবিস্মরণীয় অধ্যায়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর বিস্ময়কর বিজয়মালা, শাসন বৈশিষ্ট্য, সংস্কার, উদ্ভাবন, মানবসেবা, কল্যাণ তথা কীর্তিমালা তাঁকে বিশ^ ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। শুধু ইসলামী ক্যালেন্ডার বা হিজরী সন প্রবর্তন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে হজরত উমর (রা.) এর অবদান-কীর্তিমালা মুসলিম জাতির ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করে রেখেছে। তারই প্রবর্তিত, চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরী সন ইসলামী মিল্লাতে অনুসৃত হয়ে আসছে প্রতিমুহূর্ত। এই সনের প্রবর্তকের কথা মুসলিম সমাজে স্মরণ করে থাকে।
নির্ভরযোগ্য ও বিশ^স্ত বর্ণনা মতে, মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে বৃহস্পতিবার হিজরত করেছিলেন। অতএব, এ মাস হতেই হিজরী সন আরম্ভ হওয়া উচিত ছিল কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম অভিমত প্রকাশ করেন যে, মহররম মাস হতে হিজরী নববর্ষ আরম্ভ করা অধিক যুক্তিযুক্ত। সুতরাং দুইমাস ৮ দিন পিছিয়ে দিয়ে পহেলা মহররম হতে হিজরী সনের তারিখ গণণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১০ জমাদিউল আউয়াল, বুধবার হজরত উমর (রা.) ফরমান জারি করেন যে, পহেলা মহররম হতে হিজরী সন চালু হবে। অপর বর্ণনা মতে, ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৮ হিজরীতে সাহাবীদের এক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এটা হজরত উমরের (রা.) খেলাফতের চতুর্থ বছরের ঘটনা।
অতঃপর এ সন চালু হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের সুচিন্তিত অভিমত হল, ঐ বছর ১ হিজরী ১ মহররম পড়েছিল ১৬ জুলাই ৬২২ খ্রিস্টাব্দ রোজ শুক্রবার। এটাই হচ্ছে হিজরী সন প্রবর্তনের সূচনা কাল। আরবীতে একে বলা হয়; ‘আস সানাতুল হিজরীয়া’ (হিজরী সন) এবং ‘আততাকবীমুল হিজরী’ (হিজরী ক্যালেন্ডার)। ‘তাকবীম’ বা ‘তাকভীম’ শব্দের বিকৃতিও লক্ষ করা যায়, যা বর্জনীয়।
যুগ যুগ ধরে আরবে চান্দ্রমাস প্রচলিত ছিল এবং মাসগুলোর নামও এই রূপ ছিল যথা: মহররম, সফর প্রভৃতি। বছরের শেষ মাসে হজ¦ করার প্রথাও চালু ছিল। হজরত ইবরাহীম (আ.) এবং হজরত ইসমাঈল (আ.) এর যুগ হতে আরবে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। হজে¦ সমাবেশ একটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনার্থে হয়ে থাকলেও বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও উপকৃত হতো। ব্যাপক কারবার ও সাহিত্য সমাবেশ এই সময়ে হতো। রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের আনুমানিক সোয়া তিন শতাব্দী পূর্বে আরবের লোকেরা মূর্তিপূজার সাথে পরিচিত হয় এবং এই রোগ দ্রæত আরবের ঘরে ঘরে বিস্তার লাভ করে। হজ¦ও তখন মূর্তিপূজার মেলা হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে।
চান্দ্রমাস ঋতুর অনুক‚লে ছিল না। তারা তখন দেখল যে, হজে¦র মওসুম কোনো সময় গরমে ও কোনো সময় শীতকালে আসে। সেসময় তাদের ফসল কাটার সময় হতো না এবং গবাদি পশু ক্রয় করার জন্যও পাওয়া যেত না। সম্ভবত এজন্যই তারা ইহুদীদের দেখা দেখি এই প্রথা চালু করে, দুই বা তিন বছর পর বছরে এক মাস বৃদ্ধি করতে লাগল।
সর্ব প্রথম এই প্রথা চালু করে কেননা গোত্রের ‘কালামাস’ নামক এক আরব। তারপর এইরূপ নিয়ম হয় যে, কেননা গোত্রের সর্দার হজ¦ সমাবেশে ঘোষণা করত যে, আগামী বছর কোন মাসে হজ¦ হবে এবং অতিরিক্ত ত্রয়োদশ মাসটি কোন মাসের সাথে বাড়িয়ে দেয়া হবে, এভাবে কালামাস শব্দটি ব্যক্তিগত নামের পরিবর্তে জাতীয় পদবী হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। অতঃপর নিয়ম হলো যে, দুই বছর পর্যন্ত হজ¦ জিলহজ¦ মাসে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মহররম মাসে আবার সফর মাসে, অতঃপর রবিউল আউয়াল মাসে। এমনভাবে জিলহজ¦ মাসে এসে যেত, কিন্তু এই সময় একটি বছর মাঝখানে গায়েব হয়ে যেত।
সর্বত্র এই প্রথা চালু ছিল না। আরবদের মধ্যে এটা সহ দুইটি ক্যালেন্ডার চালু ছিল। মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবের বহুপূর্ব হতেই এই দুই রকম ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। এই কারণেই ইসলামী ইতিহাসের তারিখ ও মাসগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মত পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। কোনটা ‘মক্কী’ বছরের মাস, তারিখ এবং কোনটা ‘মাদানী’ বছরের সময় তারিখ নির্ণয় করে। এই প্রথা হিজরী দশম সাল পর্যন্ত চালু ছিল। রসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ঘোষণা করেন যে, আবার জমানা সঠিক সময়ে পদার্পণ করল, অতঃপর একই ধরনের চান্দ্রমাস গণনা করা হতে থাকে। মুসলমানদের হিজরী সন রসূলুল্লাহ (সা.) এর মক্কা হতে মদীনায় পদার্পণের পরিচয় বহন করে, অর্থাৎ যে বছর তিনি হিজরত করেছিলেন, সে বছরের ১ মহররম মাস হতে প্রথম হিজরী সন গণনা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, হজরত রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম, নবুওয়াত প্রাপ্তি, এবং ওফাত- এ তিনটি তারিখ হজরত উমর (রা.) এর আহুত অধিবেশনে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু হজরত (সা.) এর জন্ম, নবুওয়াত প্রাপ্তি এমনকি ওফাতের সঠিক তারিখ নিয়েও মতভেদ থাকায় এ কয়টি তারিখ পরিত্যাক্ত হয়। হজরত উসমান (রা.), আলী (রা.) প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন। হজরত আলী (রা.) তার বক্তব্যে হিজরতের তারিখ নির্ধারণের প্রস্তাব পেশ করেন, যাতে কোন প্রকারের কারও মতভেদ ছিল না। হজরত উমর (রা.)ও তা পছন্দ করেন এবং সভায় এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ও পাস হয়ে যায়।
হিজরী ২১ সনে হজরত উমর (রা.) এর কাছে একটি চিঠি আসে, তাতে ‘শাবান’ লেখা ছিল। হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘এটা কীভাবে জানা যাবে যে এটা দিয়ে বিগত শাবান মাস কিংবা বর্তমান শাবান মাস বুঝানো হয়েছে?’ তৎক্ষণাৎ তিনি মজলিসে শুরার (উপদেষ্টা পরিষদ) সভা আহবান করেন। তাতে নেতৃস্থানীয় সকল সাহাবা যোগদান করেন এবং বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়, যার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। হজরত উমর (রা.) একটি স্থায়ী সন কায়েম করেন যা আজ পর্যন্ত কায়েম আছে এবং অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে বলবত রয়েছে। কিন্তু এই সন পরিবর্তনের কোনো ঘটনা কখনও ঘটেনি। তবে এ কথা ঠিক যে, স¤্রাট আকবরের আমলে তথাকথিত ‘এলাহী সন’ প্রবর্তন করতে গিয়ে তার যে পদচ্ছখলন হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ কথাও ঠিক যে, বিগত শতকে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার গাদ্দাফী (সঠিক উচ্চারণ কাজ্জাফী) হিজরী সন পরিবর্তনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তার দেশে তা চালুও হয়েছিল বলে জানা যায়। সে সময়কার লিবিয়ার পত্র-পত্রিকাগুলোতে তার প্রবর্তিত সনের উল্লেখ থাকতো। এ তথ্যও অনেকেরই জানা আছে। আমরা সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে জেনে রাখা উচিত যে, হিজরী সনকে উপেক্ষা করে তার স্থলে অন্য কোন সন যদি প্রবর্তনে কেউ কোনো অপপ্রয়াস চালায় তা মুসলিম উম্মাহ মেনে নেবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।