বাংলা সন ইসলামী ঐতিহ্যেরই অংশ
বাংলাসন ইসলামী ঐতিহ্যজাত। এ সনের উদ্ভাবন ঘটেছে হিজরিসন থেকে। এর উদ্ভাবন, প্রবর্তন সবই মুসলমানরা করেছে।
বাংলা সন বাংলাদেশের মানুষের একান্ত নিজস্ব সন। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই সনটি ইসলামের উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বর্ষপঞ্জি, অব্দ, দিনপঞ্জি বোঝানোর জন্য আমরা যে সন, সাল, তারিখ নিত্যদিন ব্যবহার করি এর মধ্যে সন ও তারিখ শব্দ দুটো আরবী এবং সাল শব্দটি ফারসি।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইসলামের সুদূরপ্রসারী প্রচারের সূচনা হবার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের মানুষের মধ্যে এক পরিশীলিত জীবনবোধের প্রভাব বিকশিত হয়, অবহেলিত অব্রাহ্মণ শ্রেণী ক্রমান্বয়ে মর্যাদার মসনদ লাভ করে, পঞ্জিকার ব্যবহার রাজরাজড়া আর হাতেগোনা পন্ডিতদের মধ্যে যেখানে সীমিত ছিল, সেখানে হিজরী সন এসে এটা যারা এখানে ইসলাম গ্রহণ করলেন তাদের সবার মধ্যে সমানভাবে ব্যবহ্নত হতে লাগল ইসলামের নানা ইবাদত-বন্দেগী এবং আচার-অনুষ্ঠানের কারণে। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জী বাংলাদেশ মুসলিম শাসনের পত্তন করলে হিজরী সন রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবে ব্যবহ্নত হতে থাকে। পরবর্তীকালে এই হিজরী সালকে সৌর গণনায় এনে যে নতুন সালের প্রবর্তন করা হয় সেটাই বাংলা সন।
বাংলাদেশে বাংলা নতুন বছর বা নববর্ষ পালিত হয় বোশেখ মাসের ১ তারিখে। মুঘল শাহী দরবারে নববর্ষ পালিত হতো নওরোজ নামে। পৃথিবীর আদিকাল থেকেই বর্ষ গণনায় প্রধানত দু’টি পদ্ধতি চালু আছে। সূর্যের হিসাবে যে সাল গণনা করা হয় তাকে সৌর সাল বলে। সৌর সালের মাসগুলোর ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। হিজরী সন চান্দ্র সাল হওয়ায় এর মাসগুলো ঋতুর ধার ধারে না। তাই ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সংস্পর্শে আসে হিজরী নববর্ষ। হিজরী সন একটি খাঁটি চান্দ্র সন। মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর প্রভূতি হিসাব নির্ণয় করার মননও সঞ্চারিত হয় এবং সেই মনন থেকে সূর্য পরিক্রমের হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমেরও উদ্ভব ঘটে। সূর্য পরিক্রমের হিসাবে যে বছর গণনার পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন নামে পরিচিত হয় আর চন্দ্রের পরিক্রমের হিসাবে উদ্ভাবিত সাল চান্দ্র সন নামে পরিচিত হয়।
সূর্যের নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে লাগে প্রায় তিন শ’ পঁয়ষট্টি দিন পাঁচ ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ড। একে বলা হয় সৌর বর্ষের দৈর্ঘ্য। অন্যদিকে চন্দ্রকলার হ্রাস ও বৃদ্ধিতে সময় লাগে প্রায় ঊনত্রিশ দিন বারো ঘণ্টা, যে কারণে এক চান্দ্র বছর হতে সময় লাগে প্রায় তিন শ’ চুয়ান্না দিন আট ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট।
ইসলাম সৌর ও চান্দ্র উভয় সনের গুরুত্ব দেয়। কুরআন মজীদে সূর্য ও চান্দ্র প্রসঙ্গ এনে ইরশাদ হয়েছে : সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে (সূরা র্আ রহমান : আয়াত ৫), তিনি (আল্লাহ্) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে, যা অবিরাম একই নিয়মে অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৩) আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু আরও ইরশাদ করেন : আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টি নিদর্শন, রাতের নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকপ্রদ, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পারো এবং যাতে তোমার বর্ষসংখ্যা (সন) ও হিসাব নির্ণয় করতে পারো (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ১২)।
হিজরী সন প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ‘উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মদীনায় হিজরত করে আসেন। এই হিজরতের ফলে ইসলামের ইতিহাসে বিজয়ের এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। একপর্যায়ে মুসলিমদের জন্য একটা নিজস্ব সালের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় হযরত আলী (রা.)-এর পরামর্শক্রমে হিজরতের বছর থেকে হিসাব করে ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে হিজরী সন প্রবর্তিত হয়। এই নতুন সাল প্রবর্তনের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলে হিজরী সালের প্রচলনও এখানে ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়। ৫৯৮ হিজরী মুতাবিক ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটে, যা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
হিজরী সন যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে তা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হলেও মুসলিম জীবনে এর ব্যবহার পবিত্রতার মহিমা নিয়ে অব্যাহতই থেকে গেছে। একপর্যায়ে এই হিজরী সনের গণনা পদ্ধতিকে সৌর গণনায় আনা হয় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক স্থির করার জন্য এবং তা করা হয় রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বাদশাহ্ আকবরের সময়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ মুতাবিক ৯৬৩ হিজরীতে মুঘল বাদশাহ্ আকবর তার পিতা বাদশাহ্ হুমায়ূনের ইন্তেকালে স্থলাভিষিক্ত হয়ে শাহী মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বহু সংস্কারমূলক কাজের আঞ্জাম দেন। প্রজাসাধারণের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অনুধাবন করেন যে. হিজরী সন চান্দ্র সন হওয়ায় ঋতুর সঙ্গে এর মাসগুলোর সম্পর্ক না থাকায় কয়েক বছর পরপরই প্রজাসাধারণকে ধার্যকৃত হিজরী মাসগুলোর নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে খাজনা দেয়ার ক্ষেত্রে দারুণ জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে। এই অসুবিধার একটা সঠিক সুরাহা করার লক্ষ্যে তিনি হিজরী সনের পবিত্রতা ও মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে একটি সৌর সন উদ্ভাবনের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অঙ্কবিশারদ আমীর ফতেহুল্লাহ্ সিরাজীকে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নিয়োগদান করেন। আমীর সিরাজী তদানীন্তনকালে প্রচলিত সব বর্ষপঞ্জি পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরী সনের বর্ষকে অক্ষুন্ন রেখে বাদশাহ্ আকবরের মসনদে অধিষ্ঠানের বছর ৯৬৩ হিজরীকে ৩৫৪ দিনে গণনার স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি প্রস্তাবনা বাদশাহ্র দরবারে পেশ করেন ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। ৯৬৩ হিজরী ঠিকই থাকে, শুধুমাত্র পরবর্তী বছর থেকে ৩৬৫ দিনে তা গণনায় আনায় ঋতুর সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থিত হয়ে যায়। ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দেই বাদশাহ্ আকবর হিজরী চান্দ্র সনের এই বিশেষ সৌর সনের গণনাকে অনুমোদনদান করেন এবং রাজত্বের সর্বত্র এক ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ঘোষণা দেন। এই সন ইলাহী সন, ফসলি সন প্রভৃতি নামে শাহী দরবারে পরিচিত হলেও বাদশাহ্ কর্তৃক গঠিত সুবা বাঙ্গালা বা বাংলা প্রদেশে এসে এই সন বাংলা সন নামে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়।
বাংলা সাল যে হিজরী সালেই সৌররূপ সে সম্পর্কে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী চলিষ্ণু বিদ্যাকল্পদ্রæম ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘের সুপারিশমালার প্রারম্ভেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশমালার প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছে, মুঘল আমলে বাদশাহ আকবরের সময় হিজরী সালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলন করা হয়েছিল তা থেকে বছর গণনা করতে হবে।
উক্ত সুপারিশমালায় বাংলা সালের মাসগুলো যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক দিবসের হিসাবে গণনা করা সম্ভব হয় তা ভেবে বাংলা সালের প্রথম মাস বৈশাখ থেকে বাংলা সালের পঞ্চম মাস ভাদ্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩১ দিনে হবার কথা বলা হয় এবং একইভাবে বাংলা সালের ষষ্ঠ মাস আশ্বিন থেকে দ্বাদশ মাস চৈত্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩০ দিনে হবার কথা বলা হয়। এই সুপারিশমালায় লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষ সম্পর্কে বলা হয়, লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। এই সুপারিশমালায় আরও বলা হয় যে, ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য হবে তা অধিবর্ষ বা লিপ-ইয়ার বলে গণ্য হবে।
হিজরী চান্দ্র সালকে সৌর সালের হিসাবে গণনায় এনে বাংলা সালের উদ্ভব হলেও এর প্রত্যেক মাসের যে বিভিন্ন তিথির যোগসূত্র রয়েছে তা চাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চান্দ্র মাসের হিসাবে রয়েছে ৩০টি তিথি। এই তিথিগুলো দুই পক্ষে বিভক্ত আর তা হচ্ছে শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। এই পক্ষগুলোতে রয়েছে অমাবস্যা, প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, এয়োদশী, চতুর্দশী। রয়েছে পূর্ণিমা-অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার দূর করে দিয়ে পশ্চিম দিগন্তে সাঁঝের বেলায় চিকন চাঁদ উঠে নতুন আলোর আগমনের বারতা ঘোষণা করে। তা দিনকে দিন মোটা হতে হতে গোলাকার আলোর আগমনের থালার রূপ নেয়, আসে পূর্ণিমা। বাংলা সনের মাস গণনা সৌর হিসাবে হলেও তার অবয়বজুড়ে চাঁদের যে সম্পর্ক এবং মাসগুলোর নামকরণে যে নক্ষত্ররাজির সম্পর্ক তা লক্ষণীয়।
হিজরী সনের সঙ্গে যেমন বাংলা সনের সম্পর্ক সুনিবিড়, তেমনি এই দু’টি সনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কও সুনিবিড়। বাংলা সন আমাদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
লেখক : সাবেক পরিচালক
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।