বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মুহাররম হলো হিজরী সনের প্রথম মাস। হিজরী সন মুসলমানদের সন। এ সনের হিসাব শুরু করেছে মুসলমানরা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের বছরকে ১ম হিজরী ধরে গণনা শুরু হওয়ার কারণে এ সনকে হিজরী সন বলা হয়।
এ সনের গণনা শুরু হয় হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সময়ে মুসলমানদের নিজস্ব কোনো সন ছিল না। খ্রিষ্টীয় সনের প্রচলন এর বহু আগ থেকে থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর রাযি.-এর খেলাফতকালও এভাবেই কেটে গেল। মুসলমানদের নিজস্ব সন-তারিখ ছিল না। তিনিও খ্রিষ্টীয় সনের হিসাব পছন্দ করেননি।
হযরত আবু বকর রাযি.-এর পর খলীফা হলেন হযরত উমর রাযি.। তিনি একবার ইরাকে হযরত আবু মূসা আশআরী রাযি.-এর বরাবর চিঠি লিখলেন। এ চিঠি পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। চিঠিতে যে নির্দেশ ছিল তা বাস্তবায়নের সময় তখন পার হয়ে গিয়েছিল।
চিঠিতে কোনো সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় কখন চিঠিটি লেখা হয়েছিল হযরত আবু মূসা আশআরী রাযি. তা জানতে পারলেন না। বিষয়টি নিয়ে তিনি চিন্তিত হলেন। মুসলমানদের হিসাবের জন্য একটি সনের প্রয়োজন অনুভব করলেন। এরপর তিনি এ চিঠি নিয়ে মদিনায় এলেন। হযরত উমর রাযি.-কে বিষয়টি বুঝিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি সনের প্রচলন করার প্রস্তাব করলেন।
হযরত উমর রাযি.-এর কাছেও বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ও জরুরি মনে হলো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। প্রশ্ন হলো, সনের গণনা শুরু করা হবে কখন থেকে। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব এলো। কারও প্রস্তাব ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম থেকে গণনা শুরু হোক।
যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে ইসলামের আগমন হয়েছে তাই রাসূলের জন্ম থেকে হিসাব শুরু করা হোক। কারও প্রস্তাব ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াতলাভের বছর থেকে গণনা শুরু হোক। কারও মত ছিল, রাসূলের হিজরতের বছর থেকে গণনা শুরু করা হোক। কেউ বলল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের বছর থেকে গণনা শুরু করা যেতে পারে।
হযরত উমর রাযি. সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করলেন। আলোচনা-পর্যালোচনার পর হিজরতের বছরকেই উমর রাযি. বেছে নিলেন। কারণ, এর মাধ্যমেই ইসলামের পুরোপুরি প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল। এর আগে মক্কায় সব বিধিবিধান নাজিল হয়নি। ইসলাম এখানে পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হয়নি।
নবুওয়াতের পঞ্চম বছর নামাজ ফরজ হয়। নামাজ ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নামাজের মর্যাদা অন্যান্য ইবাদতের ঊর্ধ্বে। অন্য সকল ইবাদতের বিধান আল্লাহ পাক নাজিল করেছেন হযরত জিবরাঈল আ.-এর মাধ্যমে। কিন্তু নামাজের বিধান আল্লাহ পাক দুনিয়াতে নাজিল করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে গেলেন সাত আসমানের ওপরে।
ওখানে আল্লাহ পাক সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাজের হাদিয়া দেন। তো ইসলামের এ মহান ইবাদতও মক্কায় জামাতের সঙ্গে আদায় করা সম্ভব হয়নি। কাফেররা তো স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাজ পড়তে বাধা দিয়েছে।
বুখারী শরীফে এসেছে, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা শরীফের কাছে নামাজে দাঁড়ালেন। আবু জাহেল তার সাথী-সঙ্গীসহ সেখানে বসা ছিল। রাসূলকে নামাজ পড়তে দেখে আবু জাহেল বলল, কে আছে গতকাল জবাই করা উটের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে আসবে এবং মুহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে তখন তার মাথায় রেখে দেবে?
এক লোক গিয়ে সে উটের পেটে যে থলিতে বাচ্চা থাকে তাসহ ময়লা-আবর্জনা নিয়ে এলো। রাসূল সিজদায় গেলে রাসূলের ঘাড়ের ওপর তা রেখে দিলো। ফলে রাসূল আর মাথা উঠাতে পারছিলেন না। এ অবস্থা দেখে কাফেররা হাসাহাসি করছিল।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, আমি দেখছিলাম রাসূলের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ওদের ভয়ে কিছুই করতে পারছিলাম না।
হযরত ফাতেমা রাযি.-কে গিয়ে বিষয়টি কেউ জানাল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং রাসূলের মাথা থেকে উটের নাড়িভুঁড়ি সরালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ শেষ করে তাদের ওপর বদ দুআ করলেন। রাসূলের বদ দুআ শুনে তাদের হাসাহাসি বন্ধ হয়ে গেল। তারা ভয় পেল। রাসূল বললেন, হে আল্লাহ, আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবীআ. শাইবা ইবনে রাবীআ, ওলীদ ইবনে উতবাহ, উমাইয়া ইবনে খালফ ও উকবাহ ইবনে আবী মুআইতকে ধ্বংস করুন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, ওই সত্তার শপথ, যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, রাসূল যাদের নাম নিয়েছিলেন তাদের সকলেই বদরের যুদ্ধে নির্মমভাবে নিহত হয়। -সহীহ বুখারী : ২৩৭
হিজরতের মাধ্যমেই ইসলামের প্রকাশ ঘটে পুরোপুরিভাবে এবং হিজরতেই ইসলামের জন্য মুসলমানদের সবচেয়ে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার সব ছেড়ে শুধু নিজেদের জীবন নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন।
এ জন্য হিজরতের বছরকেই বর্ষ গণনার জন্য বেছে নেয়া হয়। হযরত উমর রাযি. যখন হিজরী সনের গণনা শুরু করেন তখন রাসূলের হিজরত থেকে ১৭ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। রাসূলের হিজরতের বছরকে প্রথম হিজরী ধরে ১৭ হিজরীতে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শক্রমে হযরত উমর রাযি. মুসলমানদের হিজরী সনের সূচনা করেন।
হিজরী সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। হিজরী সন গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে। ইসলামের প্রায় সব বিধিবিধানের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। তাই চাঁদের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক এলাকার কিছু মুসলমান যদি হিসাবে রাখে তা হলে অন্য সকলের জিম্মাদারি আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই না রাখলে সকলেই ফরজ বর্জনের কারণে গোনাহগার হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।