Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাজিত কবি আল মাহমুদ

বা সা র তা সা উ ফ | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

কবিতায় আবেগ ও আতিশয্য থাকা প্রয়োজন আছে। কিন্তু আবেগ ও আতিশয্য অবদমিত হলে অনেকাংশে কাব্যরস হ্রাস পায়। আবার আবেগের বাহুল্য কবিতাকে মেদবহুল করে তোলে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, Ôpoetry is emotion recollected in tranquility.বাংলা কবিতায় আজকাল বেশ আবেগ থাকতে দেখা গেলেও Tranquility দেখা যায় না। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মৌলিক কবি। বর্তমান জীবিত থাকা কবিদের মধ্যে তার নাম পয়লা নম্বরেই উচ্চারিত হয়ে থাকে কাব্য-বোদ্ধামহলে। একটা সময় দেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সাথে আল মাহমুদের প্রতিযোগিতা হতো, সেটা পাঠক মহলে। কারো মতে, আল মাহমুদ প্রধান কবি, কারো মতে আবার শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর এখন আর কারো দ্বিমত নেই, দ্বিমত থাকার কথাও নয়। আল মাহমুদই বর্তমানে বাংলদেশের জীবিত কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি। তার ‘লোক লোকান্তর’ ‘সোনালী কাবিন’ ‘কালের কলস’ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ তাকে সেই আসন দিয়েছে। এসব কাব্যে তিনি লোকজ, গ্রামীণ পটভূমি এবং ভাবাত্মক রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগ ও কাল্পনিক বিষয়বস্তুতে যে উপমা প্রয়োগ করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। তার কবিতায় আবেগ যেমন আছে, তেমনি ঞৎধহয়ঁরষরঃু আছে। তার এই বহুমাত্রিক কাব্য নির্মাণকৌশল শুধু কাব্যই সৃষ্টি করে নাÑ তিনি আমাদের এক ধরনের গন্ধ ও অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখেন। আমরা রসনা ও স্বাদ পেয়ে যাই কবিতাগুলো পড়ে। 

অনেকে আজকাল আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দুর্বোধ্য কাব্য রচনা করে নিজেকে মস্তবড় কবি হিসেবে জাহির করতে চায়। দেখা যায় সেই কবির কবিতার ভেতরে পাঠকের প্রবেশের রাস্তা একেবারে রুদ্ধ। তাই পাঠকও সেই সব কবিতায় প্রবেশের রাস্তা না পেয়ে ফিরে যায় অন্য কোনো সহজবোধ্য কাব্য-দরোজায়। ফলে সেই কবিরা হারিয়ে যান আড়ালে-আবডালে। আল মাহমুদ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাহলে কি তিনি সহজ সরল ভাষার কবি? এ প্রশ্নের জবাবে অবলীলায় বলে দেয়া যায়Ñ না। তার কবিতার মূলে রয়েছে ফুল, পাখি, নদী চাঁদ, ঝর্ণা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং রমণীর রূপলাবণ্যমÐিত শরীর, বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখাবয়ব। তার ভাবুক মনকে নাড়া দিয়ে কবিতা লিখিয়েছে অনেক রমণী। মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে তিনি বিন্দুমাত্র বাধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ করে দিয়েছেন। কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপূর্বভাবে চিত্রায়ণ করে আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে বর্ণনা করেছেন :
‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।’
(সনেট ১০)
তিনি আরো লিখেছেন,
‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দু’টি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্র্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’
তার ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের সনেটগুলোতে উপমা আর রূপকে নারীর প্রতি পুরুষের আকাক্সক্ষা ও কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে।
কবিতা কী? কথিত আছে, ‘বাল্মীকির ক্রোঞ্চমিথুন বিয়োগজনিত শোকই ‘শ্লোক’ রূপে উৎসারিত হয়েছিল।’ কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার জন্মজঠর হচ্ছে কল্পনা ও সাধনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই ফেলেছেন, ‘কবিতা কল্পনা-লতা। সাধনার ধন।’ ইংরেজ কবি কিটস্-শেলি-মিল্টন তাদের প্রেয়সীর বিরহে লিখেছেন অনেক কবিতা। নজরুলও লিখেছেন। কালিদাস ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন প্রিয়াবিরহের বেদনা থেকে। তাহলে কি বিরহী-বিলাপ শব্দের, বাক্যে অন্তমিলে প্রকাশিত হলেই তাকে কবিতা বলে? আল মাহমুদ কবিতার পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, ‘কবিতা কী’?
কবিতা তো শৈশব স্মৃতি
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
¤øানমুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার...।’
(কবিতা এমন)
আল মাহমুদ শুধু কবিতাই লিখেননি। তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাস ও আত্মজীবনী। তিনি কবিতায় যেমন সাবলীল, গদ্যেও তেমন। বেশ ঝরঝরে তার গদ্যের ভাষাশৈলী। পড়তে গেলে ঠোঁটের আরাম হয়। পাঠক হয় মোহগ্রস্ত। তার বিখ্যাত সোনালী কাবিনসহ অন্যান্য গ্রন্থে তিনি সময় ও সমকালকে ইতিহাসের নিক্তিতে মাপতে চেয়েছেন। তুলে ধরতে চেয়েছেন সময়ের ইতিহাসকে। তার কবিতা পড়লে আমাদের মনে ধারণা জাগে, আমাদের অতীত কেমন ছিল আর কী আছে ভবিতব্য। সময় নিয়ে এত যিনি সচকিত; সেই সময়ই তাকে কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছে? তিনি একটি গদ্যে লিখেছিলেন, ‘আমি লেখক হওয়ার, কবি হওয়ার মোহে দৃঢ় বাসনা পোষণ করতাম, আর লোকে তো এখন আমাকে কবিই বলে।... আমি কবিতা লিখেছি, গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। সব মিলিয়ে সমালোচকেরা একদিন আমার বিচার করবে। আশা করি আমি সুবিচার পাব।’
আল মহমুদ এখন অস্তগামী ¤øান হয়ে আসা এক প্রহরে বাস করছেন। তার জন্য অপেক্ষা করছে নিবিড় নিশিতে ঝিঁঝির গুঞ্জন। কিন্তু এ নিয়ে তিনি ভীত নন, তিনি বরং এ ভাবনায় শিহরিত। কেননা তিনি যে কবি, এক অপরাজিত সত্তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাহিত্য


আরও
আরও পড়ুন