পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কী নৈরাজ্য বিরাজ করছে, তা তুলে ধরা হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ আর বেসরকারিতে প্রতারিত। চিকিৎসা একটি মানবিক পেশা। দুনিয়ার সর্বত্রই এ অভিধাকে মূল্য দেন চিকিৎসা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের সংবিধানে চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের একাংশ এ মানবিক পেশাকে কীভাবে দেখেন তা বরাবরই একটি প্রশ্নের বিষয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা পাওয়া আর ডুমুরের ফুল দেখা সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসার মানসম্মত সুযোগ-সুবিধা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার নামে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠলেও তার প্রায় প্রতিটির বিরুদ্ধেই রয়েছে অসততার অভিযোগ। মানবিক চেতনার বদলে মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়াই শুধু নয়, চলছে চিকিৎসার নামে নিষ্ঠুর প্রতারণা। মানবিকতার বদলে মুনাফার বিষয়টি এমনই প্রাধান্য পাচ্ছে যে, রোগীর মৃত্যুর পরও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে স্বজনদের বলা হচ্ছে, অবস্থা উন্নতির দিকে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রোগীর চিকিৎসা মানেই গাদি গাদি টাকা বিল হিসেবে আদায় করা। টাকার জন্য তারা মৃত মানুষকেও জিম্মি করতে পিছপা হচ্ছে না। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে মেঝেতে ফেলে রেখে কড়ায় গÐায় টাকা আদায় করার অভিযোগ এখন পুরনো। চাহিদা অনুুযায়ী টাকা আদায় না হলে লাশ আটকে রাখার ঘটনাও ঘটছে। দেশে আন্তর্জাতিকমানের হাসপাতাল পরিচয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেবার বদলে রোগী অথবা তার স্বজনদের পকেট ফাঁকা করাই যেন প্রায় প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসা দুনিয়াজুড়েই মানবিক পেশা হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন কল্যাণ রাষ্ট্রে এটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে নৈতিকতার অভাব থাকায় সম্পন্ন রোগীরা সাধারণ রোগের চিকিৎসায়ও দেশের কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে ভয় পান। দেশে প্রায় সব ক্ষেত্রে চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হলেও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের সততার অভাব অসংখ্য মানুষকে বিদেশমুখী হতে বাধ্য করছে। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেশে যে নৈরাজ্য চলছে তার অবসানে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে মানবিক চেতনার প্রতিস্থাপনে মুনাফাখোর মনোবৃত্তিকে সামাল দিতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
চিকিৎসা সেবামূলক পেশা। মুনাফা বা অন্য কোনো অর্জনের চেয়ে সেবাই সেখানে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। হাজার হাজার বছর ধরে চিকিৎসার এই মানবিক বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখা হয়েছে। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন ঘোরতর শত্রু পক্ষের অধিনায়ক ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ডের অসুস্থতার খবর শুনে ছদ্মবেশে তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। পরম শত্রুর বিপদে তার সেবা করাকে কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।
কালের বিবর্তনে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাণিজ্য প্রাধান্য পাওয়ায় এর মানবিক উপাদানগুলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। গত চার দশকে দেশে বিপুল সংখ্যক সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, চিকিৎসাসেবাকে মানবিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে এসব খাতের উদ্যোক্তারা ভ‚মিকা রাখবেন। বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এ ক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা পালন করলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ। রাজধানীসহ সারাদেশে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠলেও এগুলোর সেবার কোনো মানই নেই। মুনাফার জন্য এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করাকে কর্তব্য বলে ভাবেন।
সিংহভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ডাক্তার সাজিয়ে কোথাও কোথাও রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। কোথাও কোথাও ক্লিনিকের মালিক অথবা ম্যানেজার অ্যাপ্রোন পরে চিকিৎসক সেজে রোগীদের চিকিৎসা করেন এমন অভিযোগও রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অপ্রতুল। এ সুযোগে দেশজুড়ে গজিয়ে উঠেছে গত ২০ বছরে সরকার অনুমোদিত ও অননুমোদিত অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিক ব্যয়সাপেক্ষ এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ তেমন সেবা পাচ্ছে না। বরং সেবার নামে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিক অর্থ আদায়, প্রতারণা, ভুল চিকিৎসা এবং জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যর্থতার কারণে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ লোক বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেন। এ সুযোগসহ সরকারের অদক্ষতা, অবহেলা, উদাসীনতার সুযোগে মালিকরা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতা। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা করার নামেই সরকারের অনুমোদন নেয়। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ আমদানিতে সরকারি ভর্তুকিও পেয়ে থাকে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নামসর্বস্ব। সেগুলোতে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), চিকিৎসার জরুরি যন্ত্রপাতি, ওষুধ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নেই।
বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনেকের প্রয়োজনীয় ডিগ্রি নেই। তবু নামের আগে অনেক ডিগ্রির উল্লেখ থাকে। আছে ভুয়া ডিগ্রিধারীরাও। সাধারণ রোগীরা অনেক ডিগ্রি দেখে সরল মনে এসব ডাক্তারদের দেখানোর জন্য ভিড় জমায়। এ সুযোগে তারা রোগী প্রতি ফি নেন নিম্নে ৩শ’ থেকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত। এর সাথে প্যাথলজি টেস্টের নামেও চলে কমিশন বাণিজ্য। তারা রোগীকে প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য লম্বা সিøপ দিয়ে মনোনীত ক্লিনিক কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করার জন্য বলে দেন। নির্দিষ্ট প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা না করালে তারা রোগী দেখেন না। এতে প্রতিটি টেস্টের জন্য প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে ওসব চিকিৎসক ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন পেয়ে থাকেন। মূলত এসব ডাক্তার রোগীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছেন। এতে রোগীরা বিভ্রান্ত এবং শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ নৈরাজ্যের অবসানে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।