Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলতে পারে না

| প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম | আপডেট : ১২:২৫ এএম, ১০ জুলাই, ২০১৮

 চট্টগ্রাম মহানগরীর আলোচিত ম্যাক্স হাসপাতালে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালিয়েছে। এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় শিশু রাইফার মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। রাইফার মৃত্যুর পর চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরই পটভূমিতে গত রোববার র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানে গুরুতর কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করে আদালতের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই সঙ্গে ত্রæটি ও অনিয়ম সারাতে ১৫ দিনের সময় বেধে দেয়া হয়। একই দিনে মহানগরীর সিএসসিআরসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালানো হয়। সিএসসিআর হাসপাতালকে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালানোর খবর পেয়ে ‘বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতি’ বিএমএ ভবনে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় চিকিৎসা বন্ধ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। এ কর্মসূচীতে সমর্থন জানায় বিএমএ। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই মহানগরীর বেসরকারী সব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আকস্মিক এই অচলাবস্থার ফলে বেসরকারী হাসপাতালে রোগী ভর্তি, ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা, জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে রোগী ও চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার শেষ নেই। ধর্মঘটের কর্মসূচী দেয়ার সময় সব হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা এবং ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে বলে জানানো হলেও কোনো চিকিৎসাই আসলে দেয়া হচ্ছে না। 

ম্যাক্স হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অভাবের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ম্যাক্স হাসপাতালে যে অনিয়ম, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান, র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্যে সেটা উঠে এসেছে এবং জরিমানা ও ত্রæটি-অনিয়ম সারাতে সময় বেধে দেয়া থেকেও তা প্রমাণিত হয়। এরকম একটি হাসপাতালে অভিযান চালানোর প্রতিবাদে মালিক সমিতি এবং বিএমএ কিভাবে চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসা সেবা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন রয়েছে। চিকিৎসকদের অনভিজ্ঞতা ও অবহেলা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে রোগীদের ক্ষতি ও মৃত্যুর ঘটনা বলতে গেলে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে কিংবা কোনো ঘটনার জেরে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়া হয়, ধর্মঘট ডাকা হয়। একারণে রোগী ও চিকিৎসা প্রত্যাশীদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা চরমে ওঠে। চিকিৎসা নিয়ে, মানুষের জীবন নিয়ে এধরনের ছিনিমিনি খেলা মোটেই সমর্থন ও বরদাশতযোগ্য হতে পারে না। চিকিৎসকের অবহেলা ও ত্রæটির কারণে বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর ক্ষতি বা মৃত্যু হলে দায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এ দায় নেয়ার কোনো নজির নেই। বরং দায় অস্বীকার করার প্রবণতা প্রবল। দায় অস্বীকারের প্রবণতারই প্রকাশ চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়া, ধর্মঘট ডাকা। রোগী ও চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের জিম্মি করে ‘দায় মুক্তি’র এই অপচেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
চিকিৎসা পেশা বটে, তবে অন্যান্য পেশা থেকে তা পৃথক। এটা সেবামূলক পেশা। চিকিৎসা সেক্টরটিই সেবামূলক সেক্টর হিসাবে গণ্য। মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে, জীবনসংশয় নিয়ে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়,হাসপাতালে আসে। উত্তম চিকিৎসাসেবা পাওয়া তার প্রত্যাশা এবং অধিকারও বটে। চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিৎ সর্বোচ্চ মনোযোগ ও প্রচেষ্টা দিয়ে রোগীর সেবা ও সহায়তা করা। প্রত্যাশিত চিকিৎসা ও সেবা দেয়ার পরও রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এ মৃত্যু অবধারিত। এতে কারো হাত নেই। কিন্তু এমন যেন কখনোই শোনা না যায় যে, কাঙ্খিত চিকিৎসা ও সেবা না পেয়ে কিংবা অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসায় কারো মৃত্যু হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হয়, আমাদের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের মধ্যে সেবার মনোবৃত্তি নেই, পেশাদারিত্ব নেই। তারা এই নোবেল পেশাকে ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে গোটা বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থাই লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কি বড় হাসপাতাল, কি ছোট হাসপাতাল, কি ক্লিনিক, কি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সবার ক্ষেত্রেই একথা কমবেশী প্রযোজ্য। চিকিৎসাসেবা এখানে চড়া দামে কিনতে হয়। আবার চড়া দাম দিয়েও কখনো কখনো তা পাওয়া যায় না। চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ এবং যথাযথ পেশাদারিত্বের অভাবে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট অনাস্থা তৈরি রয়েছে চিকিৎসক ও বেসরকারী হাসপাতালের প্রতি। একারণেই যাদের সমর্থ আছে, তারা বিদেশে যায় চিকিৎসা নিতে। এটা দেশের ও দেশের চিকিৎসকদের জন্য অবমাননাকর। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প হতে পারেনা। এখানে বিশেষভাবে আরো বলা দরকার, ভুল চিকিৎসা বা অপচিকিৎসার কথা বলে যেমন হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে হামলা সমর্থনীয় নয়, তেমনি কোনো অজুহাতে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়াও মার্জনীয় নয়। যে কোনো হাসপাতালের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ত্রæটি-বিচ্যুতির অভিযোগে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের অভিযান চলতেই পারে। এক্ষেত্রে দেখার বিষয়, অভিযান যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে বা হয়েছে কিনা। অভিযানের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকে চিকিৎসাসেবা অচল করে দেয়া কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবন

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন