পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে একটি সড়কের পাকাকরণে খড়ের উপর কার্পেটিং করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের একজন সাইট অফিসার উপস্থিত থাকার পরও ঠিকাদারের এমন কান্ড সাধারণ মানুষের মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ঘটনাটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন ইকবালের নজরে এলে তিনি গত ২৪ মে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং রাস্তা পাকাকরণের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। উপজেলার শানখলা-দেউন্দি সড়ক পাকাকরণের কাজটি বি-বাড়িয়ার ঠিকাদার আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন চুনারুঘাট উপজেলা তাঁতীলীগের আহ্বায়ক কবির মিয়া খন্দকার। তিনি রাতের আঁধারে কাজ করার কারণে স্থানীয় মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ২৩ মে এলাকাবাসী দলবদ্ধ হয়ে রাস্তার কার্পেটিং তুলে কার্পেটের নিচে খড় দেখতে পায়। তারা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালে তিনি পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে এলজিইডি বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান বলেন, যে সমস্ত স্থানে কাজের গাফিলতি ধরা পড়েছে সেগুলো ঠিকঠাক করা হবে। তবে ঠিকাদারের এই দুর্নীতির বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না তা তিনি গণমাধ্যমকে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অপরদিকে গত ২৩ মে ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌর শহরের আমুয়াকান্দার বালিয়া মোড়ের সড়কে বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া কাদার মধ্যেই পিচ ঢেলে সংস্কারের ভিডিও এবং ছবি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আগের কয়েকদিন ওই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। আর এতে সড়কের ওপর পানি জমে যায়। এরই মধ্যে শ্রমিকরা পিচ ঢেলে রাস্তার ওপরের অংশ মসৃণ করার কাজ করছিল। সাধারণ মানুষ সেই ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করে, সেই সাথে তারা ব্যাপক ক্ষোভ জানায়। কেউ কেউ রসিকতাও করে। ফেসবুকে প্রকাশের পর গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে সড়ক বিভাগ। পরে সড়ক বিভাগের (সওজ) ময়মনসিংহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনার সত্যতা পেয়ে তিনি স্বীকার করেন, এই পরিবেশে কার্পেটিং করা ঠিক হয়নি। কারণ, বিটুমিন বা পিচের ধর্ম হচ্ছে, পানি থাকলে এটি জমাট না বেঁধে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় গাড়ির চাকার ঘর্ষণে সহজেই ভেঙে যায় সড়ক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ মে ফুলপুর পৌর মেয়র আমিনুল হক, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানকে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদ হোসেন চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেখানেই সড়কটির ওই অংশ ভেঙে আবার মেরামতের সিদ্ধান্ত হয়। তবে ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আর এ নিয়ে কিছু বলতেও নারাজ সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
উপর্যুক্ত ঘটনা দু’টি আমাদের কাছে খুব একটা কৌতূহল উদ্দীপক নয়। কারণ, এসব ঘটনা হরহামেশায় ঘটছে। আগেও ঘটেছে এবং আমরা ধরেই নিয়েছি যে, আগামীতেও ঘটতে থাকবে। স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ, সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ, এমনকি ব্রিজ নির্মাণেও রডের বদলে বাঁশ দেওয়ার খবর, সিমেন্টের বদলে কাদামাটির ব্যবহারের খবর, বর্ষা শুরু হলে নামকাওয়াস্তে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের খবর মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। সরকারি যে কোনো নির্মাণ কাজে এসব অনিয়ম, প্রতারণা, জোচ্চুরি এমনকি কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়ার ঘটনা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো ঘটছেই, খোদ রাজধানীতেও এর নজিরের অভাব নেই। স¤প্রতি নতুন যুক্ত হওয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি, ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড) মোহাম্মদবাগ ন্যাশনাল ব্যাংকের নিচে ড্রেন নির্মাণে সিমেন্টের বদলে কাদা মাটি দিয়ে ঢালাইয়ের কাজ করার অভিযোগ উঠে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর স্থানীয়রা তা ভেঙে ফেলেছে। তাছাড়া শুকনো মৌসুমে কাজ না করে রাজধানীর খানাখন্দে ভরা রাস্তা সংস্কারের কাজ হয় বর্ষাকালে। আর এটা প্রতি বছরই হয় নগরবাসীর চোখের সামনে। ফলে অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যায়, সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট। ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এর মাত্রা কোনো কোনো সময় এতটাই বেড়ে যায় যে, তা নিয়ে তাক্ষণিক সান্ত¦না দিতে হয় ঊর্ধ্বতনদের। যেমন, গত বছর ঈদের আগে রাজধানীর খানাখন্দে ভরা রাস্তা পরিদর্শন করতে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সঙ্গে থাকা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। কিন্তু তাতে কী হয়েছে, অবস্থা যা ছিল এখনও তাই আছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গত ২১ মে গণমাধ্যমে দেয়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য থেকে। তিনি নগরবাসীদের সান্তনা দিয়ে বলেছেন, ‘ঢাকায় তিন ঘণ্টার বেশি জলাবদ্ধতা থাকবে না। থাকছেও না। দুই একটি ব্যাড স্পট ছাড়া দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পানি সরে যাচ্ছে।’ আসলে বাস্তবতা যে কতটা ভয়াবহ সেটা ঢাকাবাসী হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছে গত সপ্তাহে। বর্ষার ভরা মৌসুম শুরু হলে যে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রতারণা আজ সর্বত্র। তাই বিভিন্ন নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার বা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো এর সুযোগ আগেও নিয়েছে, এখনও নিচ্ছে। কোথাও রডের বদলে দিচ্ছে বাঁশ, কোথাও সিমেন্টের বদলে কাদামাটি। কোথাও আবার বৃষ্টির মধ্যে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার দেখিয়ে হয়তো ১০ শতাংশ কাজ করেই শতভাগ বিল তুলে নিচ্ছে। কোথাও খড় দিয়ে রাস্তা কার্পেটিং করছে রাতের আঁধারে। আর তাদের সহযোগী হিসেবে সহায়তা করছেন জনগণের করের টাকায় লালিত-পালিত সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীগণ। উপরের কোনো ঘটনাতেই সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যমের তৎপরতায় নির্মাণ কাজের ত্রæটি সনাক্ত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো প্রকৌশলী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আগ্রহী মনে হয়নি। গণমাধ্যম কর্মীদের চাপাচাপিতে তারা বড়জোর বলেছেন, ‘মিস্টেক হয়ে গেছে, আবার ঠিকঠাক করা হবে’, ‘রড সোজা রাখতে বাঁশ দেয়া হয়েছে’, ‘তদন্ত করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অপরাধ খতিয়ে দেখা হবে’ ইত্যাদি। আসলে এসব কথায় এক ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের আভাস আছে। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তারপরেও কেন হচ্ছে? ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া মনোভাব ও প্রভাব, অবৈধ লেনদেন (অর্থমন্ত্রীর ভাষায় স্পিড মানি) ছাড়াও নানা কারণ রয়েছে এর পেছনে যা আমাদের সরকারের বা প্রশাসনের অজানা নয়।
সরকারি সকল উন্নয়ন কাজ হয়ে থাকে জনগণের করের টাকায়। সেই টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে সর্বত্র। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ না করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় অর্থ খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। হাওর রক্ষা বাঁধ সংস্কারে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ ছিল এবং তা খরচ করার পরও গত বছর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে কৃষকদের হাজার হাজার একর জমির ধান। যা নিয়ে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, ‘লুটপাট হয়েছে কিন্তু পুকুর চুরি হয়নি’। রাজধানীর রাস্তা সংস্কারে টাকার অভাব আছে বলে মনে হয় না, কাজও হচ্ছে; তবে সেটা অসময়ে এবং অপরিকল্পিত উপায়ে, তাই খানাখন্দে ভরা রাস্তার ভোগান্তিও শেষ হচ্ছে না। এই অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। সময় এসেছে সকল নির্মাণ কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সকলকে বাধ্য করার। কোথাও কোনো অনিয়ম পেলে তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ জনগণের টাকা কতিপয় দুর্বৃত্তকে লুটে নেওয়ার সুযোগ দেয়া যায় না। এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব আশা করছি। পাশাপাশি এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধও কাম্য।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।