Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুল : রুবাইয়াৎ-এর শ্রেষ্ঠ অনুবাদক

মী ম মি জা ন | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার অমর ও অবিসংবাদিত এক কবি। তাঁর কলমি শক্তির সৃষ্টিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পুষ্পময় কানন। এই ভাস্বর কবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, পত্রিকা সম্পাদনা, অনুবাদ, সংগীত পরিচালনা, চলচ্চিত্র পরিচালনা সহ শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট বাংলা সাহিত্যকে ঋণী করে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পবিত্র কুরআন থেকে শুরু করে বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু গ্রন্থও তিনি সাবলীল অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদ গুলি হলো: দিওয়ানে হাফিজ, কাব্যে আমপারা ও রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে দিয়েছে বহমান এক গতি। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলি ছিল মৌলিক ও সাহিত্যিক মানে অনন্য। নজরুলের করা অনুবাদগুলির মধ্যে ‘রুবাইয়াৎ-ই- ওমর খৈয়্যাম’ সাহিত্য বোদ্ধা, সাহিত্য সমালোচক ও সাহিত্যরস সন্ধানীদের নিকট প্রশংসিত ও সর্বোচ্চ গ্রহণীয়।
আমি ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র ও গবেষক হিসেবে যখন ফারসি ভাষার অমর সৃষ্টি, ইরানের মনীষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওমর খৈয়্যামের রুবাইয়াৎ বুঝতে চাই তখন বিজ্ঞ অনুবাদক নজরুলের অনুবাদটি আমাকে বুঝতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে। অন্যান্য অনুবাদগুলি ফিটজেরাল্ডের আধো আধো ও ভোগবাদীতার ছাপে প্রচ্ছন্ন। তাই যদি কেউ মূল রুবাইয়াৎ এর স্বাদ গ্রহণ করতে চায়(বাংলায়) তবে অবশ্যই তার উচিত হবে নজরুল কৃত অনুবাদটি পড়া। অমর সৃষ্টি রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়্যাম গ্রষ্টা ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২৩) প্রাচ্য (পারস্য) মনিষী। তাঁর মনন ও মেধা আপন স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল হয়েছেন, জ্ঞানের যতগুলো শাখায় তিনি ছোঁয়া দিয়েছেন সব শাখাতেই। প্রতিটি শাখাকেই করেছেন সমৃদ্ধ জ্ঞান পিপাসুদের করেছেন ঋদ্ধ। বীজ গণিতের আবিষ্কারক, প্রথম সৌর পঞ্জিকার আবিষ্কারক এই বিজ্ঞানী ছিলেন একজন জ্যোতির্বিদ। তিনিই প্রথম পারস্যে মান মন্দির স্থাপন করেন, এবং অনেক গ্রহ নক্ষত্র আবিস্কার করেছিলেন। একজন সুফি দরবেশ হিসেবে যেমন সমাদৃত তেমনি ধর্মান্ধ কর্তৃক নাস্তিক ঘোষিত হওয়া এবং তাঁদের হাতে জীবনের বিভিন্ন সময়ে নিগৃহীত হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, হয়েছিলেন চাকরীচ্যুত। এমনকি ধর্মান্ধদের পরামর্শে শুদ্ধ হওয়ার জন্য হজ্ব ব্রত পালন করতে গিয়ে আরেকদল ধর্মান্ধ কর্তৃক মক্কা শরিফে লাঞ্চিত হন এবং বিতাড়িত হন। বর্তমানে ওমর খৈয়াম বহুল আলোচিত একজন কবি হিসেবে একজন দার্শনিক হিসেবে। তাঁর কবিতার স্বাদ আস্বাদনকারী সমঝদারের সংখ্যা সম্ভবত পৃথিবীর যেকোনো কবির চেয়ে অনেক বেশী। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন কাব্য এতো অল্প সময়ে এত অধিক জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়ে নি। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চিন্তা-চেতনা-দর্শন।
সুফিসাধক ও জ্যোতির্বিদ খৈয়্যাম যে রুবাইয়াৎ বা রুবাঈ এর কারণে খ্যাত সেই রুবাইয়াৎ বা রুবাঈ এর সংজ্ঞায় এ টি এম মোস্তফা কামাল লিখেছেন: ‹রুবাই আরবী শব্দ। অর্থ-চতুষ্পদী অর্থাৎ চার পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা। এটা বিশেষ ধরণের কবিতা। কিছু কিছু কবিতা আছে বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন মেনে সেগুলো লেখা হয়, যেমন- সনেট, লিমেরিক, এলিজি,ওড, ক্বাসিদা, রুবাই ইত্যাদি। রুবাইয়ের বহুবচন রুবাইয়াত। ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের (বর্তমান ইরান) কবি উমর খৈয়াম, হাফিজ প্রমুখের হাতে কবিতার এই বিশেষ ফর্মটি চরম উৎকর্ষ লাভ করে। এটি ছড়া নয়। ছড়া হচ্ছে মূলত: শিশুতোষ রচনা। রুবাই উচ্চমার্গের দার্শনিক রচনা। সুফিবাদ ও মুতাজিলা স¤প্রদায়ের দার্শনিক মতের সাথে মিল পাবেন রুবাইয়ের দর্শনের।›
প্রধানত সুফিবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এই সব রুবাই মাত্র চার লাইনে লেখা হয়েছে। রুবাইয়ে উলি­খিত সাকি সুরা প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সাকি হলো মুর্শিদ আর সুরা হচ্ছে দিব্যজ্ঞান/পথের দিশা। রোমান্টিকতাও যে তাতে নেই তাও নয়। এতে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে একই অন্তমিল রাখা হয় তৃতীয় লাইনটি মুক্ত অর্থাৎ কোন অন্তমিল থাকেনা (ককখক)।
বাংলা ভাষায় রুবাইয়াত এর অনুবাদ অনেক সাহিত্যরস বোদ্ধা ও বিশ্ব সাহিত্যের প্রেমিক চমৎকার ভাবে করেছেন। তন্মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল­াহ ,সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, বিমল চন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, সিকান্দার আবু জাফর সহ এ পর্যন্ত ১০৪ জন গুণী বাংলা ভাষায় রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন ৷ তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ৷
খৈয়ামের অনুবাদ হয়েছে তিন শ্রেনীতে প্রথমত ভাবমুখ্য, দ্বিতীয়ত গতিমূখ্য, তৃতীয়ত ভাব-গতি মূখ্য ৷ কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদে তৃতীয় লক্ষণটি স্বরূপে বিরাজমান ৷ কাজী নজরুল ব্যতিত এই অনুবাদকগণ ফার্সী ভাষা জানতেন কিনা তা সহজে বোধগম্য নয় ৷ যদিও জেনে থাকতে পারেন তবে বলতে হয় ইংরেজ কবি ফিটজেরাল্ডের মোহ তারা পূর্ণরুপে কেটে উঠতে পারেন নি।
নজরুল কিভাবে রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়্যামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তা নজরুলের ফারসি শেখা ও ফারসি প্রীতি দেখলে বোধগম্য হবে। শৈশবে বেনেপাড়ার বিনোদ চাটুজ্জের পাঠশালায় কিছুদিন পড়ে নজরুল গ্রামের মক্তবে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে তিনি কোরআন পাঠ আয়ত্ত করেন। মক্তবে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ লাভ করেছিলেন মৌলবি কাজী ফজলে আলীর কাছে। পরে বিশেষ করে ফারসি শেখেন তাঁর চাচা কাজী বজলে করিমের (নজরুলের পিতামহ কাজী আমিনুল­াহর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী নাজিবুল­াহর পুত্র) কাছে।
তাঁর ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের কথা তিনি নিজেই ‹রুবাইয়াত-ই হাফিজ›র ভূমিকায় লিখেছেন, আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেব থাকতেন।
-চলবে



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নজরুল


আরও
আরও পড়ুন