Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুষ্ঠু শিক্ষা ও অবাধ গণতন্ত্রের জন্য আর কত প্রতীক্ষা?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কতটা নিশ্চয়তা দেয়? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব আশা করা বাস্তবতার আলোকে প্রায় অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। কোনো জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যেমন সামাজিক বিবেচনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত থাকার ওপর তেমনি রাজনীতি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থিতিশীল থাকার ওপর।
দুঃখের বিষয় সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফলে গত নয় বছরের মধ্যে এবার সবচাইতে খারাপ রেজাল্ট দেখা গেছে। কোনো বছর এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফল আশাতিরিক্ত ভালো হলে তার কৃতিত্ব নেয়া এ দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের একটা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। সে নিরিখে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় হতাশাব্যঞ্জক ফলাফলের দায় অনেকটাই বর্তমান সরকারের ওপর পড়তে বাধ্য। এ তো গেল সামাজিক ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতির মূল্যায়ন করা।
এবার রাজনীতি ক্ষেত্রে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির মূল্যায়নের প্রশ্ন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির মূল্যায়নের অপরিহার্য মাপকাঠি হচ্ছে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা স্থিতিশীলতা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের ভয়াবহভাবে হতাশ না হওয়ার কোনো উপায়ই নেই। কারণ বর্তমানে যে সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে, তা কোনো অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফসল নয়। এর মূলে ছিল এমন একটি নির্বাচন যাকে জনগণ নাম দিয়েছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। কেন জনগণ এ নির্বাচনকে এমন নাম দিয়েছিল? কারণ এটা ছিল এমন একটি নির্বাচন, যা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অন্যতম বিএনপি কর্তৃক অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় প্রকাশ্যে বর্জিত হয়েছিল। দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম কর্তৃক বর্জিত (বয়কট) হওয়ার পটভূমি বিশ্লেষণ করলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল জানেন, আমাদের দেশে এখনও গণতন্ত্র যে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি তার অবশ্য কারণ ছিল পাকিস্তান আমলের একশ্রেণির সামরিক ও বেসামরিক আমলার অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা। এর উত্তরাধিকার যাতে স্বাধীন বাংলাদেশকে কলুষিত করতে না পারে সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের বিশেষ লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র যেন সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। এ পটভ‚মিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি লাভ করে তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল গণতন্ত্র। এর প্রমাণ বাংলাদেশের অন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরকার ভেদে মাঝে মধ্যে সংশোধন করা হলেও জনগণের সমর্থনধন্য গণতন্ত্রের গায়ে কাগজে কলমে আঁচড় কাটতে সাহস পায়নি কোন সরকারই। সেই গণতন্ত্রই দেশে বাস্তবে সর্বাধিক অবহেলা ও অবমূলায়নের শিকার হয় এবং আরও দুঃখের বিষয় গণতন্ত্রের এ অবমূল্যায়নের পালা শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই, যখন সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরবর্তীকালে কিছু দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হলেও একপর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। এই অভাবনীয় পদক্ষেপ সম্ভব হয়েছিল হয়তো এই বিবেচনায় যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত দলটি ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। এতে প্রমাণিত হয় আওয়ামী লীগ নেত্রীর কাছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান প্রতিপক্ষের চাইতে অধিক সমর্থনযোগ্য মনে হয়েছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন। বলা বাহুল্য এটা শেখ হাসিনার গণতন্ত্র-প্রীতির কোন প্রমাণ বহন করে না।
রাজনৈতিক মহলের স্মরণ থাকার কথা, এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন। প্রথম দিকে বহুদিন শেখ হাসিনা এসব আন্দোলন থেকে সরে থাকলেও পরবর্তীতে একপর্যায়ে তিনিও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এরশাদ আমলের শেষ দিকে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নতুন সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে একমত হয়।
যেমনটি আশা করা হয়েছিল, তেমনটি নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দেশের প্রাচীনতম ও সবচাইতে সুসংগঠিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। নির্বাচন চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে শেখ হাসিনা একপর্যায়ে বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা খেয়াল রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন এর মধ্যে আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে।
ভোট গণনা শেষ হলে যখন জানা গেল আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেলেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। অবশ্য জনগণ এসব কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নতুন সরকার গঠন করেন এবং শেখ হাসিনা হন সংসদের বিরোধী দলনেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার মেয়াদ শেষে প্রধানত বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিধানসহ সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ব্যবস্থা গণতন্ত্রের নিরিখে খুবই উপযোগী প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে দেশের দুই প্রধান নেত্রী পালাক্রমে পর পর নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন। দুঃখের বিষয় একপর্যায়ে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও অতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধার কারণে পচিয়ে ফেলা হয় এবং একপর্যায়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বিএনপি এই ঘোষণাকে দুই দলের মধ্যে অতীত সমঝোতার লংঘন বলে অভিযোগ করে এ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়।
দেশের প্রধান দুই দলের অন্যতম বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে সে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিরোধী দল তো দূরে থাকুক, অনেক আওয়ামী লীগ নেতা- নেত্রীও ভোটদানের জন্য ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন ভোট কেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে। বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকারি দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী ভোট কেন্দ্রে ইচ্ছামতো সরকারি দলের প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে উচ্ছামতো সীল মেরে সরকারি প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট বহুগুণে বাড়িয়ে দেখাবার সুযোগ লাভ করে। তবে এতো যে সব আসনে নির্বাচনের মহড়া হয় তার কথা। জাতীয় সংসদের মোট আসনসংখ্যা ৩০০ এর অর্ধেকের ও বেশি ১৫৩ আসনে তো কোন নির্বাচনই হয়নি। সেসব আসনে সরকারি দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ায় সেসব আসনে নির্বাচনের প্রশ্নও ওঠেনি।
অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অবাধ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়ায় তারা সব সময়ই বাস্তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আন্তরিক আগ্রহী থাকেন। তার প্রমাণ তারা সাধারণত নির্বাচনের দিনে সকল কাজ ফেলে নির্বাচনের উদ্দেশে ভোটার লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। দেশের বিভিন্ন সময়ে যেসব বড় বড় পরিবর্তন এসেছে, তার প্রায় সবটাই, যেমন ১৯৪৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৬ সালে, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৭০ সালের স্বাধিকার দাবিতে সাধারণ নির্বাচনে জনগণের অধিকার সম্পর্কে রায় প্রদানসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দান করেছে জনগন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
দু:খের বিষয় অতীতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ঐতিহ্য ছিল তার আজ অনেক কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। ফলে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আজ অনেকটাই বাস্তবে অসম্ভব। দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে অবাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কবে পুনরায় গড়ে তোলা সম্ভব হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন