Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মেধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

মোহাম্মদ আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আমেরিকান ঔপন্যাসিক জ্যানেট প্লেনার এর একটি মূল্যবান উক্তি হলো, Jenius is immediate but talent takes time. অর্থাৎ প্রতিভা তাৎক্ষণিক, কিন্তু মেধাবী হতে সময় লাগে। ভোরের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে ঠিক তেমনি মেধাবীরাও আমাদের সমাজ ও দেশকে আলোকিত করেন। মেধা এমন এক সম্পদ যার কোনো শেষ নেই। এটি এমন এক অস্ত্র যার আঘাত প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই কারো। মেধা কোনো দল বা মতের সম্পত্তি নয়, এটা গোটা দেশ, জাতি ও বিশ্বের সম্পদ। মেধাবীদের কারণেই সমাজ ও দেশ এগিয়ে যায়। মেধার বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের স্বার্থেই প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের নক্ষত্রসম মেধাবী ব্যক্তিদের দিকে তাকালেই দেখা যাবে তাদের কারণেই সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে। একটি দেশ ও জাতির আমূল পরিবর্তনের জন্য মেধার বিকাশ কতটা জরুরি তা অবর্ণনীয়। একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও দেশ গঠনে মেধাবীরাই বেশি ভূমিকা রাখেন। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আজকের পৃথিবীতে এগিয়ে যেতে হলে মেধাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মেধা চর্চার অর্থই হলো জ্ঞান চর্চা। জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ গতিতে বাঁধা যায় না। জ্ঞান হলো অসীম, জ্ঞান সর্বদাই বিকাশমান। জ্ঞানের সীমা টানার কোনো পথ নেই। সুতরাং একটি দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে মেধাকে কোটার উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন হয়েছে। মেধাবীদের সুযোগদানের জন্য কোটার পুণর্মূল্যায়ন ও সংস্কার এর জন্য ছাত্র সমাজের আন্দোলনে দেশের শিক্ষক সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজসহ সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান। ১১ এপ্রিল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও প্রশাসন এক পরিবার। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে গত ফেব্রæয়ারি থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আন্দোলন করেছে। ঢাকায় মানববন্ধন, প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানসহ সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। যে কোনো ন্যায্য দাবী নিয়ে আন্দোলন যদি সহিংস হয় এবং সেখানে যদি স্বার্থান্বেষী মহলের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন সে আন্দোলনের মর্যাদা থাকে না, সাধরণ মানুষেরও সমর্থন থাকে না। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবাই চাকরিতে আসবে। তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের চাকরির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ারও আহবান জানান। 

বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, জেলা ভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। অর্থাৎ মেধার ভিত্তিতে চাকরি প্রার্থীর সুযোগ রয়েছে মাত্র ৪৪ শতাংশ চাকরিপ্রার্থীর। মেধার চেয়ে কোটা বেশি হওয়ায় পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১), ২৯(১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য সংবিধানে বলা হয়েছে। কোটা সংস্কারের বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। কোটার কারণে কম মেধাবী ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের চাকরি হয়ে যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হওয়া দরকার। যোগ্য ও মেধাবীদের উপেক্ষা করে কোন দেশই এগিয়ে যেতে পারে না। বেশি পরিমাণে কোটা থাকায় যার যা প্রাপ্য তা সে পাচ্ছে না। দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিরাজমান সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধানের সরকারি ঘোষণায় দেশের মানুষ আশাবাদী হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা দরকার। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর কিংবা তার নিচে। দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। ইউএনডিপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। ২০৩০ সালে নাগাদ কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৩ কোটি, যা হবে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমনি ব্যর্থতায় মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ারও আশংকা বেড়ে যাবে। যারা দক্ষ ও মেধাবী তারাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে এবং যোগ্যতা-দক্ষতা এবং মেধার ভিত্তিতেই সবচেয়ে ভালো চাকরি পাবে তারাই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সুতরাং রাষ্ট্রের স্বার্থেই মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আবার কিছু কিছু সীমিত আকারে কোটা রাখতে হবে, তাও রাষ্ট্রের স্বার্থেই করতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা ব্যবস্থা রেখে রাষ্ট্র ও সমাজকে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এখন সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। এরা অভিভাকদের আয়ের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ব্যতিরেকে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর। এই ৩০ বছর বয়সসীমার বিজ্ঞানভিত্তিক কোন যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করার আগেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে যায়। ২৩ থেকে ২৪ বছরে শিক্ষা জীবন শেষ করার কথা থাকলেও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম অবস্থা দেখা যায়। অনেকেই ২৭ থেকে ২৮ বছরেও শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারে না। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশন জটের কারণেও শিক্ষার্থীরা চাকরির প্রস্তুতির সময় পায় না। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না বাড়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েইে চলছে। বেকারদের মধ্যে ৪০ শতাংশই শিক্ষিত। আইএলও’র মানদন্ড অনুযায়ী সক্ষম জনগোষ্ঠী যারা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করে না তাদেরকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের শেষে সারাদেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক রয়েছেন যারা সপ্তাহে একঘণ্টাও কাজ পাচ্ছেন না। এই বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর উত্তীর্ণ। বাংলাদেশে সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিতে বৈষম্যের চিত্র নিম্নরূপ- পার্বত্য জেলায় ৪০ বছর, প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক ৩৫, নার্স ৩৬, ডাক্তার ৩২, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩২, উপজাতি ৩২, প্রতিবন্ধী ৩২ এবং মুক্তিযোদ্ধা ৩২। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ভারতে ৪০ বছর, শ্রীলংকায় ৪৫, ইন্দোনেশিয়া ৩৫, ফ্র্যান্সে ৪০, সুইডেন ৪৭, অস্ট্রেলিয়ায় ৫৫, বাংলাদেশে ৩০। অন্যান্য দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫, ৪০, ৪৫, ৫৫ ইত্যাদি হওয়ার কারণ হলো নীতি নির্ধারকরা মনে করেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞান ও মেধা কাজে লাগিয়ে নিজে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি দেশকেও সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, মানুষের কর্মক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতা বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। বাস্তাবতা হলো, দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করা অনেক কঠিন হবে। দেশের মানুষের গড় আয়ু যখন ৪৫ বছর ছিল তখনও চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। গড় আয়ু যখন ৫০ তখন ৩০ বছর করা হয়েছিল। এখন গড় আয়ু ৭১ বছরেরও বেশি। চাকরিতে প্রবেশের বয়স এখনও ৩০ বছর রয়েছে যা কোন ক্রমেই যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার বয়সের মারপ্যাঁচ ও কোটা পদ্ধতির কারণে সরকারি চাকরি পাচ্ছে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছরের কারণে চাকরি পাচ্ছে না। কোটা পদ্ধতির সংস্কারের সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে মেধাবী বেকাররা তাদের মেধা যাচাই করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেধা

১৩ জানুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন