Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে কি সাধারণ মানুষের দুর্দশা কমবে?

প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৭:৩৮ পিএম, ১ মার্চ, ২০১৮

কামরুল হাসান দর্পণ
দেশের মানুষ যেন উন্নয়নের এক ইন্দ্রজালে আটকে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দল বিশাল বিশাল জনসভা করে কেবল উন্নয়ন আর উন্নয়নের কথা বলে বেড়াচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ যতই দুঃখ-কষ্টে থাকুক সরকারের এ কথা তাদের অবশ্যই মানতে হবে। কেউ দুঃখ-কষ্টে আছে, এ কথা সরকার কিছুতেই শুনতে চায় না। বরং সে এ কথাই শুনতে চায়, আমরা মহাসুখে এবং মহানন্দে আছি। সাধারণ মানুষ এ নিয়ে খুবই বিপাকে আছে। সরকার তাদের এই দুর্দশা মানতে যেমন নারাজ, তেমনি তাদের পক্ষ হয়ে কেউ কথা বলুক, তা কিছুতেই বরদাশত করতে চায় না। এর ফলে প্রতীয়মান হচ্ছে, সরকার সাধারণ মানুষের বেদনা উপলব্ধি নয়, নিজের উন্নয়নের শ্লোগানকে আকাশে-বাতাসে ধ্বণিত করার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এবং এই এগিয়ে যাওয়া ধরে রাখতে  যে করেই হোক আমাদের পুনরায় ক্ষমতায় আসতে হবে- এমন নীতির মধ্যেই অটল-অবিচল হয়ে আছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র নামক তত্ত¡টিকে কিছুতেই সামনে আনা যাবে না। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধামাচাপা দিয়ে সাড়ম্বরে বড় বড় প্রকল্পের উন্নয়নের নিশান উড়িয়ে দিয়েছে। এর মূল লক্ষ্য মানুষকে বোঝানো গণতন্ত্র-ফন্ত্র বলে কিছু নেই, উন্নয়নই আসল কথা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও নাছোড়বান্দা। তারা গণতন্ত্র আগে বলার পাশাপাশি নিদেনপক্ষে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে করার কথা বলছেন। তাদের এসব কথা সরকারের ভাল লাগার কথা নয়। সরকার কানও দিচ্ছে না। বিরোধিতাও করছে না। কারণ হচ্ছে, বিশ্লেষকদের কথা উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। তাদের কথা যুক্তিযুক্ত। সরকারও বোঝে তার ক্ষমতাসীন হওয়া নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অত্যন্ত বিতর্কিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ পরিচালনা করছে। এটা তার সবচেয়ে বড় একটি দুর্বলতা। যদি যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হতো, তবে ‘গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে’ বা ‘মুরগী আগে না ডিম আগে’- এ ধরনের অনর্থক তত্ত¡ ও বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই উন্নতি হতো। সরকার তার দুর্বলতা ঢাকতে এবং জনগণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার জন্যই উন্নয়নকে সামনে তুলে ধরছে। জনগণ যাতে মনে করে, বাহ্, বেশ উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নই তো দরকার! গণতন্ত্রের দরকার কি! সরকার জনগণকে এমন একটি ধারার মধ্য দিয়েই এগিয়ে নিচ্ছে। তবে সরকার যেহেতু চিরস্থায়ী নয় এবং তাকে কখনো না কখনো ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে, তখন হয়তো টের পাবে, সাময়িক আরামের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কী ক্ষতিই না করা হয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের কথার সার অংশ এটিই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘যারা গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে বলে বিতর্ক করছেন, তারা উন্নয়নের আধুনিক ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কারণ, সমতা যদি না থাকে তাহলে সেটা উন্নয়ন নয়।’ মূল কথা এটিই। তবে যে সরকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে ক্ষমতাসীন সে তা মানবে কেন? সে তার দুর্বলতা ঢাকতে নানা কৌশল অবলম্বন করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই কৌশলের অন্যতম হচ্ছে ‘উন্নয়ন তত্ত¡’। এটাই সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং বলতে হবে দেশ উন্নয়নের সাগর-মহাসগরে ভাসছে। উন্নয়ন সমহারে হচ্ছে না, অসমহারে হচ্ছে-এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উন্নয়ন চিত্র দেখিয়েই বলতে হবে, উন্নয়ন হচ্ছে। এই উন্নয়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের পকেটে পর্যন্ত সরকারকে হাত দিতে হয়েছে। চলতে-ফিরতে, খাইতে-নাইতেসহ প্রায় সবকিছুতেই ভ্যাট বসিয়ে দিয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সেবামূলক সব প্রতিষ্ঠানের বিল গোচরে-অগোচরে বাড়িয়ে দিয়েছে। সামনে আরও বাড়ানো হবে। এতে সাধারণ মানুষ মরল না বাঁচল তা দেখার দরকার নেই। আর জনগণের ভোটেরও দরকার নেই। প্রশাসন ঠিক থাকলে কারো ক্ষমতা নেই যে তাকে ক্ষমতা থেকে সরায়। বরং প্রশাসন ঠিক রাখার জন্য এবং তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় তাই করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। তাদের সুখে রাখতে জনগণকেই অর্থের জোগান দিতে হবে। যতই কষ্ট হোক আমার ক্ষমতা পাকাপোক্তের ভিত্তি প্রশাসনকে ঠিক রাখতে জনগণের পকেট কাটতেই হবে।  
দুই.
আমরা উন্নতি করছি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর উন্নয়ন ছাড়া গতিও নেই। এক জায়গায় থেমে থাকা মানে তলিয়ে যাওয়া। কেউ থেমে বা তলিয়ে যেতে চায় না। প্রত্যেক মানুষকেই জীবিকার তাকিদে উন্নয়নের পিছনে ছুটতে হয়। এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নটা কিভাবে হচ্ছে? সার্বিক না গোষ্ঠীগতভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, উন্নয়নটা হচ্ছে গোষ্ঠীগতভাবে। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ যখন দেখে তার চারপাশের কিছু মানুষের শনৈশনৈ উন্নতিতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের জীবন চালাতেই হুতাসনের মধ্যে থাকতে হচ্ছে, তখন সহজেই বুঝতে পারে, উন্নতিটা একপেশে হয়ে গেছে। পার্থক্যটা আকাশ আর পাতালের সমান। অথচ উন্নতি হওয়ার কথা সমহারে, সুষমভাবে। অনেকটা পিরামিড আকারে। নিচ থেকে উন্নতি হতে হতে উপরের ধনিক শ্রেণী পর্যন্ত। অন্যদিকে ধনিক শ্রেণীর অর্থ ও বিনোয়েগ নিচের দিকে ধাবিত হবে। তা না হয়ে উন্নতির চিত্রটি হয়ে গেছে উল্টো পিরামিডের মতো। ধনিক শ্রেণী উন্নতি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। সাধারণ মানুষ ক্রমেই শুকিয়ে চোঙ্গাকৃতির মতো চুপসে যাচ্ছে। আমাদের উন্নতিটা এখন এভাবেই হচ্ছে, যেখানে সমতা বা আনুপাতিক হার বলে কিছু নেই। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে সরকার হয়তো বলতে পারে, মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। সমতা হয়নি কোথায়? এ কথার যুক্তি দিতে গেলে শুভংকরের বিশাল একটা ফাঁক ধরা পড়বে। এ নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশে যে প্রায় চার কোটি বেকার রয়েছে, তার আয় হচ্ছে কিভাবে? যে বেকার, তার আয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি ‘হাওয়াই মিঠাই’ ছাড়া কিছু নয়। অনেকটা স্বপ্নে মিষ্টি খাওয়ার মতো। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্জের একটি কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মাথাপিছু আয়ের হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এ স্তরে পৌঁছাতে হলে মাথাপিছু আয়কে ৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলছে, তার আন্তর্জাতিক কোনো মানদন্ড নেই। এটা বাংলাদেশেরই তৈরি।’ অর্থাৎ সরকার কাগজে কলমে যা ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে, তাই ধরে নেয়া হচ্ছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি বা মানদন্ড নেই। মানদন্ড হচ্ছে, সরকারের ঘোষণা বা ইচ্ছা। বিষয়টা অনেকটা ‘মুই কি হনু রে’Ñএর মতো হয়ে গেছে। বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বা কেউ মানুক বা না মানুক, আমিই রাজা! যা বলব তাই ঠিক এবং আলবৎ ঠিক। এর উপর কোনো কথা নেই। বলা হচ্ছে, আগামী মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)-এর তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। এজন্য বাংলাদেশকে তিনটি লক্ষ্যÑমাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা’র মধ্য থেকে দুটিতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আমরা যদি মাথাপিছু আয়ের কথা বিবেচনা করি, তাহলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ বা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে মাথাপিছু গড় আয় হতে হবে ৪ হাজার ডলারের বেশি। এখন এই আয় ১৬১০ ডলার। আগামী সাত-আট বছরে বাস্তবিকই কি তা তিন গুণ করা সম্ভব? যেখানে বর্তমান মাথাপিছু আয় নিয়েই যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে? হ্যাঁ, যেহেতু কোনো মানদন্ড নেই এবং সরকার তার ইচ্ছা মতো ঘোষণা করে দিতে পারে- এ হিসাবে তা সম্ভব। চার হাজার কেন, পাঁচ-ছয় হাজার বা তার বেশিও ঘোষণা করে দিলেও কে হিসাব করতে যাবে? মানুষ কেবল শুনবে তার মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলার হয়েছে। আর পকেট হাতড়ে ডলার খুঁজবে। কোটি কোটি বেকার রেখে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত কিনা, তা এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী ছয়-সাত বছরে দেশের কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হয়ে যাবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ চিন্তা করা খুবই কষ্টকর। আমরা ভাল করেই জানি, দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে চরম মন্দাবস্থা চলছে। শিল্প কারখানা চালু হওয়ার পরিবর্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা করে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে কীভাবে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবো? পরিসংখ্যানের বায়বীয় তথ্য দিয়ে কাগজে-কলমে যদি সরকার এখনই ঘোষণা করে দেয় আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, তাতে কী আসবে যাবে! তাতে কি সাধারণ মানুষের যে দুর্দশা তা বদলে যাবে? বা রাতারাতি তাদের জীবনমান একেবারে ঝকঝকে তকতকে হয়ে যাবে? বিশ্লেষকরা কিছুদিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে, তারপর থেমে যাবে। সাধারণ মানুষের জীবনের টানাপড়েন যে বদলাবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্যদিকে সরকার তার উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে বলবে, উন্নয়নশীল দেশে বা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। কাজেই উন্নয়নের এ ধারা বজায় রাখতে হলে, আমাদেরকেই ক্ষমতায় থাকতে হবে।
তিন.
ক্ষমতায় কে থাকল বা না থাকল, সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন কতটা হচ্ছে এবং কীভাবে হচ্ছে। এটা কি শুধু কাগজে-কলমে হচ্ছে নাকি, টেকসইভাবে হচ্ছে। দেখার বিষয় এটাই। সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা পেছনে ঠেলে সরকার হয়তো ঘোষণা দিয়ে সাময়িক বাহবা নিতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও পড়তে পারে। ঘোষণা আর বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান হলে, উন্নয়নের ফানুস চুপসে যেতে বেশি সময় লাগবে না। সরকারের মধ্যে আত্মতুষ্টি রয়েছে যে, যা উন্নয়ন হচ্ছে তার সবই সে করেছে। বস্তুত সরকারের একার পক্ষে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি উদ্যোগ। সরকারি উদ্যোগে রাস্তা-ঘাট আর কিছু বড় প্রকল্প বা স্থাপনা নির্মাণ করলে চেহারা ভাল দেখা যায় ঠিকই, তবে তা সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক নয়। আমাদের দেশের মানুষের অর্থনীতির কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে, স্বচ্ছন্দে চলার মতো আর্থিক সঙ্গতি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে রয়েছে। খুবই টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। একদিক টান দিলে, অন্যদিক উদাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যদি এমন হতো, মানুষ তার অভাব মিটিয়ে জীবনযাপন করে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছে, তাহলে সেটাই হচ্ছে উন্নয়নের মূল সূচক বা সাসটেইনঅ্যাবল ডেভালপমেন্ট। এখন অবস্থা অনেকটা এমন, সরকার কিছু মানুষের উন্নতিকে সূচক হিসেবে ধরে উন্নয়নের কথা বলছে। অর্থনীতির হিসাবে বাংলাদেশ হয়তো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তবে কতটুকু উন্নয়ন গতি নিয়ে বের হচ্ছে, তা কিন্তু প্রচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে। শঙ্কার বিষয়টি এখানেই। এখন দেখা যাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে সুদবিহীন বা ন্যূনতম সুদের বিনিময়ে যে ঋণ ও সহযোগিতা পেত, তা আর পাবে না। কারণ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ ও সহায়তা কম পাওয়া যায়, পেলেও তার সুদের হার বেশি। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে বিশ্বের সব দেশগুলোর উন্নতি নিয়ে তিনটি শ্রেণীতে একটি তালিকা করে। শ্রেণী তিনটি হচ্ছে, স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ ও সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এ তালিকায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ঠাঁই পায়। ২০১৫ সালে ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ তালিকা থেকে বের হতে বাংলাদেশের সময় লেগেছে প্রায় ৪৫ বছর। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে যে তিনটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি। বাকি দুটি সূচক মানব সম্পদের উন্নয়ন (৬৬ পয়েন্টের মধ্যে ৬৩) ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি (৩৬ পয়েন্টের মধ্যে ৩৩) কমানোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জনের কাছাকাছি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে তিনটি সূচককেই নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জন বা অতিক্রম করতে হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তিনটি সূচকের পয়েন্ট বাংলাদেশ অর্জন করেছে। যদিও এ পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, এ পরিসংখ্যান দিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়নের সূচক নির্দেশ করা কঠিন। তারপরও সরকার তা দেখিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্রেডিট নিতে যাচ্ছে। আমরা বলছি না, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশে পরিণত হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ শ্রেণীতে উঠার জন্য যে টেকসই উন্নয়ন দরকার, তা হচ্ছে কিনা? বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিলে, এ ধরনের উন্নয়ন গতি অত্যন্ত ধীর হিসেবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা জানি, দেশে বিনিয়োগের চিত্র খুবই করুণ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যে হারে হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর অবস্থা তথৈবচ। সেখানে লুটপাটের এক ধরনের মহোৎসব চলছে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার খবর ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাংক অনিয়ম, দুর্নীতি ব্যাপক হারে চলছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ধনিক শ্রেণী আরও ধনী হচ্ছে, গরীব আরও গরীব হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ত্রাহি অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে দেশ প্রকৃত অর্থে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণা আনন্দের হলেও, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তা অনেকটা শুভংকরের ফাঁকি হয়েই থাকবে। অবশ্য ক্রেডিট নেয়ার জন্য শূন্যে দাঁড়িয়েও সরকার ঘোষণা দিয়ে দিতে পারে। দিলে কে তা চ্যালেঞ্জ করতে যাবে? আর ভুক্তভুগী জনগণেরইবা কি আসে যায়!
চার.
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে উন্নতি করতে চায় না। তবে উন্নতি করতে চাইলেও সবাই তা পারে না। সক্ষমতার একটা পর্যায় পর্যন্ত সে থেমে থাকে। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করতে পারে রাষ্ট্র ও সরকার। এখন সরকার যদি উন্নয়নের ফাঁপা হিসাব দেখায়, তবে ঐ ব্যক্তিকে উন্নতির ফোকরে পড়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তার কথা বলারও উপায় থাকে না। সরকার যখন কঠোর হয়ে উঠে এবং জনগণকে দাবায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার সাথে পৃথিবীর কোনো শক্তিই কুলিয়ে উঠতে পারে না। আমাদের সরকার জনগণের সাথে অনেকটা এরকম আচরণই করছে। সরকার যা বলছে, তার সাথে দ্বিমত থাকলেও বলার উপায় নেই। সরকারের এখন উন্নয়নের পেছনেই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এই দৌড়াতে গিয়েই অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তা বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক, বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না কারণ, বিনাভোটে নির্বাচিত সরকার তার ক্ষমতায় থাকার বিষয়টিকে জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে। এই ভুলাতে গিয়েই অর্ধসত্য থেকে শুরু করে অনেক মনগড়া তথ্যও তুলে ধরছে। সরকারের এ চাতুরি যারা বোঝার তারা ঠিকই বোঝে। সামনে হয়তো আরও অনেক ধরনের চমকপূর্ণ চাতুরি জনগণ দেখতে পাবে। এসবই করা হচ্ছে এবং হবে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে। গণতন্ত্রকে নিপাত দিয়ে উন্নয়নের ফানুস উড়ানোর এই নীতির মাধ্যমে আর যাই হোক টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়ন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দুটোকেই সমানভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি কখনোই টিকে থাকতে পারে না।
ফধৎঢ়ধহ.লড়ঁৎহধষরংঃ@মসধরষ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়নশীল


আরও
আরও পড়ুন