Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ মর্যাদার, চ্যালেঞ্জও আছে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০২১, ১২:০৭ এএম

গত মাসের শেষের দিকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণের সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশের কারণে বাংলাদেশের ২০২৪ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা। তবে সরকার দুই বছর সময় চেয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদটি বাড়ানোর অনুরোধ করেছে। ২৪ হোক আর ২৬ হোক, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাচ্ছে, এটা দেশের জন্য সুসংবাদ এবং গৌরবের। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে এসে এ অর্জন আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য অর্থনৈতিক মুক্তির একটি ধাপ অতিক্রম করার মাইলফলক হয়ে থাকবে। এরপর উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ধাপটি অতিক্রম করতে পারলে ষোলকলা পূর্ণ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়ন সুষম ও টেকসইভাবে হচ্ছে কিনা? এ কথা অনস্বীকার্য, ৫০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। না হওয়াই স্বাভাবিক। একটি দেশের যখন জন্ম হয়, তখন তার প্রথম লক্ষ্যই থাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। মানুষের জীবনমানকে উন্নত করা। এ পর্যন্ত যত সরকার দেশ পরিচালনা করেছে, রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ ও ভেদাভেদের মধ্যে প্রত্যেকেই কম-বেশি উন্নয়নে কাজ করেছে। তা নাহলে, দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতো না। অবশ্য, সরকারের কাজই হচ্ছে, তার সক্ষমতা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন করা। বসে থাকা নয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারো পরিকল্পনা দ্রুত ফল দেয়, কারোটা ধীর গতিতে। উন্নয়নের বিষয়টি অনেকটা রেসের ব্যাটনের মতো। যে সরকারের কাছে যখন রেসের ব্যাটন থাকে সে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তা নিয়ে দৌড়াতে থাকে। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় তা আরেক সরকারের হাতে দিয়ে দৌড়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে, দৌড়ের গতি কম-বেশি হতে পারে। এই রেস চিরকালের, থামাথামি নেই। এটা এমন নয় যে, একযুগ আগে দেশের উন্নয়নের রেস ছিল না। ধীর হোক আর দ্রুত হোক, রেসের মধ্যে ছিল। এটা মনে করার কারণ নেই, গত একযুগের রেসের কারণে তা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে গেছে, আর বিগত চার যুগে কোনো উন্নয়ন হয়নি। যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজের পেছনে সরকারের যেমন অবদান থাকে তেমনি বেসরকারি খাত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অসংখ্য মানুষের অবদান থাকে। এই অবদান ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। বিষয়টি ৯০ মিনিটের ফুটবল খেলায় বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ৮৭ মিনিটে নেমে গোল দিয়ে দলকে জিতিয়ে দেয়ার মতো নয়। যে গোল দিল সব কৃতিত্ব তার। গোল দেয়া নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের। তবে ৮৭ মিনিট ধরে যারা খেলে এসেছে, তাদের অবদান তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কারণ, তারা দীর্ঘ সময় দলকে গোল খেতে দেয়নি। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির বিষয়টিও অনেকটা এরকম। এটি একটি ধারাবাহিক কার্যক্রম। এক সরকার শুরু করবে, পরবর্তী সরকার তা এগিয়ে নেবে বা শেষ করবে। এভাবেই দেশ এগিয়ে যায়।

দুই.
বাংলাদেশ বরাবরই জাতিসংঘ ঘোষিত লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি (এলডিসি) বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। প্রতি তিন বছর পর পর এ তালিকা পর্যবেক্ষণ করা হয়। দারিদ্র্য, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এই তিনটি বিষয়ের অগ্রগতি বিবেচনা করা হয়। গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই) বা বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় যদি ১১৯০ ডলার অতিক্রম করে, তবে লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রির তালিকা থেকে বের হওয়ার এক ধাপ অতিক্রম করা হয়। মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচক যদি ৬৬ বা তার বেশি অর্জন এবং অর্থনৈতিক সংকট সূচক ৩২ বা তার কম হয়, তবে এলডিসি তালিকা থেকে গ্রেজুয়েশনের মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারে। জাতিসংঘের পর্যালোচনায় ২০১৯ সালে বাংলদেশের মাথাপিছু আয়ের মানদন্ড নির্ধারিত ছিল ১২২২ ডলার। ঐ বছর বাংলাদেশের এই আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদন্ড ছিল ৭৫.৪। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ছিল ২৭। দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য তিন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানদন্ড অনুযায়ী যে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ তার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মানদন্ডের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। এর ফলে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করেছে। এটা আমাদেরকে একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ফেলে দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ ধরে রাখাই এখন বড় দায়িত্ব। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধারাবাহিকতা আগামী পাঁচ বছর বা ২০২৬ সাল পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। সূচক নিম্নগামী হতে দেয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা আয় বৈষম্য। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। এর চিত্র এখন সবারই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না-এমন শ্লোগান দেয়ার মতো কোনো দলও এখন নেই। ফলে আয় বৈষম্য লাগামহীন হয়ে পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের আয় বাড়াতে হবে সুষম গড় ভিত্তিতে। একজনের বার্ষিক আয় এক কোটি টাকা, আরেকজনের পঞ্চাশ হাজার বা এক টাকাও নেই, এই দুইজনের গড় আয় হিসাব করা অর্থহীন। এ ধরনের গড় আয় দিয়ে দেশের উন্নয়ন টেকসই করা যায় না। এতে কোন পণ্যের দাম বাড়লে কিছু মানুষ সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিসংখ্যান দিয়ে সবসময় সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয় না। এমনও দেখা গেছে, পরিসংখ্যান বলছে এক কথা আর বাস্তবতা তার বিপরীত। দেশের একশ্রেণীর মানুষের কাছে যে ব্যাপক অর্থ চলে গেছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেউ কেউ বলেন, দেশের বেশিরভাগ অর্থ কম-বেশি ২০ ভাগ মানুষের কাছে। এই ২০ ভাগ মানুষের অর্থ বাকি ৮০ ভাগ মানুষের আয়ের সাথে যুক্ত হয়ে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হচ্ছে। এটা কি কেউ কখনো ভাবতে পেরেছে, বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশের মানুষ সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে পারে? বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের অতি সাধারণ মানুষ তা শুনছে এবং অবাক হচ্ছে। গরিব দেশের বড় লোক মানুষ দেখতে কেমন হয়, এ ইচ্ছাও হয়তো তাদের জাগছে। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়, তারা এত অর্থ কোথায় পেল? কিভাবে পেল? বাংলাদেশে কি এত অর্থ আছে? তাদের এসব অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর বোধকরি সবাই জানে। সহজ উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশে যদি অর্থ না-ই থাকত, তবে তারা এত অর্থ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারত না। আছে বলেই নিয়ে যাচ্ছে। নিঃস্ব করে দিচ্ছে। এত অর্থ পাচারের মধ্যেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাচ্ছে। যদি পাচারকৃত অর্থ দেশে থাকত, তাহলে বাংলাদেশ কোথায় থাকত? বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে, তা করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকেই বলা হয়েছে। তবে করোনায় দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে, এর ফলে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার সূচক ঠিক আছে কিনা, তা পুনর্মূল্যায়নের অবকাশ রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কোটি কোটি মানুষের আয় কমে যাওয়া, দারিদ্র্যসীমা ও এর নিচে নেমে যাওয়ার কথা ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপে তুলে ধরা হয়েছে। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। কর্মজীবী অসংখ্য মানুষের আয় কমেছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থানের অন্যতম বৃহৎ খাত গার্মেন্টে করোনার যে ধাক্কা লেগেছে, তাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের তিনশ’র অধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। গার্মেন্টের বাইরে অন্যান্য খাতেও বেকারত্ব বেড়েছে। নতুন বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতেই উদ্যোক্তারা হিমশিম খাচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই, খরচ কমানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এর উপর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। রপ্তানি খাত, বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমেছে। অর্থনীতির এই ক্ষতি আগামী পাঁচ বছরে পুষিয়ে তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে কিনা তাই এখন প্রশ্ন।

তিন.
উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অনেক বড় অর্জন। সুষম বা অসম যেভাবেই হোক বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তার প্রাথমিক স্বীকৃতি। অস্বীকারের উপায় নেই, দশকের পর দশক ধরে যেসব রাজনৈতিক দল দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়ন নীতিই আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সরকারের এই নীতির পাশাপাশি শিল্পপতি, শিল্পোদ্যোক্তা থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিকের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে যে সুরম্য ও অত্যাধুনিক ও নান্দনিক ভবন গড়ে উঠেছে, তা এ দেশের উদ্যোগী মানুষের উন্নয়ন আকক্সক্ষার প্রতীক হয়ে রয়েছে। কৃষক-শ্রমিকের কর্মস্পৃহা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। এসব কর্মজীবী মানুষের মাঝেও কোটি কোটি মানুষকে কর্মহীন ও বেকার হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। করোনা এই পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। বেকারের এই বিশাল বোঝা নিয়েই দেশ এগুচ্ছে। তবে যে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা সেই গতি কি পাচ্ছে? পরিসংখ্যানে আমরা বরাবরই এগিয়ে। তবে যারা এই পরিসংখ্যান তৈরিতে জড়িত তারা কি দেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবনমানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারছে? তারা একটি স্বল্প পরিসরের চিত্রের মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘ বা বিদেশী সংস্থাগুলোও কি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারছে? তারা যেসব তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসে, তার বেশিরভাগই সরকারের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলে থাকে। আর সরকার কি কখনো উন্নতি ছাড়া, অবনতির কথা বলবে? বলবে না। এই যে করোনার কারণে দেশে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, তা কি সরকার বলছে? কর্মজীবী মানুষের আয় ও ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া, জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া নিয়ে কি সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের কি উদ্যোগ, তাও জানা যায় না। অথচ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমছে। এভাবে ক্রমাগত কমতে কমতে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হওয়ার পথে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয় এবং এভাবেই আগামী পাঁচ বছর চলতে থাকে, তাহলে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর পরিস্থিতি কি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পরপর বিশ্ববাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার পথ ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া এবং নতুন শিল্পের সমর্থন দেয়া সীমিত করতে হবে। এসব কারণে জিনিসপত্রের দামসহ সব ধরনের সুবিধার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে করোনার ধাক্কা সামলিয়ে আগামী পাঁচ বছরে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন কতটা করা সম্ভব, তা নিয়ে চিন্তার বিষয় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে বিশ্বের প্রভাবশালী ও ধনী দেশগুলো দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে, জাতীয় উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে কিনা। এর অর্থ হচ্ছে, দেশে আর্থসামাজিক ও প্রথাগত বৈষম্য কমছে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, উন্নয়নের পরিপূরক সুশাসন রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে কিনা। এর অর্থ, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার যথাযথভাবে রক্ষা করা হচ্ছে কিনা। দেখা যাচ্ছে, এই দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। আয় বৈষম্য ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে কোনো ভারসাম্য নেই। একটি শ্রেণীর উন্নয়ন আকাশসম, বেশিরভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। সুশাসনের বিষয়টি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। স্বাধীনমত প্রকাশের ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকুচিত। এ কারণে উন্নয়ন কর্মকান্ডে দুর্নীতির বিষয়গুলো চাপা পড়ে রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর খেসারত জনগণকেই দিতে হচ্ছে। কারণ, জনগণের অর্থেই বড় বড় মেগা প্রকল্পসহ সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা যখন এসব প্রকল্প থেকে অঢেল অর্থ নিয়ে যায়, তখন ভর্তুকি হিসেবে জনগণের অর্থই দিতে হয়। এতে জনগণের উপর ব্যাপক চাপ পড়ে। জনজীবনে টানাপড়েন দেখা দেয়।

চার.
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার মধ্যে যেমন মর্যাদার বিষয়টি জড়িত, তেমনি নানাবিধ ঝুঁকিও রয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্বল্পন্নোত দেশ যেভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা, রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা, সহজ শর্তে বিদেশি ঋণ ও অনুদান পায় তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ এখন যেমন কোনো রকম শুল্ক ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানসহ উন্নত বিশ্বে পণ্য রপ্তানি করতে পারে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে এসব সুবিধা পাবে না। মর্যাদার বিষয়টি হচ্ছে, বিশ্বে বাংলাদেশ গরিবী বৈদেশিক ঋণ ও সহযোগিতা থেকে বের হয়ে সম্মানজনক অবস্থানে যাবে। তখন হাত পাতা নয়, সমমানে দর কষাকষির মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় কি বাংলাদেশ আছে? করোনার আগ পর্যন্ত কিছুটা থাকলেও, এখন তো এক নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরও এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কারণ হচ্ছে, করোনায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। ধনী দেশগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। করোনায় আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের যে দুর্দশা তাতে সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এখন তার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের আয়-রোজগারের করুণ চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ব মন্দাবস্থার মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক সূচক ধরে রাখার মতো কঠিন কাজটি কতটা করা যাবে, তা অনুধাবন করা কঠিন। করোনার আগ পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে অবস্থায় ছিল তা প্রায় একযুগের ফসল ছিল। করোনার ধাক্কায় তা যেন হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়েছে। আগামী পাঁচ বছরে করোনাপূর্ব অবস্থাকে ছাড়িয়ে যাওয়া বা ঐ অবস্থায় নেয়ার পথটি যে কঠিন থেকে কঠিনতর হবে, তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে হলে, মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা কমানোর ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে দেখালে হবে না, মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে তা দৃশ্যমান থাকতে হবে। তা নাহলে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও করুণ হয়ে পড়বে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন