চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বাক্কা। মক্কার আদিনাম। কোরআন এটি উল্লেখ করেছে। বালু সাগর আরবিস্তানের একটি উপত্যকা। লু হাওয়া আর তপ্ত বালুর রাজ্য। যেখানে কোনো প্রাণ নেই। নেই কোনো সবুজের ছোঁয়া। নেই কোনো ফসলের হাওয়া। উপত্যকায় প্রবেশ পথটি সরু। রুক্ষ। তৃণগুল্মহীন পাহাড়সারি। তাই বুঝি এর নাম বাক্কা। অন্য তিনদিকে সরু গিরিপথ, উত্তর ও দক্ষিণে, আর পশ্চিমে লোহিত সাগর অভিমুখে। জনমানবহীন সেই উপত্যকায় প্রভুর নির্দেশে রেখে আসা হলো এক মা ও তাঁর ছেলেকে। যেই ছেলের বংশে জন্ম নিবে বিশ্বের সেরা মহামানব। ভবিষ্যত পৃথিবীর আলোর দিশারী। যার হাত ধরে মানবতা পাবে মুক্তি। কারা তাঁরা? তাঁরা হলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর স্ত্রী হাজেরা এবং শেষ বয়সে তাঁর প্রভুর কাছ থেকে নজরানা পাওয়া কলিজার টুকরা ইসমাইল আ.। কোনো খাবার নেই, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় জান বের হবার যোগাড়। দুধের শিশু তৃষ্ণায় ছটফট করছে। তপ্ত মরুভ‚মিতে পানি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবু মায়ের মন! ছুটতে থাকেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, কোথাও কোনো কাফেলা বা পানির হদিস পাওয়া যায় কি না? সেই আশায়। সেই পাহাড় দুইটি ইতিহাসের পাতায় সাফা মারওয়া নামে পরিচিত, স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত। এভাবে কয়েকবার ছুটাছুটির পর। হঠাৎ পেরেশান হাজেরা লক্ষ করলেন তাঁর মানিকের পায়ের নিচে কি যেন দেখা যায়! কি এগুলো? দৌড়ে আসলেন। পানি? হ্যাঁ, পানিইতো! যেন পানির প্র¯্রবণ বয়ে নিয়ে এলো অবিশ্রান্ত জলরাশি। কোত্থেকে এলো? চেয়ে দেখেন শিশু ইসমাইলের পায়ের গোড়ালীর আঘাতে তপ্ত বালুকারাশি ভেদ করে পানির ঝরণা চালু হয়ে গেছে। খুশিতে বাকরুদ্ধ মা হাজেরা বালুর আল দিয়ে পানি আটকাতে চেষ্টা করতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন জমজম... অর্থাৎ থামো থামো। তৈরি হলো জমজম ক‚প। সেই পানি যেমন সুপেয় তেমনি জীবনদায়ী, যেমন শীতল তেমনি তৃষ্ণানিবারণকারী।
সেই থেকে আজো অব্দি লক্ষ-কোটি মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করে চলছে। শেষ হওয়ার কোন নাম নেই, কোথায় সেই পানির উৎস? আজকের বিজ্ঞানও যেখানে অচল। পানির আকর্ষণে শত শত কাফেলা এ পথে এসেছে, বিশ্রাম নিয়েছে, এই স্থান পেয়েছে গুরত্ব। পেয়েছে সম্মান।
দিন পার হতে লাগলো। শিশু ইসমাইল বড় হতে লাগলেন। পানির আভাস পেয়ে আস্তে আস্তে সেখানে বসতিও বাড়তে লাগলো। ইসমাইল এখন কিশোর, বয়স তাঁর দশ কি এগার। পিতা ইবরাহীম তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে আদেশ প্রাপ্ত হলেন। তোমার প্রিয় বস্তু আমার রাস্তায় কোরবানী কর। চিন্তায় পড়ে গেলেন ইবরাহীম, আমার প্রিয় বস্তু! সেতো, ইসমাইল! প্রভুর পক্ষ থেকে পাওয়া উপহার। সাথে সাথেই রওনা হয়ে গেলেন বাক্কার পথে, আল্লাহর আদেশ পালনার্থে। পুত্রকে খুলে বললেন আল্লাহর আদেশের কথা। নবীপুত্র নবী এক কথায় রাজী, আসতে লাগলেন কোরবানী হতে। মা হাজেরা একবারও বলেননি ১০ টি বৎসর জনমানবহীন প্রান্তরে ফেলে রেখেছেন, এখন আমার ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন। পিতা পুত্র চলতে লাগলেন আল্লাহর আদেশ পূর্ণ করতে। পথে, মানবজাতির চূড়ান্ত দুষমন তাদের মনে প্রবঞ্চনা দিয়ে বাঁধা সৃষ্টি করতে থাকে। তাঁরা তখন সেই দুষমনকে পাথর নিক্ষেপ করে দূরে সরিয়ে দেন। ইসলাম সেই ইতিহাস জীবন্ত রেখেছে, কিয়ামত পর্যন্তই জীবন্ত থাকবে। কোরবানী হতে প্রস্তুত কিশোর নবী ইসমাইল। তাঁর পিতাকে বললেন, ‘আমি আপনার আদরের সন্তান, আমাকে কোরবানী করতে গিয়ে আপনার মায়া হতে পারে। হাত কেঁপে যেতে পারে। আপনি আপনার চোখদুটি বেঁধে তারপর আমাকে কোরবানী করুন।’ কিন্তু মালিক ভেবে রেখেছেন অন্য কিছু, যার বংশের এক মহামানবের হাতে সৃষ্টি হবে এক বিষ্ময় জাগানিয়া জাতির, তৈরি হবে নতুন ইতিহাস, সেই ইতিহাস ¯্রষ্টার ইতিহাস যে এখানেই শেষ হওয়ার নয়। আল্লাহ পাক জাতির পিতার কোরবানী কবুল করে নিলেন। সেই সাথে ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন বেহেশত থেকে পশু নিয়ে ইসমাইলের স্থলে কোরবানী করতে। সেই থেকে আজো পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নত হিসাবে ওয়াজিব মেনে ত্যাগের মহিমায় কোরবানী করে থাকে। আর বাক্কা, নবী পিতা-পুত্রের বদৌলতে পৃথিবীর মানচিত্রে মক্কা হয়ে স্বমহিমায় মহামান্বিত হয়ে আছে। থাকবে, যতদিন এই ধরার বুকে সূর্য আলো দেবে। যতদিন চাঁদ তার মায়াবী জোসনায় আমাদের মুগ্ধ করবে।
সেখানে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ। পৃথিবীর মধ্যস্থলে যার অবস্থান। ভৌগলিকবিদরা পৃথিবীর যেই ম্যাপ অংকন করেছে সেখানে দেখা যায় কাবাঘরটিই পৃথিবীর সেন্টারে। উত্তর মেরু উপরে দক্ষিণ মেরু নিচে রেখে যেই ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে সেখানে ক্বাবা সেন্টার আবার বিপরীতমুখী ম্যাপেও ক্বাবাঘর সেন্টার। (দক্ষিণ মেরু উপরে আর উত্তর মেরু নিচে।) নূহ আ. এর কওমকে ধ্বংসকারী প্লাবনে ক্বাবাঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেই ঘর আবার আল্লাহ তাআলা মেরামত করান ইবরাহিম আ. ও তার ছেলে ইসমাইল আ. এর হাতে।
দিন যেতে থাকে। জাহিলিয়্যাতের অন্ধকারে ছেয়ে যেতে থাকে এই পৃথিবী। আল্লাহর ঘর ক্বাবাকে ঘিরে শুরু হয় মূর্তিপূজা। এমনকি ক্বাবাঘরের ভেতরেও স্থাপন করা হয় মূর্তি। ঈসা আ. কে আল্লাহ তায়ালা তুলে নিয়ে গেছেন অনেকদিন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে পৃথিবী। কোথাও কোনো আলো নেই। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। কথায় কথায় খুন, রাহাজানী আর ডাকাতি যেখানে নিত্যদিনের রুটিন। বর্বরতা যাদের শিল্প। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া যেখানে অভিশাপ, জীবন্ত কবরস্থ হওয়াই যাদের নিয়তি। সেই কালো যুগে। প্রায় ৬০০ বছর হয় হয়। রাব্বে কারীমের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি এই মাটির পৃথিবীতে। অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদে আলোর দিশা দিতে। পথহারা নাবিকের বাতিঘর হয়ে।
৫৭০ ঈসভী। সুবহে সাদিক। এই ধরার বুকে উদিত হয় একটি নাম। লেখা হয় একটি ইতিহাস। তাঁর বর্ণনা দিবে কোন সে কলম? তাঁর স্তুতি গাইবে কোন সে শিল্পী? শুধু বলবো যার জন্য এত অপেক্ষা। এত আয়োজন। সেই মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সা. আগমন করেন এই মাটির পৃথিবীতে। যার আগমনে ইরানে হাজার বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুÐ নিভে যায়। দিকে দিকে জ্বলে উঠে লা শারীকাল্লাহ’র ঈমানী আলো। মানবতার অগ্রদূত, শান্তির শুভ্রকপোত আলোর দিশারী একজন বিপ্লবী জন্ম নেয়। কিন্তু সেই মহামানবকে তাঁর জন্মভূমি মক্কায় থাকতে দেয়নি নরাধম আবু জেহেল ও তার চেলারা। তিনি চলে যান মদীনায়। সেখানে হযরত মুহাম্মদ সা. কে রাজার বেশে বরণ করে নেয়। ধন্য মদীনা। ধন্য মদীনার ভাগ্যবান আনসারীরা। সেখান থেকেই নবী মুহাম্মদ সা. তাঁর মিশন ছড়িয়ে দেন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। সেই থেকে শুরু। মুহাম্মদী আদর্শের বিপ্লবী সন্তানেরা ১৫০০ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে শান্তির বার্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করে যাবে কেয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহর দুনিয়ার তার রাজ কায়েম করা পর্যন্ত সেই মিশনের কোনো সমাপ্তি নেই।
৬৩০ ঈসভী। অষ্টম হিজরী। মুসলমানের মহা বিজয়ের দিন। পৃথিবী থেকে মূর্তিপূজা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দিন। আল্লাহ রাসুল সা. সেদিন মহা বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন তাঁর জন্মভ‚মিতে। এক মহান বিজেতা হয়ে। সৃষ্টি করেন এক অনবদ্য ইতিহাস। অবাক পৃথিবী তাকিয়ে দেখে এক যুগন্তকারী বিজয়ী বীরকে। বিজয়ীর চেহারায় অহংকারের কোনো লেশমাত্র নেই। আছে ন¤্রতা, ভদ্রতা আর তার রবের কাছে শোকর গুজারকারীর এক মোহময় আবেশ। নেই কোনো ঔদ্ধত্য। আছে ক্ষমার মহত্ব। প্রতিশোধের কোনো কথা নেই। আছে বুকে জড়িয়ে নেয়ার মোহনীয় উচ্চারণ। মক্কা এখন রাসুল সা. এর পতাকাতলে। হুজুর ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন ক্বাবা ঘরে। হাতের লাঠি উঁচিয়ে ধরলেন। আঘাত করলেন শত দেব-দেবীর শিরকী মূর্তিতে। দীপ্ত কণ্ঠে নবী ঘোষণা করলেন। তেলাওয়াত করলেন “সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা (চিরতরে) বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবশ্য মিথ্যাকে বিলুপ্ত হতেই হবে।” সেদিন থেকে শুরু হওয়া শিরকী মূর্তির বিরুদ্ধে লড়াই আজো চলমান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেক্যুলার নামধারী মুসলমানের বাচ্চারা আজ মূর্তিপূজায় অংশ নিচ্ছে। ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা না থাকার কারণে “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” শয়তানি ¯েøাগানে নিজেকে শামিল করছে শিরকের মিছিলে। শিরক মুক্ত করার জন্য রক্ত, ঘাম এমনকি দেশ ছাড়তে হয়েছে আমার নবীকে। আজ সেই নবীর উম্মত দাবী করে আমরা ঘরে ঘরে মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছি। ভারতীয় সিরিয়াল নামক হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে আমরা আমাদের শোবার ঘরে ঢুকিয়ে প্রক্ষান্তরে দেব-দেবীকেই সঙ্গে নিয়ে ঘুমাচ্ছি। তাদের জায়গা করে দিচ্ছি নিজেদের ও কোমলমতি সন্তানদের মন-মস্তিষ্কে। চোখে তাদরে দৃশ্য, কানে তাদের আওয়াজ, বুকে তাদের চিত্র, চেতনায় তাদের চিহ্ন। ঈমান হারা মুসলমানের খোলস আমরা। একজন মুশরিকেরে চেয়ে কম কি সে? দুঃখে অন্তর ফেটে যায়। তাই মুসলমানদের কাছে করজোড় অনুরোধ থাকবে যেই মূর্তি ধ্বংস করার জন্য আমার নবী তায়েফের ময়দানে রক্ত ঝরিয়েছেন, ওহুদ প্রান্তরে দন্ত মোবারক শহীদ করিয়েছেন সেই নবীর উম্মত দাবী করে আমরা যেন মূর্তিপূজায় অংশগ্রহণ না করি। যদি অংশগ্রহণ করতেই হয় তবে নবীর উম্মতের খাতা থেকে নাম কেটে ভিন্ন পরিচয়ে করা চাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। নববী আদর্শে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।