শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আবুল মনসুর আহমদ [৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮ -১৮ মার্চ ১৯৭৯] বাংলা ব্যঙ্গ সাহিত্যের পথিকৃৎ। যদিও বাংলা ব্যঙ্গ সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তেমনভাবে বেড়ে ওঠার পথ পায়নি। তবু বলা যায় আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের হাত ধরে বাংলা ব্যঙ্গ সাহিত্য বেশ কিছু দূর এগিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ সাহিত্যে আকণ্ঠ মুগ্ধ হয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে তিনি সুচিন্তিতিত মন্তব্যও দিয়েছেন। বয়সে এঁরা ছিলেন একেবারেই সমসাময়িক। বন্ধুতাও ছিল গভীর। প্রিয় বন্ধুর লেখায় মুগ্ধ হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম সুচিন্তিত মন্তব্য করতে কার্পণ্য করেন নি। তাঁর মতে, বাংলা ভাষার ব্যঙ্গ সাহিত্য খুব উন্নত হয় নি। তার কারণ, ব্যঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টিতে অসাধারণ মেধার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা। সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। আমি একবার এক ওস্তাদকে লাঠি দিয়ে স্বরোদ বাজাতে দেখেছিলুম। সেবার সেই ওস্তাদের হাত সাফাই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম। আর আজ বন্ধু মনসুরের হাত সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান-মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদী হাত।
আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এইযে, সে ব্যঙ্গ যখন হাসায় তখন সে হয় ব্যঙ্গ কিন্তু কামড়ায় যখন তখন সে হয় সাপ। আর সে কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে তার ভাব হয় সাপের মুখের ব্যঙ্গেও মতই করুণ।
আবুল মনসুর আহমদ প্রধানত গদ্যলেখক। কিছু ব্যঙ্গ কবিতা ছাড়া তাঁর সব গ্রন্থ গদ্যে রচিত। তাঁর এ-গদ্য যেমন সাবলিল তেমনি স্বাতন্ত্রমÐিত। সরস বিদ্রƒপাত্মক বাক্য ব্যবহারে তাঁর পারঙ্গমতার জুড়ি নেই। বিশেষত আরবি-ফারসি-ইংরেজি শব্দের সঙ্গে চাতুর্যপূর্ণ শব্দ ব্যবহারে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভাষার ঐশ্বর্যে যেমন তেমনি বিষয় কথকতার ঐশ্বর্যে তাঁর প্রায় প্রতিটি গ্রন্থই স্বাতন্ত্রমÐিত ও বিপুলাকায়।
আবুল মনসুরের লেখায় নিজস্বতা রয়েছে। তাঁর অধিকাংশ লেখাই মৌলিক। এই লেখক সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামানের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, আবুল মনসুর আহমদের এসব রচনায় বিশেষ করে হুজুরকেবলার মত গল্পে পরশুরামের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু পরশুরামে যতটা রহস্য আছে ততটা বিষাদ নেই। আবুল মনসুর আহমদের সব গল্পেই আমাদের সংকীর্ণতা, শঠতা, অজ্ঞতা, অন্ধতা নিয়ে ব্যঙ্গের সঙ্গে দুঃখবোধ জড়িত। পরশুরাম ছবি এঁকেছেন, সমাজের সংস্কার তার লক্ষ ছিল না। আবুল মনসুর আহমদ সমাজের সংস্কার চেয়েছেন। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন তার গল্পে। এই উদ্দেশ্যমূলকতা যে শিল্পকে ছাড়িয়ে যায়নি, এটা তার একটা বড় গুণ। অধিকাংশ গল্পে তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের একেবারে ভেতরের কথা তুলে ধরেছেন। সেখানে আরবি-ফারসি শব্দবহুল ভাষা ব্যবহার করেছেন। রঙ্গ-ব্যঙ্গ রচনার জন্য আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার নতুন নয়। এখানেও তার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি ক্ষেত্রবিশেষে এমন সব আরবি- ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন কিংবা সে গুলোর এমন জোট বেঁধেছেন যে, অনেক সময় ওসব ভাষায় অজ্ঞ পাঠকের কাছে তার অর্থ অন্ধকারেই থেকে যায়। ধারণা করা যায়, এ সব ক্ষেত্রে অর্থ বোঝানোর উদ্দেশ্য তার ছিল না। যাদের উদ্দেশে ও সব শব্দ তার চরিত্রেরা প্রয়োগ করেছে গল্পে তারা অর্থ বুঝছে না কিন্তু তাদের পরম শ্রদ্ধেয় এ সব ভাষার শব্দ ও বাকভঙ্গি ক্রমাগত তাদেও শ্রদ্ধার উদ্রেক করছে। তারা যত কম বুঝছে, ততই সম্মোহিত হচ্ছে। এই সম্মোহন যে একটা সামাজিক ব্যাধি, লেখক সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন।
সাহিত্য বিশ্লেষক শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেন, বাস্তবপন্থী সাহিত্যিক অধিকাংশ সময় স্থানীয় পটভূমি বা যুগমানসের নিখুঁত চিত্রাঙ্কণের সাহায্যে সমসাময়িক ঘটনা বা কাহিনির অবতারনায়, অতি সাধারণ নরনারীর পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপায়ণে, বৈজ্ঞানিক বা বাণিজ্যিক সভ্যতায় পরিপুষ্ট শব্দসম্ভার গ্রহণেও সাধারণ, এমনকি প্রাকৃত- জনসুলভ ভাষা অনুকরণে তারা সাহিত্যকম্যের বিচিত্র রূপ সৃষ্টি করেন। বলাবাহুল্য সাহিত্যিক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদও সারা জীবন এই প্রচেষ্টায় রত ছিলেন।
আবুল মনসুর আহমদের অন্যতম একটি বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘আয়না’। এই গ্রন্থের সাতটি গ্রন্থই ব্যঙ্গ-রসাত্মক। গল্পগুলো হুযুর কেবলা, গো- দেওতা কা দেশ, নায়েবে নবি, লীডারে কওম, মুজাহেদীন, বিদ্রোহী সংঘ ও ধর্মরাজ্য। আয়নার হুযুর কেবলায় রয়েছে একজন ভÐ পীরের কাহিনি। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্য জঘন্য ভÐামীর আশ্রয় নেয় সে। গ্রামের মূর্খ সহজ-সরল মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে সে তার লক্ষে পৌঁছে। এই ভÐ পীর এক মুরিদের যুবতী স্ত্রীর রূপে আকৃষ্ট হয়, ক্রমেই আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। অবশেষে সে ছলনার আশ্রয় নিয়ে চক্রান্তপূর্বক ¯বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে এই যুবতী নারীকে বিয়ে করে। অথচ ইতোপূর্বে তার তিন-তিনটি স্ত্রী ছিল। কিšত ু তার এ ভÐামী ধরা পড়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক এমদাদের কাছে। উত্তেজনায় সে পীরকে শারীরিক আত্রমণ করে বসে। কিন্তু সুস্থ বুদ্ধির এমদাদকে পীর পাগল বলে আখ্যা দেয়। এভাবে লেখক হুযুর কেবলার চারিত্রিক কলুষতা আয়নার মত করেই পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
গো-দেও-তা কাদেশ গল্পে লেখক হিন্দু ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো পরিচ্ছন্ন ফুটিয়ে তুলেছেন। গো হত্যার কুফল বলতে যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে; তাতে তিনি প্রবল ধাক্কা দিয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে ইংরেজরা যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তারও যৎকিঞ্চিত পরিচয় পাওয়া যায় এ গল্পে। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা এ গল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয়।
ধর্মরাজ্য গল্পের বিষয়বস্তুও একই। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ভয়াবহ চিত্র আর ইংরেজদের কূটকৌশলের চিত্র তুলে ধরেছেন এ গল্পে।
এভাবে আবুল মনসুর আহমদ সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্ণিত করে গল্পের মাধ্যমে, ব্যঙ্গ-বিদ্রæপের ছলে সমাজের মানুষগুলোকে জাগাতে চেয়েছেন। মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোর চরম অবদমন দেখে তিনি নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেননি। মশি শক্তির সাহায্যে তিনি এদেরকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, সচেতন করতে চেয়েছেন। এ জন্যেই এই লেখক বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।