Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দেশীয় সংস্কৃতিতে ভারতীয় আগ্রাসন

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তৈমূর আলম খন্দকার : যুদ্ধ এখন ব্যয়বহুল যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফলে ভ‚-খন্ড দখলের চেয়ে নিজস্ব বাজার সৃষ্টি অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে দখলটা অনেক গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য সাংস্কৃতিকভাবে আঘাত হানাই যথেষ্ট।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসাতে গুম, খুন, অপহরণ, অগ্নিসংযোগের পরে ‘ধর্ষণ ও পরকীয়া’ সমাজ জীবনে মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে যে, জন্মদিন পালনের দাওয়াতে এসে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। পূর্বে আলোচনা হতো কার কন্যাকে কে বিয়ে করছে। এখন কার স্ত্রী কার সাথে পরকীয়ার টানে চলে গেছে, এ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। দিনে দিনে এ ধরনের সংবাদের প্রসার লাভ করছে। কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী আছেন যারা এ ধরনের কার্যকলাপকে কোন অপরাধ মনে করছেন না। এমনও অতি প্রগতিশীল রয়েছে যারা ভিন্ন ধর্মের হয়েও স্বামী-স্ত্রী রূপে একত্রে দাম্পত্য জীবনযাপন করছেন এবং তাদের সন্তানও রয়েছে। একই ঘরে দু’ধরনের ধর্ম পালিত হওয়ার অনেক পরিবার রয়েছে যারা এ ব্যবস্থাকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি মনে করছেন।
সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে এটাই প্রকাশ পায় যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা পশ্চিমা ধর্মহীন সংস্কৃতির দিকে দ্রæত ধাবিত হচ্ছে। ২০০৩ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগটা শহরে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য গিয়েছিলাম (তখন আমি বিআরটিসি’র চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি)। সেখানে মানোকসো নামে একজন যুবককে আমার প্রোটকল ডিউটি দেয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য আমি সেখানে ২১ দিন ছিলাম। রাষ্ট্রীয় পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মানোকসো আমাকে কয়েকদিনই বলেছে যে, উইক এন্ড অর্থাৎ সপ্তাহ শেষে প্রতি শনিবার তাকে সন্ধ্যার পূর্বেই ছুটি দিতে হবে। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ছুটি নিয়ে তুমি কী করবে? তখন সে আমাকে জবাব দিয়ে বললো, প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমি মিলিত হয়ে একত্রে ড্রিঙ্ক করি। তাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাও না? সে বললো, আমার মা আমার পিতাকে ছেড়ে তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে পূর্বেই চলে গেছে। এখন আমার পিতা অন্য মহিলার সাথে গেট টুগেদার করে। আমার সাথে পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই, তবে মা’র সাথে কোনো কোনো সময় দেখা হয়। যখন সে আমাকে কথাগুলি বলছিল তখন তার চেহারায় বিষণœতার ছাপ লক্ষ করলাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি তোমার পারিবারিক এ অবস্থাকে সমর্থন কর? উত্তরে তার ভাষায় সে বললো, ও ফড় হড়ঃ ৎবপড়সসবহফ রঃ. যুবকের কথা শুনে আমার মনে হলো, একটি ধর্মহীন সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের ঘটনা কোন বিষয়ই নয়, কিন্তু আমাদের দেশে সমাজ ব্যবস্থা যেখানে মানুষ ধর্মকেই প্রাধান্য দেয় সেখানে এ ধরনের ঘটনা অনেক বড় কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু পত্রিকার পাতা খুললেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অবাধ যৌনাচার তথা বিবাহ বন্ধন বহির্ভূত ঘটনা দিন দিন মহামারী আকার প্রসার হচ্ছে, যা ভারতীয় টি.ভি সিরিয়েলেও দেখা যায়। এটাও প্রকাশ পাচ্ছে যে, ভারতীয় সিরিয়েলের প্রতি দেশের নারী ও যুবসমাজ ঝুঁকে পড়েছে এবং এসব সিরিয়াল দেখতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক স্বামী-স্ত্রীর সংসার পর্যন্ত ভেঙ্গে গেছে। এসব সংবাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি কি আকৃষ্ট হয় না? ভারতে বহুবার গিয়েছি। সেখানে হোটেলে বসে বাংলাদেশের সংবাদ বা নাটক দেখার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। কারণ ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখানো হয় না; যদিও আমরা বন্ধু রাষ্ট্র। ভারতীয় পণ্যের মার্কেট বাংলাদেশ। শুধু পণ্য নয়, মাদকের সরবরাহ এখন কোথা থেকে হচ্ছে তা কি সরকার খতিয়ে দেখছে? কথা বললে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় কি? তার চেয়ে বড় বিষয়, বন্ধুত্বের জন্য জাতীয় স্বার্থ আমরা কতটুকু জলাঞ্জলি দিতে পারি?
মানুষ সামাজিক জীব। কুকুর, বিড়াল, গরু, বাঘ, সিংহ তারাও জীব বা প্রাণী, কিন্তু সামাজিক জীব নয়। তারা সামাজিক জীব নয় বিধায় তাদের অনুশাসনের বা নিয়ম কানুনের প্রয়োজন পড়ে না। ধর্মীয় অনুশাসনই সমাজকে একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসে। কিন্তু সেই অনুশাসনকে প্রগতির নামে নষ্ট করার জন্য একশ্রেণির বিকৃত সংস্কৃতিমনা সাংস্কৃতিক সেবীদের গভীর মনোনিবেশ চলছে। ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে কীভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা যায় সে দিকে নজর দিয়েই চলছে তথাকথিত সংস্কৃতি শিল্পের উন্নয়ন। প্রায় উলঙ্গ হয়ে নৃত্য পরিবেশন করা গানের নাম দেয়া হয়েছে ‘আল্লাহ মেহেরবান’ অথচ কঠোরভাবে পর্দা করার জন্য আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর উপর ন্যূনতম যার শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে সে নারী কখনো বুক ফুলিয়ে বেপর্দা হবে না। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী এবং হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) অতি আদরের কন্যার নাম হযরত আয়েশা (রা.); যিনি সর্বাধিক হাদিসের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, তাকে হেয় করার জন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ‘আল্লাহ মেহেরবান’ শিরোনামের গানে যে উলঙ্গ নৃত্যটি পরিবেশন করা হয় সেখানে নর্তকীর নাম দেয়া হয়েছে আয়েশা। শুধু মাত্র মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য উলঙ্গ নটীর নাম উক্ত মহিয়সী নারীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ভারত নামে মাত্র একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু এর মূল চেহারা সাম্প্রদায়িক; যারা ইসলাম ও মুসলমানদের সহ্য করতে পারে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রের চেয়ে ভারতে বেশি হয়েছে। জাতিগত দাঙ্গাতেও ভারত শীর্ষে। ভারতীয় অনেক লেখক মুসলমানদের হেয় করে উপন্যাস প্রবন্ধ লিখেছেন। সমাজ বিরোধী লোকটিকে নাটকের চরিত্রে দাড়ি-টুপি লাগিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। এতে প্রগতিবাদী মুসলমানদের সন্তানরাও হিন্দুস্থানী নাস্তিক লেখকদের সাথে হাত মিলিয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার অনুক‚লে নয়। বরং ভারতীয় কালচারকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা বেশি আগ্রহী। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তারা মাথা ঘামান একটু বেশি। শেখ হাসিনা সরকারও মনে করে, ভারত খুশী তো পৃথিবী খুশী। এমতাবস্থায়, যে কোন অবস্থান বা যে কোন সেক্রিফাইসের মাধ্যমে হলেও ভারতকে খুশী রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে কোলকাতামনস্ক বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন। আল্লাহ ও নবী করীম (সা.)-কে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াসে যখন একটি বøগার গোষ্ঠির সৃষ্টি হয় তখন তাদের মুক্তচিন্তার লেখক বলে আখ্যায়িত করেছিল এ দেশের তথাকথিত প্রথিতযশা সংস্কৃতিসেবী বুদ্ধিজীবীরা। মুক্তচিন্তা, নাস্তিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী অনুশীলন প্রাধান্য পাওয়ায় আজ সমাজ থেকে পারিবারিক শান্তি চলে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অস্থিরতা।
আইন থেকে অনুশাসনের উৎপত্তি। ধর্মীয় আইনও একটি অনুশাসন। পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় আইন পারিবারিক বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইনের মর্যাদা পাচ্ছে এবং আদালতও এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিপত্তি শুধু নাস্তিক, বøগার ও প্রগতিবাদীদের ক্ষেত্রে; যারা ধর্মকে আঘাত করা সম্মানজনক মনে করে। মুসলমান নামধারী নাস্তিকদের কারণেই তারা এ সাহস পাচ্ছে, যার পিছনে রয়েছে ভারত ও পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতা।
বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আগ্রাসী হওয়া সুবিধাজনক, বাংলাদেশের ব্যাপারে তাই হচ্ছে। কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার পর অনেক পাঠকই ভারতবিরোধী আর্টিকেল না লেখার জন্য আমাকে পরামর্শ দিয়েছে। দেশকে ভালোবাসতে হলে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে, নতুবা তা হবে জাতির সাথে মোনাফেকি। আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমার কলম চলতেই থাকবে, তা যে কোন প্রকার ঝুঁকি নিয়েই হোক না কেন। একজন কলামিস্ট হিসেবে ফরহাদ মজহারকে যতটুকু চিনি, তাতে রাজনৈতিকভাবে তিনি কট্টর সরকারবিরোধী কোন লেখক নন। তবে ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী। ফরহাদ মজহারের পরিবার ও তার বক্তব্যে তিনি অপহরণ করার কথাই স্পষ্টভাবে বলে যাচ্ছেন, এখনো নিরাপত্তাহীনতার কারণে চিকিৎসার নামে হাসপাতালে নির্বাসনে আছেন। পুলিশ ও ফরহাদের পরষ্পর বিরোধী বক্তব্যে দেশবাসী কোনটাকে বিশ্বাস করবে? দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা নেই। এ উন্নয়ন দেশবাসী চায় না। ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে মানুষ নিরাপদ জীবনযাপন করবে এটাই তার প্রথম চাওয়া, উন্নয়ন পরের কথা। মনে শান্তি না থাকলে ইট-সিমেন্টের উন্নয়ন দিয়ে কী হবে?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আগ্রাসন

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ