Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে দাঁতসহ মুখ গহ্বরের রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি

টুথপেস্ট মাজনে দাঁতের সর্বনাশ

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : মানহীন টুথপেস্ট এবং মাজন ব্যবহারে সারাদেশে মানুষের দাঁতসহ মুখ গহ্বরের রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে। দাঁত পরিষ্কারে বিভিন্ন কোম্পানীর চটকদার বিজ্ঞাপণে প্রতারিত হয়ে এসব টুথপেস্ট/মাজন কিনছে সাধারণ মানুষ। যার গুণাগুণ বিচারের কোন সুযোগও থাকছে না। এ সব পণ্য ব্যবহারে তাই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বিভিন্ন রোগ। মুখের রোগবালাই বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করে এমনটাই তথ্য দিচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে দাঁতের ক্ষয়, মাড়ি ফোলা, দাঁত দিয়ে রক্ত ও পূঁজ পড়া, মুখের দুর্গন্ধ, ঠান্ডা পানি ব্যবহারে দাঁত শিরশির করা রোগী উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। তাদের মতে এর মূল কারণ হলো মুখগহ্বরে অম্লীয় (এসিড) প্রবেশ।
কয়েকটি কোম্পানির বাজারজাতকৃত পণ্যের গায়ে লিখিত বর্ণনা থেকে জানা গেছে, এ সকল পেস্টে সাধারণত সোডিয়াম ফ্লুরাইড, সোডিয়াম লরেল সালফেট, ট্রাইক্লোসান, হাইড্রেটেড সিলিকা, ক্রুড ওয়েল, আর্টিফিসিয়াল সুইটনার, ইথানোলামিন ও মাইক্রোবেড জাতীয় কেমিক্যাল সমৃদ্ধ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, টুথপেস্টের মোড়কে লিখিত এ সকল উপাদানে ক্ষতিকর কেমিক্যালের উপস্থিতি রয়েছে। আর রাসায়নিক মিশ্রিত এসব পেস্ট ব্যবহারে মানুষের মুখগহ্বরের ক্যান্সারসহ মানবদেহে বিভিন্ন রোগব্যাধি বাসা বাঁধছে।
দন্ত চিকিৎসকরা বলছেন, অতিরিক্ত মিহি শর্করা খাদ্য যেমন কেক, বিস্কুট, চানাচুর, সফট ড্রিংস বা কোমল পানীয়, চকোলেট, বিভিন্ন রংয়ের আইসক্রিম, ফাস্টফুড (এক ধরনের কৃত্রিম খাবার)। এ সব খাওয়ার পরে মুখের ভিতর ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদন বৃৃদ্ধি করে। ফলে স্টাফ্লিকোসিস নামক ব্যাকটেরিয়া মুখগহ্বরে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন করে, যাতে দাঁতের অত্যন্ত মজবুত এনামেল ক্ষয় করে গর্তের সৃষ্টি হয়। আর দাঁতের এনামেলে কোন রক্তনালী স্নায়ু সংযোগ না থাকায় মানবদেহ সহজে ক্ষয় পূরণ করতে পারে না। এভাবে ক্যালসিয়াম সরে গিয়ে গর্ত সৃষ্টি ও ল্যাকটিক এসিডের ব্যথার কারণে পূঁজ ও দুর্গন্ধ উৎপন্ন করে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নাল ও গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে রোগ সৃষ্টিকারী প্রায় ৭০০ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আছে। এর ৫০ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া মুখ গহ্বর জন্মাতে ও বংশ বিস্তার করতে পারে। এই সব জীবাণুর কারণে সাধারণত ডেন্টাল ক্যারিজ বা দাঁতের ক্ষয়, জিনজিভাইটিস বা মাড়ির প্রদাহ, পেরিও ডেন্টাল ডিজিজ, ওরাল ক্যান্সার, মুখে ক্ষত ও দুর্গন্ধ হয়। এ জন্য ওরাল হাইজিন বা নিয়মিত মুখের যতœ দরকার। অথচ দেশে ওরাল কেয়ার বলতে শুধু নামিদামি প্রতিষ্ঠানের টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজা বা মাউথ ওয়াশকেই বোঝায়। কিন্তু পুষ্টিকে বাদ দিয়ে চিকিৎসক বা পরিচর্যা কেন্দ্রে না যাওয়ায় এ রোগের হার বেড়েই চলছে। অন্যদিকে প্রচার নির্ভর পেস্ট ব্যবহার ও দৈনন্দিন খাদ্যভাসের ফলে শরীরে জ্যামিতিক হারে রোগব্যাধি বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্যের ওপর উচ্চতর গবেষণা করা ডা. হাবিবুর রহমান থমসন. এ. গ্রিফিন, পি. স্টুয়েটস ও কার্টমেলের ‘ওয়াটার এনভাইরনমেন্ট রির্চাস’ শীর্ষক বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বেশিরভাগ টুথপেস্টে অ্যান্টিবায়োটিক্যাল এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় ট্রাইকোলসান উপাদান। এই রাসায়নিকটি অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স ও অন্তক্ষরা গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে ব্যঘাত ঘটায়। এমনকি ব্রেস্ট, ওভারিয়ান ও প্রোস্টেট ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। ইউনাইটেড স্টেট এনভাইরনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) এটাতে বিষক্রিয়া আছে উল্লেখ করে মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলেছেন। এই রাসায়নিক উপাদানটি সাধারণত শরীরের অ্যালার্জি, চোখ ও চাঁমড়া জ্বালাপোড়া, চুলকানী, ক্ষত বৃদ্ধি, রক্ত সংবহনতন্ত্রের খিচুনি, বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি, লিভার, কিডনী ও লাং সেলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্পগবেষণা ইনস্টিটিউট (বিসিএসআইআর) জানায়, ট্রাইক্লোসান মূলত সাবান, টুথপেস্ট, মাউথ ওয়াশ, ডিওডরেন্ট, শ্যাম্পু, ক্লিনিং সাপ্লাই ও পেস্টিসাইডে ব্যবহার করা হয়। কানাডার হেলথ রিভিউতে বলা হয়েছে এটা মানবদেহের জন্যে খুব বেশি ক্ষতিকর নয় তবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করায় এটা পরিবেশের ক্ষতি করে। এছাড়া ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর এফডিএ ইস্যুকৃত ‘ফুড এ্যন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ জানায়, ট্রাইক্লোসানে ১৯টি রাসায়নিকের সক্রিয় উপাদান রয়েছে।
অপরদিকে ‘কসমেটিক ইনগ্রিডিয়েন্ট রিভিউ (সিআইআর-২০০৫)’ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সোডিয়াম লরেল সালফেট মুখে ফেনা তৈরি করে জিহ্বার স্বাদ গ্রন্থির প্রকৃতি পরিবর্তন করে, মুখ গহ্বরের ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে। বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরির গবেষণায় দেখা গেছে, এটা মূলত লন্ড্রি ডিটারজেন্ট, স্প্রে ক্লিনার এবং গৃস্থ্যলি সামগ্রী পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে মানুষের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন কসমেটিক্স পণ্যে এই উপাদানটি শূন্য দশমিক ১ থেকে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি রয়েছে। যেটার ব্যবহারে চোখ ও চামড়ার জ্বালাপোড়া, চুলকানী, শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। এমন কি অতিরিক্ত ব্যবহার ও খাওয়ার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, পেস্ট ছাড়াও বাজারের, চকোলেট, লজেন্সসহ বিভিন্ন কৃত্রিম খাবার ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এন্টিবায়োটিক্যাল সুইটনার। এই মিষ্টি অনুভূতি সৃষ্টিকারী উপাদানটি মুখের ভিতরের পিএইচ মাত্রাকে অতিরিক্ত অ¤øীয় করে। ফলে তা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা ও শরীরের দুর্বলতা দেখা দেখা দিতে পারে।
‘জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অফ টক্সিকোলজি’ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই উপাদানটি মুখ গহ্বরের কোষ দ্বারা শোষিত হয়ে মস্তিষ্ক, লিভার, হার্ট, কিডনীতে অবস্থান করে শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে থাকে। মুখের ক্ষত বাড়ায়, অন্তক্ষরা গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে বাধা সৃষ্টির করে হরমোনাল ডিজঅর্ডার দেখা দেয়। এছাড়া পেস্টে ব্যবহৃত হাইড্রেটেড সিলিকা উপাদানটি মূলত দাঁত সাদা করার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই পদার্থটি বালি, কোয়ার্টজ ও ফ্লিন্ট পাথর থেকে সংগ্রহ করা হয়। যা দাঁতের বাহিরের শক্ত আবরণ নষ্ট করে ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটকে আলাদা করে দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করে থাকে।
সূত্রমতে, টুথপেস্টকে রঙিন করার জন্য এফডি এবং সি-ব্লু নামক রং মেশানো হয়। যেটা ক্রুড অয়েল থেকে উৎপন্ন আর এই ক্রুড অয়েল মূলত আলকাতরা থেকে উৎপাদিত হয়। যার ব্যবহারের ফলে সন্তান জন্মদানে সমস্যা, চোখ ও চামড়া জ্বালপোড়া, কিডনী, লিভার ফাংশনে সমস্যা সৃষ্টিসহ মুখের ক্যান্সার ও শারীরিক দুর্বলতা এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশ নষ্ট করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদাহরণ দিয়ে এক দন্তচিকিৎসক জানান, সব পেস্টেই একটি ব্যবহৃত উপাদান হলো সোডিয়াম ফ্লুরাইড, যার বিষক্রিয়া খুবই মারাত্মক। অথচ ডবিøওএইচও মতেÑ দাঁতের জন্য সহনীয়মাত্রা সোডিয়াম ফ্লুরাইড হলো শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। যা দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এটি স্নায়ুবিক রোগ তৈরি ও অন্তক্ষরা গ্রন্থির কাজ কর্মে ব্যঘাত ঘটিয়ে বিভিন্ন হরমোনাল ব্যাধি সৃষ্টি করে দাঁতের ক্ষয় ত্বরান্বিত করে। শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, বমিবমি ভাব, খাদ্যনালীর খিচুনি, মাংসপেশির অসরতা, হৃদপিন্ড, শ্বাসতন্ত্র ও কিডনী বিকল রোগের কারণ হতে পারে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী বিভাগের দন্তচিকিৎসক ডা. লিটন ভূষণ হাওলাদার বলেন, কৃত্রিম ও সুগার জাতীয় খাদ্য গ্রহণে বাধা নাই। তবে অ্যালকোহল খাবার পরিত্যাগ করে ওরাল হাইজিনের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া পেস্টে কোন ক্ষতিকর উপাদান আছে কিনা সেটা বের করা কেমিস্টদের কাজ। তবে এসব পণ্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমেই বাজারজাত করা হয়।
তিনি বলেন, প্রতিটা মেডিসিনেরই ভালোমন্দ দিক আছে। কিন্তু সাময়িক ক্ষতির দিক চিন্তা করে পরিহার করলে সেটা আরো বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। সুস্থতার জন্য কিছুটা ক্ষতি হলেও তা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কতটুকু মাত্রায় ক্ষতিকর উপাদান আছে সেটা নিয়ে দেশে গবেষণা নাই। তবে স্যান্ডি জাতীয় উপাদান যেটা দাঁত পরিষ্কারের জন্য ভালো কিন্তু বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এর জন্য গবেষণার দরকার। আর চিকিৎসকরা সাধারণত মুখ পরিষ্কার রাখতে ভালো ব্রাশ ও পেস্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে সেটির কোয়ালিটি নিশ্চিত করে নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম লুৎফুল কবির বলেন, পেস্ট ও মাজনের মান সাধারণত বিএসটিআই নির্ধারণ করে। তবে বাজারে অনেক পেস্ট ও মাজন আছে যাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দেয়া হয়। এতে দাঁতের উপরিভাগের অত্যন্ত মজবুত এনামেল ক্ষয় করে। দাঁতের ক্যালসিয়াম সরে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি করে। আর দাঁতের এনামেলে কোন রক্তনালী স্নায়ু সংযোগ না থাকায় মানবদেহ সহজে ক্ষয় পূরণ করতে পারে না। এভাবে ক্যালসিয়াম সরে গিয়ে গর্ত সৃষ্টি ও ল্যাকটিক এসিডের ব্যথার কারণে পূঁজ ও দুর্গন্ধসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঝুঁকি

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ