শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ড. গুলশান আরা : বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীল গদ্যকার হিসেবে মোহাম্মদ বরকতুল্লার পরিচিতি একক এবং অনন্য সাধারণ। কারণ তিনি এমন সব বিষয়কে প্রবন্ধের বিষয় করেছেন যা তার আগে অথবা পরেও তেমনভাবে লিখিত বা আলোচিত হয়নি। দার্শনিক ধ্যান-ধারণা, জড়বাদ, চৈতন্য, বস্তুরূপ ও জীবন প্রবাহ ইত্যাদি অত্যন্ত দুরূহ তত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। লিখেছেন সুফি দর্শন, সুফি মত ও বেদান্ত দর্শন যা বরকতুল্লার অবিস্মরণীয় অবদান।
আজকের নিবন্ধে আলোচ্য বিষয় মোহাম্মদ বরকতুল্লার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘অনন্ত তৃষা’। এ প্রবন্ধে তিনি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে দেখিয়েছেন বস্তু জগতের সাধারণ ধর্ম মূলত কোনটি এবং কেনইবা বস্তু জগৎ তার সহজাত ধর্মকে আঁকড়ে রাখতে চায়। এর জবাবে বরকতুল্লাহ লিখেছেনÑ ‘বস্তুজগতের সাধারণ ধর্ম আত্মপ্রতিষ্ঠা। সামান্য লোষ্ট্র খ- যে স্থানে বসিয়া আছে, সেখানে তুমি বসিতে পারিবে না। যতই কেন ক্ষুদ্র হোক না, সে যেখানে আপন অধিকার সাব্যস্ত করিয়া লইয়াছে সেখান হইতে সে সহজে নড়িবে না। তাহাকে সরাইতে চেষ্টা কর সে প্রতিরোধ করিবে। তুমি তাকে পদাঘাত কর, সেও প্রতিঘাত করিবে, তোমার পায়ে বেদনা দিবে। ... তাকে খ-ে খ-ে বিভক্ত করিতে চেষ্টা কর, সে তোমার শক্তিকে সাধ্যমতো ব্যাহত করিবে। তাহার অনুকণাগুলি একে অন্যকে আঁকড়াইয়া থাকিবে; যেন তারা সব পরস্পর ভাই। প্রবলতর শক্তি যখন তাহার অঙ্গে ক্রমাগত আঘাত করিতে থাকে তখন তাহার আহত শরীরে বেদনার চিহ্ন ফুটিয়া উঠে। এরা এক একটি শক্তি কেন্দ্র।
... কোনও এক অলক্ষ্য শক্তি যেন তাহাদের ভিতরে থাকিয়া তোমার বিরুদ্ধে তাহাদের মরণ পণ বিদ্রোহ জাগায়।... বাঁচিয়া থাকিবার জন্য বস্তুর ভিতর এই যে অজ্ঞাত প্রয়াস, একি শুধু তার অনুতে বিচ্ছুরিত কোনও যৌগিক শক্তির প্রভাব মাত্র, না পদার্থের ভিতর এক অবচেতন অবলুপ্ত আত্মার গোপন অবস্থিতির সক্রিয় প্রকাশ? চুম্বকের ভিতর কিসের অনুভূতি জাগে লৌহের সান্নিধ্যে, সে সচেতন প্রাণীর মতো লৌহকে চাপিয়া ধরে। দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটা কোনও দূরাগত আকর্ষণ অনুভব করে? সে পতিব্রতা নারীর মতো সদা সুমেরুর দিকে মুখ করিয়া থাকে; চেষ্টা করিলেও তার মুখ অন্যদিকে ফিরান যায় না। সাগর-বাড়ি কোন অনুভূতির ফলে দূর আকাশে পূর্ণ চন্দ্রের আগমনী বুঝিতে পারে?... আকাশের সূর্যে কি ইচ্ছাশক্তি নিহিত আছে যাহা দুরন্ত বালকের ন্যায় ঐ বিশাল গ্রহগুলিকে বাঁধিয়া নির্ধারিত চক্র-পথে অবিরাম ঘুরাইতেছে?’
জড়সূত্র বিশ্লেষণের পর লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন উদ্ভিদ জগতের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। আমরা জানি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছেন গাছের প্রাণ আছে আর মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ প্রমাণ করতে চেয়েছেন প্রাণময় সেই বৃক্ষরাজির কি বিচিত্র প্রচেষ্টা উৎসব প্রতিনিয়ত চলছে তাদের টিকে থাকা বা আত্মপ্রতিষ্ঠায়। তিনি লিখেছেনÑ ‘সামান্য লতাটিও প্রকৃতির সহিত অহর্নিশ বুঝিয়া আপনার অধিকার দৃঢ় করিতেছে। শিকড়ের সূক্ষ্ম অঙ্গুলি দিয়া সে মৃত্তিকার বুক চিরিয়া রস পান করে; পাতার বেষ্টনী গড়িয়া আলো ও বাতাস হইতে চৌথ সংগ্রহ করে। .... যেদিকে কিছু লম্বমান থাকে সেই দিকে তার কোমল তন্ত্রীগুলি ডানা মেলিয়া তিলে তিলে অগ্রসর হয় ও পরিশেষে উহাকে জড়াইয়া ধরে। কিসে ঐ আশ্রয়হীন লতার অন্ধ তন্ত্রগুলির ভিতর উহার অজানা লক্ষ্যের দিকে অনুভূতি জাগায়? কোন্্ প্রচ্ছন্ন বুদ্ধির প্রবাহ সেগুলিকে অলক্ষ্যে চালিত করিয়া কোনও আসন্ন তরু-শাখায় বা শুষ্ক দ-ে সুকৌশলে ঘিরিয়া ঘিরিয়া জড়াইয়া দেয়? আত্মপ্রতিষ্ঠার কি বিচিত্র উৎসব ঐ লতার জীবনে পরিস্ফুট। তৃণের নবজাত অঙ্কুরের অভ্যন্তরীণ কোন্ অনুভূতি উহাকে অন্ধকার মাটির গহ্বর হইতে আলোকের জগতে পথ দেখাইয়া আনে? উহার কচি দেহ কোন্্ শক্তির বলে নিজের অপেক্ষা সহ¯্র গুণ ভারী মাটির বোঝা ঠেলিয়া অবলীলাক্রমে বাহির হইয়া আসে?’
আত্মপ্রতিষ্ঠার এমন কঠিন সংগ্রামের লীলাক্রমে লেখক বরকতুল্লাহ কত চমৎকার উপমায় ফুটিয়ে তুলেছেন, যা সাধারণ পাঠকেরও হৃদয়ঙ্গম করতে অসুবিধা হয় না। এখানেই কীর্তিমান লেখকের কৃতিত্ব। বরকতুল্লাহ গভীর উপলব্ধিতে প্রত্যক্ষ করেছেন, ‘জীব জগতের এই আত্মপ্রতিষ্ঠার ধর্ম অধিকার বিস্তৃত দেখিতে পাওয়া যায়। (চৎবংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ংবষভ বীঃবহফবফ ঃড় ঢ়বৎঢ়বঃঁধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ংবষভ.) জীব শুধু বাঁচিয়া থাকিয়াই সন্তুষ্ট নহে, সে যুগ-যুগান্তরের ভিতর দিয়া আপনাকে প্রসার করিতে চাহে। অর্থাৎ সে সন্তান-সন্ততির ভিতর দিয়া নিজে চিরকালই বাঁচিয়া থাকিতে ব্যাগ্র। সেই জন্যেই জীব জগতে সন্তান বাৎসল্যের এরূপ প্রবল অভিব্যক্তি। ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতে পাখি, চতুস্পদ জন্তু এবং মনুষ্য। সকলের মধ্যেই এই সন্তান-বাৎসল্য পরিস্ফুট হইয়াছে। .... মানুষও এই নিয়মের অধীন। মানুষ যুগ-যুগান্তরের ভিতর দিয়া নিজেকে অন্ততকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাখিবার জন্য জীবনব্যাপী চেষ্টা করিতেছে। ... সে নিজেই সন্তান-সন্তুতির ভিতর দিয়া যুগ যুগ ধরিয়া আপনার ভোগ লিপ্সা চরিতার্থ করিবে। সন্তান যে তাহারই নিজেরই নব সংস্করণ।’
আত্মপ্রতিষ্ঠার চিরন্তন আবেগে প্রকৃতিতে যে চরম সত্য নিত্য বহমান তার সঙ্গে মানুষের সামান্য হলেও পার্থক্য আছে। কি সেই পার্থক্য? এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ বরকতুল্লার মন্তব্যÑ ‘মানুষ শুধু জৈব শক্তির অভিব্যক্তি নয়, মানুষের আরও একটি নতুন শক্তির বিকাশ আছে। উহার নাম আত্মা।
আত্মাও চিরকাল বাঁচিয়া থাকিতে উৎসুক। মরণ মানুষের দৈহিক জীবনে সমাপ্তি আনিয়া দেয়, কিন্তু আত্মা তার পরও বাঁচিয়া থাকিতে চায়। তাই মৃত্যুর পরপার সম্বন্ধে মানুষের এত জল্পনা-কল্পনা। সংসারের এই মায়া বন্ধন, এই আশা-ভরসা, এই উদ্যম-সাধনা, সকলই মরণের সঙ্গে সঙ্গে দারুণ ব্যর্থতায় মিশিয়া যাইবে, এ চিন্তা মানুষ সহ্য করিতে পারে না।... পুণ্য কি মিথ্যা, পরলোক মিথ্যা, ন্যায়ের দ-ধারী বিধাতা মিথ্যা? এ জগৎ কি শুধু বিরাট মোহের অবাস্তব লীলাভিনয়! না, মানুষ ইহা বিশ্বাস করিতে পারে না। সে যে বাঁচিয়া থাকিতে চাহে, বাঁচাই যে তার ধর্ম। সে মরণকেও মরণ বলিয়া জানিতে পারে না। ... জীবন যেমন অনন্ত মহাযাত্রায় ছুটিয়া চলিয়াছে, যুগ-যুগান্তরের ভিতর দিয়া আপনার পথ কাটিয়া চলিয়াছে। (ইরড়ষড়মরপধষ বাড়ষঁঃরড়হ) আত্মাও তেমনি অনন্তকাল ধরিয়া কোনও এক বিশ্বে (পরলোকে) বাঁচিয়া থাকিবে; লীলাভিনয় করিবে, আপনার কর্ম ফল ভোগ করিবেন। মৃত্যু সেও ঘাঁটি (ঝঃধঃরড়হ) মাত্র; এইখানে আসিয়া আত্মজীবনের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া আপনার দেশে চলিয়া যায়, আর দেহ যাত্রীহীন মাকটের ন্যায় ধুলায় লুটিয়া থাকে।’
রবীন্দ্রনাথও বলেন, ‘মরণরে! তুঁনু মম শ্যাম সমান’ কারণ অন্য কেউ নয়,Ñ একমাত্র মরণ-ই মহাজীবনের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। সেই দ্বার দিয়ে ভারমুক্ত আত্মা অসীমের পথে যাত্রা শুরু করে আর পঞ্চভূতে বিলীন হতে ধরা ধুলায় পড়ে থাকে ভারবাহী দেহ।
বরকতুল্লাহ মনে করেনÑ ‘মানবের বিশ্বাস জীবন ও আত্মা এক নহে; জীবন বা জৈবশক্তি প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, আত্মা নিত্য। মানুষ ও অমৃতের দেশে (পরলোকে) বাঁচিয়া থাকিতে চায়, কিন্তু সেখানে তার বাসস্থান কোথায়? সে চিন্তাও মানুষের মনে স্থান পাইয়াছে। মানুষ স্বর্গের দেশে বিরাট অভ্রভেদী প্রাসাদ গড়িয়াছে। প্রাসাদের ধারে উদ্যান; অদূরে ¯িœগ্ধ ধারা প্রবাহিনী সাহচার্যের জন্য লক্ষ লক্ষ হুরও গেলমান। .... তারই সে নাম রাখিয়াছে স্বর্গ বা বেহেশত।’
অবশ্য সুফী ভাবাপন্ন লেখক শেখ ফজলল করিম মনে করেন, মানুষের অন্তরেই স্বর্গ-নরক। তাই তোতার প্রশ্ন এবং উত্তরÑ
‘কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলি যবে পরস্পরেÑ
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে।’
মানব মনের এই অনুভবকে বরকতুল্লাহ ব্যক্ত করেন এভাবেÑ ‘সেই কল্পনার লীলা নিকেতন, হতাশার আশা, পরলোক তোমার নিকট অলীক অনিত্য প্রহেলিকা বলিয়া মনে বইতে পারে, কিন্তু উহা বিশ্বাস করিতে বা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে মানবের যে ব্যাকুল আগ্রহ তার মূলে এক বিরাট সনাতন সত্য নিহিত রহিয়াছে। যে সত্যকে অগ্রাহ্য করিলে চলিবে না। মানুষের জ্ঞান যতই সীমাবদ্ধ হোক, মানুষ চিরকালই বাস্তবকে ছাড়াইয়া অবাস্তব আদর্শের সন্ধানে ছুটিয়াছে। .... সুদূর সৌরলোক পর্যন্ত সে তাহার প্রিয় কল্পনার সূত্র প্রসারিত করে। কিন্তু সময় সময় সাধনার বলে মানুষ আপন অন্তরকে দেখিতে পারে এবং আপন হৃদয়ের ভিতর দিয়া সকল সুরভির সার বিস্ময়ের বিকাশ বুঝিতে পারে। প্রকৃত সাধক মনোসংযোগ দ্বারা অন্তর দৃষ্টি করিতে পারেন, তাই তিনি গন্ধমুগ্ধ হরিণের ন্যায় বাহিরে কস্তুরীর সন্ধানে ফেরেন না। তাহার নিজের অন্তরই যে সকল অভিব্যক্তির আধার তাহা তিনি বুঝিতে পারেন। আর তপস্যা বা আরাধনার পথে আবহমান কাল মানুষ নিজের অন্তরের সেই অন্তরতম মহাশক্তির স্বরূপ উপলদ্ধি করিতে প্রয়াসী, তাই মানুষের নিকট নির্জন আরাধনা ধর্ম প্রকাশ্য উপসনাও ধর্ম।’
সমস্ত নিবন্ধ জুড়ে এত উদ্ধৃতির কারণ পাঠককে ‘অনন্ত তৃষার’ বক্তব্য উপলব্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। সৃজনশীল ক্লাসিক গদ্যে বরকতুল্লাহ কত বড় কঠিন সত্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে তার হৃদয়তন্ত্রীতে গেঁথে দিলেন তার ব্যাখ্যা দেবার চেয়ে উদ্ধৃতি সংযোজন করাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছে।
বাংলা ভাষায় দার্শনিক ও চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনা মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি উচ্চ মানের প্রবন্ধ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ খ্রি. ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন।
উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সমাজ এবং দেশের কল্যাণ করা সত্ত্বেও মানুষের স্মৃতিপটে অক্ষয় পদচিহ্ন রেখেছেন সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে। সাহিত্য সাধনায় তিনি কতটা নাড়ির টান অনুভব করতেন তা উপলব্ধি করা যায় তার রচনা শৈলী, বিষয় নির্বাচন এবং ভাষা প্রয়োগের সুদক্ষ কৌশল যা তার সমসাময়িক লেখকগণ থেকে তাকে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদায় আসীন করেছিল। বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত মেধাবী লেখক বরকতুল্লাহ যেন ‘শাহজাদপুরের শাহজাদা, সিরাজগঞ্জের বসরাফুল’Ñ যিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৮-এর ২রা মার্চ ঘোড়শালাগ্রামে, মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায় ২ নভেম্বর, ১৯৭৪-এ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।