পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের সুধি সমাজ যতই উদ্বিগ্ন হোন, তাদের সাথে সুর মিলিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলারা যতই মানোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন, আসলে উচ্চশিক্ষায় মানের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি, দলবাজি, বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার যে চিত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে যেমন সরকারের সংশ্লিষ্টদের দায় আছে, একইভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষায় মানহীনতা, মুনাফা বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথেও সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলারা সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েছেন। আজকের সামাজিক অবক্ষয়, উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে নৈতিক স্খলনের ক্রমবিস্তার এবং উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতায় যে বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়হীনতা। একেবারে নগণ্য দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সরকারী-বেসরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশিত মান ধরে রাখতে পারছে না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক আগে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশ চন্দ্র বোস, প্রফেসর সালাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুর রাজ্জাকের মত বিজ্ঞানী, জ্ঞানতাপস ও শিক্ষাবিদ-দার্শনিকরা একদা জ্ঞানের আলো ছড়াতেন। পাশাপাশি আমাদের প্রতিটি জাতীয় সংগ্রামে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়ে পড়েছে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাহিদার তুলনায় আসন স্বল্পতা, রাজনৈতিক কারণে সেশনজটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নব্বই দশকের শুরুতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইনের আওতায় দেশে প্রথমবারের মত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হয়। স্বল্প পরিসরের এসব বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে না পারলেও শুরুতে কয়েকটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি মন্দের ভাল সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। তবে উচ্চহারের ভর্তি ফি, টিউশন ফি’র কারণে সমাজের উচ্চবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার ফলে মাত্র এক দশকের মধ্যে নতুন অর্ধশতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এ সংখ্যা শতাধিক। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানসহ নানা সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম ও শিক্ষাবাণিজ্য নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও বিভিন্ন সময়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শিক্ষার নামে নানা অপকর্মের তথ্য উদঘাটন করেছে, শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার নতুন অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনসহ নতুন গাইডলাইনও নির্ধারণ করেছে। এসব কাউন্সিল ও গাইডলাইন কাগজে-কলমে থাকলেও তার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের তেমন আগ্রহ লক্ষণীয় হয়নি। বছরের পর বছর সময় দেয়ার পরও যেখানে পুরনো অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাস ও অবকাঠামোসহ প্রত্যাশিত মান অর্জন করতে পারেনি, সেখানে সরকার একের পর এক নতুন নতুন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে চলেছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত ৫ বছরে বর্তমান সরকার ৪১টি নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে, যেখানে আগের দুই দশকে অনুমোদন পাওয়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পঞ্চাশটির কম, সেখানে মাত্র ৫ বছরেই ৪১টির অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং আরো ১৭টি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। মূলত: সরকারী দলের এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও পরিচালক।
একদিকে নানা উদ্যোগ নিয়েও সরকার প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষায় বৈষম্য ও মানের ক্রমাবনতি ঠেকাতে পারছে না, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে চলেছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুসারে অনূর্ধ্ব ২১ এবং অন্যূন ৯ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড এবং বিভাগ অনুসারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পূর্ণকালীন ও খ-কালীন শিক্ষক ও জনবলসহ নিজস্ব ক্যাম্পাস অথবা ভাড়া করা জায়গায় কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট স্পেস নিয়ে ক্লাস রুম, অফিস, লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরী, সেমিনার রুম, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কমন রুম এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চলছে আইন লঙ্ঘন করেই। অনুমোদনের পর থেকে ৭ বছরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরের শর্ত থাকলেও বেশিরভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে ভাড়া করা ক্যাম্পাসে শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষক স্বল্পতা, বাজেট ঘাটতি, রাজনৈতিক দখলবাজি, শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতার শিকার হচ্ছে। মূলত প্রাথমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে সরকারের প্রভাবশালী মহলের নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও দখলবাজির শিকার হয়েছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন চেয়ারম্যানের তরফ থেকে কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পিএইচডি’র নামে ভুয়া ডিগ্রী বিতরণের অভিযোগ তোলার পরও কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের অনৈতিক শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারী কোন উদ্যোগই সফল হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্বচ্ছতা ও শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধে সরকারকে আরো কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।