শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ড. গুলশান আরা
ঊনবিংশ শতাব্দীর উজ্জ্বলতম নারীর প্রতীক বেগম রোকেয়া। তার উজ্জ্বলতা উদ্ভাসিত হয়েছে সমাজ কল্যাণে এবং নারী মুক্তিতে। আজীবন তার চিন্তা-চেতনা, মেধামনন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নারী জাগরণ, নারীমুক্তি, অবরোধ এবং কুসংস্কার বিলোপ। বিশেষ করে মুসলিম নারী জাগরণে রোকেয়ার প্রচেষ্টা ছিল ক্লান্তিহীন। এরও একটা গূঢ় তৎপর্য ছিল তার কাছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন রাজ্যহারা হওয়ার পর থেকে মুসলমানগণ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন জীবনের সকল দিক থেকে। হতবিহ্বল মানসিকতার কারণে স্থির এবং প্রজ্ঞাময় চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিলেন তারা। নারীর জীবনমান উন্নয়ন তো দূরের কথা নিজেরাও সমাজে শিরদাঁড়া করে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ইংরেজ এবং ইংরেজি শিক্ষাকে এড়িয়ে গিয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছিলেন পার্শ্ববর্তী সম্প্রদারের তুলনায়।
এমতাবস্থায় রোকেয়া নিজের মতাদর্শ স্থির করে নেন। সমাজ সংস্কারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তিনি লেখক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। পরিশুদ্ধ ভাষায় চমৎকার লিখতেন তিনি। গদ্য-পদ্য, রম্যরচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস রচনায় সিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু লিখে সমাজকে নড়াতে পারবেন না ভেবে হাতে কলমের বাস্তবতায় এসে দাঁড়ালেন।
জমিদার তনয়া এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ভোগবিলাসের জীবন পরিহার করে স্বামীর দেওয়া টাকায় স্কুল করলেন মেয়েদের জন্য। প্রতি পদক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পরও পরাজয় মানেননি। স্কুল পরিচালনা করেছেন নিজের প্রচেষ্টায়। নারী শিক্ষা বিস্তারে নিজের জীবদশায় কিছুটা সাফল্য দেখেও গেছেন তিনি। কিন্তু এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি সমাজসচেতন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ করলেন, সমাজের একাংশ অর্থাৎ পুরুষ ব্যক্তিত্ব শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে এলেও মানসিকতায় তারা এগিয়ে যাচ্ছে না। তাদের আরেক অংশ অর্থাৎ নারী সমাজকে তেমনভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে না, যাতে করে তারা তাদের গ-িবদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষের সহযোগী হয়ে অথবা নিজেরাই শিক্ষায়, কর্মে সমাজে তথা দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। মুসলমান সমাজে তো নয়-ই, পার্শ্ববর্তী হিন্দু সম্প্রদায় যারা ইংরেজি শিখে ইংরেজের সহযোগী শক্তি হয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েও নারীকে স্বতন্ত্র বা পৃথক সত্তা ভাবতে পারছে না। বিভিন্ন প্রথায় নারীকে আবদ্ধ রাখতে তারাও তৎপর। ধর্মের দোহাই টেনে নারীকে অবরুদ্ধ করার পাঁয়তারা আঁটছে। নানাবিধ লৌকিক কুসংস্কার নারীকে জোঁকের মতো কামড়ে ধরে চুষে খাচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাহিত্যিকগণও জোরালো ভাষায় লিখছেন না। রোকেয়ার জীবৎকালে রবীন্দ্রনাথ খ্যাতির শীর্ষে অথচ তার লেখাতেও নারীর প্রতি দ্বিধা সংস্কার কাটছে না। তার কাব্য নায়িকার প্রশ্ন :
‘আমি তোমারই মাটির কন্যা/ওগো জননী বসুন্ধরা,
তবু আমার জীবন কেন বঞ্চনা ভরা?’
দীর্ঘশ্বাসে তার বেদনার্ত উপলব্ধিÑ
‘না সজনী না, আমি জানি জানি সে আসিবে না,
এমন কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী,
বাসনা তবু পুরিবে না।
জনমেও এ পোড়া ভালো কোন আশা মিটিল না।’
উদারপন্থি মাইকেল ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ নায়িকা প্রমিলার মুখে যে আস্ফালন উক্তি দিয়েছেন সেখানে প্রমিলার নিজস্ব সত্তার চেয়ে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে তার শ্বশুর রাবন এবং স্বামী মেঘনাদের গৌরব। প্রমিলা বলছেনÑ ‘রাবন শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে?’
এ ছাড়াও রোকেয়া প্রত্যক্ষ করলেন শতাব্দীর পর শতাব্দী অবরুদ্ধ থাকার ফলে নারী নিজেও ভুলে গেছে যে সে সৃষ্টির সেরা। সে কারণেই :
‘আজও তারা তিনশ পঁচিশ বছর পরে
ছাগল চড়ায় পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে।’
বিয়ের পর নারী নিজেকে স্বামীর দাসী ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। নারীর এই মানসিকতার জন্য রোকেয়া নারীকেই দায়ী করে বলছেনÑ ‘পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোনো দিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি দাসী? পৃথিবী হইতে দাস প্রথা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কিনা। আমরা দাসী কেন?Ñ কারণ আছে।’
স্বামী ঘরকন্না রসনা প্রস্তুতে নারী এত ব্যস্ত থাকে যে তার চেতন-অবচেতন মনজুড়ে কেবলই ওই চিন্তা। কী করে স্বামী এবং তার পরিবার-পরিজনকে খুশি করবে। রোকেয়া লিখেছেনÑ “স্ত্রী লোকেরা ঐ পূজার (রসনা-পূজার) আয়োজনে সমস্ত সময় ব্যয় করেন। অন্য বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিতে তাহাদের অবসর থাকে না। সমস্ত দিন ও অর্ধরাত্রি তো তাহাদের রন্ধনের চিন্তায়ই অতিবাহিত হয়, পরে নিদ্রায় স্বপ্ন দেখেন ‘যাঃ! মোরব্বার সিরা (চিনির রস) জ্বলিয়া গেল’।”
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তখনকার নারী নিজের সেই অবমাননাকর জীবন সম্বন্ধে না লিখলেও পুরুষের লেখা থেকে জানা যায় অবজ্ঞার পরিমাণটা কত মর্মভেদী ছিল। নারীর কোনো বুদ্ধি আছে এটাই তখন বিশ্বাস করা হতো না। এই অবজ্ঞার চরম মূল্য দিতে হয় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পুত্রের অভিভাবকদের। পুত্রের জন্য বাধ্য হয়ে তাদের খুঁজতে হয় শিক্ষিত পাত্রী। কেননা নব্য শিক্ষিতের স্ত্রী অশিক্ষিত হলে ‘পুরুষদের এই রূপ অবস্থার পরিবর্তন হইলে কি মূর্খ স্ত্রীদের সঙ্গে তাহাদের সংপ্রীতি হইবেক। দিবসীয় মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পর পুরুষের যে সান্ত¦না ও সাহায্যের আবশ্যকতা তাহা কি ঐ অজ্ঞান স্ত্রীর নিকটে পাইতে পারিবেন। ঐ স্ত্রীর নিকটে তিনি কি আপনার অন্তঃকরণীয় বার্তা প্রকাশ করিতে পারিবেন।’ (সমাচার দর্পণ/১৮৩৮)
আরেকজন খুব স্পষ্ট করেই বললেনÑ শিক্ষিত সম্প্রদায় একটি বিষয়ে খুব অসুখী। এরা ঘরে গিয়ে স্ত্রীর কাছে সুখ এবং মানসিক শান্তি পান না।
এ সমস্ত উক্তির অর্ধশতাব্দী পরেও বেগম রোকেয়া গভীর অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করলেন অশিক্ষিত অবরোধবাসিনী কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্ত্রীকে নিয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছেন না। রোকেয়া জুতসই উপমার সাহায্যে তুলে ধরলেন সেই ভয়াবহ অসঙ্গতির কথা। তিনি লিখলেনÑ ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন স্ত্রী তখন বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সূদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌর জগতে বিচরণ করেন, সূর্য ম-লের ঘনফল তুলাদ-ে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্ণয় করেন।’
রোকেয়া মনে করেন নারীরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে বসে আছে। তাই তাদের প্রতি তার উদাত্ত আহ্বানÑ ‘বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে! জড়াউ অলংকার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ!’
নারী নিগৃহীত হচ্ছে পুরুষ দ্বারা বিশেষত বাঙালি মুসলমান নারী নিপীড়ন সীমাহীন। সে কারণে রোকেয়ার মনোবেদনাÑ ‘যৎকালে সমগ্র জগতের নারী জাতি জাগিয়া উঠিয়াছে, তাহারা নানাবিধ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে, তাহারা শিক্ষামন্ত্রী হইয়াছে, তাহারা ডাক্তার, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, যুদ্ধমন্ত্রী, প্রধান সেনাধ্যক্ষা, লেখিকা, কবি ইত্যাদি ইত্যাদি হইতেছে আমরা বঙ্গনারী গৃহকারাগারে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছি, আর যক্ষ্মা রোগে ভুগিয়া হাজারে হাজারে মরিতেছি।’
বেগম রোকেয়া অতীব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, ‘ভগ্নি দিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই।’ কিন্তু নারীকে জাগিতেই হবে, কেননাÑ ‘আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোন ব্যক্তির একপা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষে স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহা।’
রোকেয়া নিশ্চয় উপলব্ধি করেছিলেন, মেয়েরা শিক্ষিত না হলে এসব বক্তব্য দেয়া হবে উলুবনে মুক্তা ছড়ানো। মেয়েদের শিক্ষিত করতে বহু বাধা অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। এটি তার জীবনের অক্ষয়কীর্তি। রোকেয়ার জীবদ্দশাতেই কলিকাতা ও মফস্বলের বহু শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা এখানে বিদ্যার্জন করে ধন্য হয়েছেন। পরে স্কুলটি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
কিন্তু রোকেয়ার আফসোস তখনও পর্যন্ত যায়নিÑ কারণ স্কুলে একটি বাংলা শাখা খোলা যাচ্ছে না বলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তার ছিল আত্মার টান। তবু তিনি আশাবাদীÑ ‘অতঃপর চল্লিশজন বাঙালি শিক্ষার্থিনী ছাত্রী পাইলে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা স্কুলে বাংলা শাখা খোলা যাইবে।’
বস্তুত সমাজ হিতৈষণার প্রেক্ষিতে রোকেয়া চেয়েছেন নারী মুক্তি নারীর অধিকার। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারী মুক্তি অসম্ভব বারবার বলেছেন। প্রথম নারীবাদী চিন্তার ধারক-বাহক এবং প্রবর্তক বেগম রোকেয়ার স্বপ্নকে আংশিক হলেও পূরণ করেছেন এ দেশের মেয়েরা। তবে এ কথা ভেবে আজও আমরা উল্লসিত হতে পারছি না যে, রোকেয়ার সব স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিÑ এর জন্য চাই সামগ্রিক সহযোগিতা। নারী নির্যাতন, অবরোধ, কুসংস্কার নির্মূলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই যদি পূরণ হয় সংগ্রামী প্রতিবাদী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার লালিত স্বপ্ন এবং এই স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে আমরা আনতে পারি নারীর সত্যিকারের মুক্ত স্বাধীন জীবন, যা দেশ জাতি তথা বিশ্বের জন্য হবে কল্যাণকর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।