Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের পথিকৃৎ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

অবরোধের অন্তঃপুরে প্রশ্নহীন আনুগত্যে যন্ত্রণাবিহীন একটি জীবন তাঁরও যাপন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি জেগে উঠেছিলেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিপুল বিশাল এক কর্মযজ্ঞে। প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর। নিজে বাঁচবেন, বাঁচাবেন নারী সমাজকে। আপন এলাকায় আলোকস্নাত এ নারী আমরণ নিজে আলোর জগতে বিচরণ করেছেন এবং প্রাণে প্রাণে আলো জ্বালাবার সাধনা করেছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তাঁর সঙ্গে তাঁর সমকালের বা আজ এ শতাধিক বছর পরের পৃথিবীর আর কারো সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না। হতে পারে না। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যাণ-ধারণা, আবেগ-উদ্যম ও শক্তি সাহসের মূল্য পরিমাপ করার সাধ্য আমাদের অনেকেরই নেই। অনেক উচ্চ শিক্ষিতেরও নেই। কারণ, এখনও আমরা অনেকে মূল্যবান শাড়ি, গহনা, বহুমূল্য কাবিননামার সঙ্গে উচ্চ শিক্ষার সনদটি সযতেœ রক্ষা করে চলেছি। সৌভাগ্যবশত যথাস্থানে যথাকাজে এ সনদটি যারা ব্যবহার করছি তাদেরও অনেকে শিক্ষা ও জ্ঞানের পুরনো বা সীমিত জগতবৃত্তে বন্দী। অধ্যয়ন ও জ্ঞানের জগতে নিত্য বিচরণ আমরা অনেকেই বাহুল্য মনে করি। অথচ আপন আলোয় উদ্ভাসিত এ নারী আজীবন, আলোর জগতে বিচরণ করেছেন, আলোর সাধনা করেছেন, প্রাণে প্রাণে আলো জ্বেলেছেন।

বেগম রোকেয়ার জীবনব্যাপী সাধনা ও কর্মের মূল্যায়ন কেবলমাত্র তাঁর সমকালের নিরিখে হওয়া উচিত নয়। কারণ, নারী নির্যাতনের সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নারীমুক্তি আন্দোলনের ধারা বিশেষ করে এ উপমহাদেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং সমকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নারী জাগরণের সম্ভাবনার বিচার ব্যতিরেকে রোকেয়ার মূল্যায়ন যথার্থ হবে না। কিছূ মোটা দাগে আমরা তাঁর অবদানকে এভাবেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকি।

আমাদের ‘সামাজিক অচলায়তনের প্রকার’ ভেঙ্গে ‘অবরোধের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ’ থেকে এদেশের মুসলমান মেয়েদের তিনি উদ্ধার করেছেন। নারীর মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগানোর লক্ষ্যে তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন। নারীর প্রতি নারী-পুরুষ অর্থাৎ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আমরণ কলমযুদ্ধ করেছেন তিনি। আমাদের নারী মুক্তি আন্দোলনের তিনিই ‘পুরোধা-ব্যক্তিত্ব’।

বেগম রোকেয়ার সকল সংগ্রাম মূলত নারীমুক্তির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। সংগ্রামটি তিনি আঁটঘাট বেঁধে, একটি সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মাথায় রেখে শুরু করেছিলেন এবং এটি ছিল, যাকে বলা যায়, সার্বিক সংগ্রাম। প্রভুত্বের দ্যোতক ‘স্বামী’ শব্দটির বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাঁর মতে, জাগতিক রীতি ও সামাজিক নিয়মের নিরিখে ‘স্বামী’ শব্দটি হাস্যকর। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা জগতের রীতি। সামাজিক নিয়মে এমনকি এক পেশা অন্য পেশার উপর নির্ভরশীল। অথচ মানুষে মানুষে সবচেয়ে সুন্দর চিরনির্ভরশীলতার সম্পর্কটিতে প্রভূ-ভৃত্যের সম্পর্কের ইঙ্গিতবহ ‘স্বামী’ শব্দটি সমাজে প্রচলিত রয়েছে। স্বামীত্বের ধারণা সমূলে উপড়ে ফেলার জন্য শব্দটি তিনি বাতিল করতে চেয়েছিলেন।

শিক্ষা চাকরি লাভের উপায় বলে গণ্য হওয়ায় স্ত্রীশিক্ষা আবশ্যক বিবেচিত হয়েছিল। বেগম রোকেয়াকে তাই বলতে হয়েছিল যে, ‘পাশ করা বিদ্যা প্রকৃত শিক্ষা নহে। সৃষ্টিকর্তা আমাদিগকে যে স্বাভাবিক জ্ঞান ও ক্ষমতা দিয়াছেন অনুশীলন দ্বারা তাকে বৃদ্ধি করার নামই শিক্ষা।’ সমাজ যেহেতু নারীকে ধার্মিক, সুগৃহিনী এবং পর্দানশীল দেখতে চায় বেগম রোকেয়াকে তাই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হয় ভিন্নভাবে। যথার্থ ধার্মিক কন্যার জন্য তিনি আরবী ও বাংলা দুটি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন সাপেক্ষ শিক্ষার সুপারিশ করেছেন। সুগৃহিনীর জন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়ন ও উত্তাপতত্তে¡র জ্ঞান অর্জন আবশ্যকীয় বিবেচনা করেছেন। সুমাতা প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘মাতৃকর্তব্য না জেনে কেউ যেন মাতা না হন।’ পর্দা বিষয়ে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা পোষণকারী এ নারী ‘আবশ্যকীয় পর্দা’র সঙ্গে ‘কৃত্রিম পর্দা’ ও ‘অন্যায় পর্দা’র পার্থক্য নিরূপন করেছেন। স্থানভেদে আপাদমস্তক ঢাকা পর্দাটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও ‘কিম্ভুতকিমাকার জীব সাজা’কে হাস্যকর বলেছেন বেগম রোকেয়া। বলেছেন, ‘যাঁরা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুখে অর্ধনগ্ন থাকেন তাঁদের অপেক্ষা যাঁরা ভালমত পোষাক পরে মাঠে বাজারে বাহির হন, তাঁদের পর্দা বেশি রক্ষা পায়।’ নারীর শয়নকক্ষের স্বাতন্ত্র্য এবং বিনা অনুমতিতে সেখানে প্রবেশ নিষেধের মধ্যে তিনি পর্দার উৎকৃষ্ট রূপটি দেখতে পেয়েছেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে বিশ শতকের শেষপ্রান্তে আমরা নারী সমাজের একটি ¯েøাগান শুনেছি, ‘কোথায় আমার ঘর?’ একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘প্রাণীজগতে সকলেরই গৃহ আছে-নাই কেবল আমাদের।’ বলেছেন, কুমারী-সধবা-বিধবা-সবার অবস্থা একই, শোচনীয়।’ ‘স্ত্রী জাতের অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লিখে সমাজে তোলপাড় তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। সমাজে ‘বিষম গোলযোগ উপস্থিত হোক, বোধ করি তাই চেয়েছিলেন। কারণ, কোনো নতুন কাজ, ভালো কাজ, কোনো মহৎ উদ্যোগ চুপিসারে হয় না তিনি তা জানতেন।

কলম্বাস ও গ্যালিলিওর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তিনি। বাতুল আখ্যা পেয়েছিলেন কলম্বাস। কারারুদ্ধ হয়েছিলেন গ্যালিলিও। কিন্তু আমেরিকা অনাবিস্কৃত থাকেনি। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর পরিভ্রমণ বন্ধ হয়নি। রক্ষণশীল সমাজের সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও নিন্দামন্দের মুখে অবিচল থেকে তাঁর একার সংগ্রাম তিনি করে গেছেন। তাঁর সমকালে শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা ও কলমের শক্তিতে শক্তিমান যাঁরা বেগম রোকেয়ার উত্থানকে ‘মুসলিম সমাজের জাগরণের লক্ষণ’ বলে মনে করতেন এবং তাঁর প্রতিভাকে যাঁরা ‘ভগ্নহৃদয় মুসলমানের জন্য দৈব আশ্বাস’তুল্য বলেছেন, বেগম রোকেয়া পাঠের প্রাথমিক ধাক্কা তাঁরাও সামলাতে পারেননি। তাঁদেরও ‘সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল।’ প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হবার পর পূর্ণপাঠে তাঁরা স্বীকার করেন যে, ‘লেখিকার অনেক কথাই নিরেট সত্য এবং মতিচুর প্রকৃত মতিচুরই বটে।’ বেগম রোকেয়া তাঁর নারী বিষয়ক প্রথম রচনাতেই বলেছেন ‘আমাদের অবস্থা আমরা চিন্তা না করলে আর কেহ আমাদের জন্য ভাবিবে না। ভাবিলেও তাতে আমাদের ষোল আনা উপকার হবে না।’

একশ’ বছর পরে আজ বিশ্ব জুড়ে নারী মুক্তি আন্দোলন যখন নানা মাত্রিক আলো পাচ্ছে, তখন স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে যে, আমাদের দেশে তো নয়ই পৃথিবীর কোথাও নারী আন্দোলন বা নারী মুক্তির আবহ তৈরিতে নারী ভিন্ন আর কোনও মৌলিক অবদান নেই। কোনো পুরুষ নয়, পুরুষ সংগঠন নয়, কোন সরকারও নয়।

আজ জাতিসংঘের বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নারী সম্মেলন-সংগঠনের ডাকে বছর ব্যাপী নারী কেন্দ্রিক নানা দিবস উদযাপিত হয়। নারী দিবস উপলক্ষে আমরা নতুন নতুন শ্লোগান পেয়ে থাকি। দু’তিন বছর আগেকার একটি শ্লোগান ছিল : নারীর অধিকার মানবাধিকার। নারীর জন্য মানবের সকল অধিকার দাবি করাই ছিল বেগম রোকেয়ার সারা জীবনের সংগ্রাম। ‘নারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ন্যায়ানুমোদিত রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও জাতীয় শিক্ষার চিন্তা’ বেগম রোকেয়ার সমস্ত জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ও কর্মপ্রেরণা ছিল। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল বিস্ময়কর। তিনি বলছিলেন, পরিশ্রমতো করছিই। পরিশ্রমের শুধু স্থান বদল হতে হবে। আজ আমরা জানি যে, নারীর গার্হস্থ্য শ্রম বা শ্রমের অর্থনৈতিক মূল্যে অভিষিক্ত হয়েছে। বেগম রোকেয়া এমনকি শিল্প সংস্কৃতিতেও নারীর অধিকার চেয়েছেন। সে সূত্রে নারীর জন্য কিছু অবসরও চেয়েছিলেন। অবসরের জন্য চিত্র ও সঙ্গীত বিদ্যা আয়ত্ত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। নারী মুক্তির লক্ষ্যে সমাজে বিশেষ করে সাহিত্যে সুদীর্ঘকালের যে ভাবমর্যাদা নারীর এগিয়ে যাবার পথে বাঁধা হয়ে ছিল বা আছে এখনও সেটিকে ভাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ ‘মাতা-কন্যা-বধূ-জায়া-ভাগিনীর’ খÐ খÐ রূপে পরিচিত হতে হতে নারী ভুলেই গিয়েছিল যে সে মানুষ। সাহিত্য নারীর লালিত বঙ্গলতা রূপের প্রস্বস্থিগান যে প্রকারান্তরে তাকে দুর্বল করে রাখার কৌশল, জননীরূপের মহাত্ম্য বর্ণনা যে তাকে সংসার-সন্তানজালে বন্দী করার ছল, প্রিয়া রূপে বন্দনা যে নারীকে বন্দী করার চাতুর্য বেগম রোকেয়া তা খোলাখুলিই বলেছেন। সুতরাং বললে অত্যুক্তি হয় না যে, নারীর জন্য আমাদের সকল সংগ্রামের তিনিই পথ-প্রদর্শক।

আজ অনেক নারী সংগঠন নারীর জন্য অর্থাৎ সমাজের জন্য কাজ করছে। দিনে দিনে তাদের সংখ্যা বাড়ছে, শক্তি বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নারী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বিত শক্তি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। নির্যাতন রোধে নারী আন্দোলনের নতুন নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু আমাদের নারীর অবস্থা ও অবস্থানের গূণগত পরিবর্তনের পরিমাপ কতটুকু? জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদকাল অনন্তকালে পর্যবসিত হচ্ছে। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘তাঁদের অধিক যতœই আমাদের সর্বনাশের কারণ।.... সর্বদা সুরক্ষিতা আছি বলিয়াই সাহস, ভরসা, বল সবই হারিয়েছি। বলেছিলেন, ‘অনুগ্রহ করে এ কর, অনুগ্রহ কর না মোদের।’ যাঁরা জাতীয় সংসদে নারীর সংরক্ষিত আসনের মেয়াদকালে বাড়িয়ে চলেছেন এবং আসন সংখ্যা বাড়ানোর ছলে মূল সমস্যাকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বেগম রোকেয়ার তিরোধান দিবস উপলক্ষে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে করে, দয়া করে বেগম রোকেয়াকে পাঠ করুন, বেগম রোকেয়াকে অনুধাবন করুন।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • jack ৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:০১ পিএম says : 1
    আমাদের সব থেকে বড় শিক্ষিকা আমাদের মা জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু উনি অন্তরাল থেকে বড় বড় সাহাবীদের কে শিক্ষা দিতেন>>> আল্লাহর কাছে কোন শিক্ষার দাম নেই যদি কিনা তারা কোরআন এবং হাদিসের শিক্ষা তাদের মধ্যে থাকে না তারা যত শত পিএইচডি করুক না কেন তারা জাহেল
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বেগম রোকেয়া

১০ ডিসেম্বর, ২০২১
৯ ডিসেম্বর, ২০২১
৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন