শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
১৯৭১ সাল। সীমান্তবর্তী চুনারুঘাট থানা। তিন নম্বর সেক্টর এলাকা। গোছাপাড়া গ্রাম।
রাজার বাজার প্রাইমারি স্কুলে পাকিস্তানী মিলিটারির ক্যাম্প বসেছে। এলাকায়, হাটে বাজারে জনচলাচল সীমিত। শোনা যাচ্ছে এরা নাকি ইউসুফ খানের দল। আতঙ্কে মানুষ আখের ক্ষেতে লুকিয়ে থাকলো কয়দিন। কিছুদিন কেটে গেলো- শত্রুদের লাফঝাপ, এবাড়ির মুরগ, ওবাড়ির খাসি টানাটানি করে। মাঝেমধ্যে বাল্লা সীমান্ত অভিমূখী লোকালবোর্ডের রাস্তায় খানসেনাদের আনাগোনা দেখা যায়।
মন্টু তখন এগারো বছরের বালক। যুদ্ধ। স্কুল তখন বন্ধ । পড়াশোনা করতে হয়না। সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ। অন্যান্য দিনের মতোই সেই রাতেও খাওয়ার পর ঘুমাতে যায় মন্টু। তারা তিনজন পুবের ঘরে থাকতো। মন্টু, বড় ভাই টেনু ও মামার এক ভাই মতিয়ার। ৪র্থ শ্রেণিতে পড়তো। সে এখানেই থাকতো। তার বাড়ি বাহুবলের জাইরা গ্রামে। সবাই ঘুমের ঘোরে। হঠাৎ কিছু মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু ভাষা স্পষ্ট নয়। দাদাকে জাগালো। দাদা চুপ থাকতে বললো। বাবার কান্না শুনেই সবাই বুঝে গেলো- পাঞ্জাবীরা আক্রমণ চালিয়েছে। তখন সময় আনুমানিক রাত ৪ টা হবে। প্রতিরাতের মতো বাবা উঠে গরুকে ঘাস-খড় দিচ্ছিলেন, গোয়ালঘর থেকে ফেরার পথে পাঞ্জাবীরা তাকে আটক করে। কিছুক্ষণেই তার মেজো কাকা জয়নাল মারপিটের ও কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো।
এদিকে মনুরা তিনজন ভয়ে কাঁপছিল। মনুরা ভাইকে বললো, চলো আমরা বেড়া ভেঙে পালিয়ে যাই। দাদা রাজি হলো না। বললো, বাবাকে ওদের হাতে রেখে পালাতে পারবো না। অগত্যা তিনজনই বাইরে বেরিয়ে এলো। ওরা দুজন সামনে , মনুরা পেছনে। পেছন থেকে সে সরে একটু অন্ধকার পথের দিকে পা বাড়ায়। কয়েক পা যেতেই ‘টেরো’ শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় এবং ফিরে আসে। ওর মেজো কাকার বারান্দায় বাবা, কাকা, দাদাকে বসিয়ে রাখলো। মনোরঞ্জন ও মনুরা তাদের পেছনে বসে পড়লো। তাদের কাছাকাছি তরিক চৌকিদারকে পাঞ্জাবীদের সাথে দেখা যাচ্ছে। আমুরোড রেল গোদামের পেছনে থাকে সে।
হঠাৎ দেখা গেল রাখাল কাকার দরজা ভেঙে উনাকে টেনে হেঁচড়ে ধরে এনে বসিয়ে রাখলো। একজনকে পাহারায় রেখে বাকিরা সকল ঘর তন্নতন্ন করছে। ওরা পালবাড়ির দিকে ছুটে। পাল বাড়ির দিকে যেতেই দেখে সেখানেও পাঞ্জাবীরা। ভয়ে পা চলছিলো না। কাঁপতে কাঁপতে পশ্চিমদিকের ধানের বাইন ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায় দুজন। কয়েক বিঘা দূরে ধানগাছের আঁড়ালে লুকিয়ে পড়ে তারা। মাঝে মাঝে টর্চের আলোতে হানাদারদের নৃশংসতা দেখা যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখাগেলো, পাল বাড়ির রাখাল ছাবু মিয়া পুরো উলঙ্গ অবস্থায় ওদের দিকে দৌড়ে আসছে। তাকে আস্তে করে ডেকে থামিয়ে দিলো মনুরা। তার গায়ে জড়ানো গামছা পরতে দিলো ছাবুকে। তাকে নাকি তারই লুঙ্গি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলো। কোন রকম সে পালিয়ে আসে।
তখন অন্ধকার কমতে শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে তার চাচা প্রাণপনে ছুটে আসছেন। তাকে থামিয়ে জানা গেল, বাড়ির নারী, শিশু সহ সবাইকে পাল বাড়িতে নিয়ে গেছে।
হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখায় সমস্ত গ্রাম তপ্ত হয়ে ওঠে। ধোপাবাড়ি, পালবাড়ি নি:শ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। একসাথে ডজন প্রায় তাজাপ্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, আগুনের লেলিহান শিখায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভোরের হালকা আলোয় মনে হচ্ছিলো শ্মশানে পরিণত হলো দুটো বাড়ি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, নারী, শিশুদের নিয়ে হানাদার বাহিনী পুবের রাস্তার দিকে চলে গেলো।
তখন সূর্যের আলোয় আলোকিত চারদিক। এদিক, ওদিক থেকে বালকেরা ছুটে এসেছে। মনুরা গুটিপায়ে সব বাড়িতে গেলো। স্পষ্ট দেখতে পেল, এখানে বাবা, ওখানে মেজো চাচা, বড়দা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে নিথর দেহে। কিছু বাড়িতে আরো চারজন ভূমিতে লুটিয়ে আছেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। হঠাৎ কান্না শুনে ওর বড়দা নড়েচড়ে বলেওঠে, মনুরা, তুই বেঁচে আছিস, একটু পানি দে না ( অস্ফুট আওয়াজে )।” ঠিক তখনই এক বালক বলে ওঠে, মতিয়ার আসছে।” প্রাণভয়ে সে পালিয়ে যায়। অনেকটা পর দু’হাতে পুকুরের পানি নিয়ে ফিরে আসে। তখন ওর বড়দা আর নেই। আঙ্গুলের ফাঁকে জল কখন পড়ে গেল, বলতে পারেনা। কিছুক্ষণ মাটিতে বসে থাকে। মতিয়ার তখন এক গন্তব্যহীন পথহারা বালক। আপন বলতে আর কেউ তার চোখের সামনে নেই। সে এখন কী করবে, কোথায় যাবে? তার গন্তব্য জানা নেই।
মতিয়ার সব হারানোর গল্প শোনে হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমিও কাঁদছি। মতিয়ার অনেকক্ষণ চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি এখন বালক নেই, বয়স ষাটের কাছাকাছি। তার কাছেই সব শোনে বাকরূদ্ধ তাকিয়ে রই।
তিনি আবারো বলতে লাগলেনঃ
পরে শুনলাম নারী শিশুরা নাকি পাশের মহাজন বাড়িতে জিম্মায় আছেন। মহাজন বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। একটু এগিয়েই দেখলাম পাশের এক চারা জমিতে পরিচিত আব্দুর রশিদ ও রওশন আলীর লাশ পড়ে আছে। এ নিয়ে নয়জনের লাশ দেখলাম।
গন্তব্যহীন এদিকে ওদিকে ঘুরে বেলা একটু গড়ালো। বিকেলে চলে আসি পশ্চিমদিকে নুর মিয়ার বাড়িতে। এখানেই খেয়ে রাত কাটাই। পরদিন সকালে কাউকে না বলেই ভারতের উদ্দেশ্যে একাই রওনা দিই। রাস্তায় পরিচিত একজনকে পেয়ে হেঁটে বেলছড়ায় এক আত্মীয় বাড়িতে চলে যাই।
বিকেলে আবার দেশে ফিরে আসি একাই। এলোমেলো ঘুরে ঘুরে জানতে পারলাম, মা চাচীরা মহাজন বাড়িতে জিম্মায় আছেন। রাত পর্যন্ত মা, চাচীদের সাথেই থাকি। রাত ১০ টার দিকে হানাদারদল মহাজন বাড়িতে আসে। হানাদাররা যাবার সময় মা ও দুই মাকে নিয়ে গেলো। আমরা কান্নাকাটি করছিলাম। সে কান্না নরপশুদের স্পর্শ করেনি। তারা যাবার সময় ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন সবারদিকে; ভয়ে সকলেই বাকরুদ্ধ, চোখ ছলছল।
পরদিন আমি আবারোও বেলছড়াতে চলে যাই। সেখান থেকে পদ্মবিল এলাকার আর এক আত্মীয় বাড়িতে কিছুদিন কাটাই। একমাস পর গৌড়াঙ্গটিলার শরণার্থী শিবিরে সবাই চলে যাই। সেখানে বেঁচে থাকা অনেককেই পেয়ে যাই। শরণার্থী জীবনের কথা আর নাইবা বলি।
দেশ স্বাধীন হলো, সবাই ফিরে আসে, ফিরে এলেন নরপশুদের হাতেবন্দি চাচীরা; ফিরেননি কেবল, যাদের রক্তে সেদিন পালবাড়ির মাটি লাল হয়েছিল। ধোপা বাড়ি, পালবাড়ি আবারো কোনোভাবে দাঁড়ায়।
স্বাধীনতার বহুবছর পর নরপশুদের নির্যাতনের শিকার তিন নারীর দুজন বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রীয় খেতাব পেলেন, আমার মা সব হারিয়েও বীরাঙ্গনার সন্মান ছাড়াই একদিন পরপারে গেলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।