ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
১৭৫৭ সন থেকে ১৯৪৭ সন। সুদীর্ঘ এই ১৯০ বছর আমাদের এ উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ধারাবাহিক লড়াই এবং সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশমুক্ত হয় উপমহাদেশ। জন্ম হয় দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। আর হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ। একটি অংশের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)। আর দু’টি অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল প্রায় ২ হাজার মাইল। ভৌগোলিক ব্যবধান বিস্তর হলেও দু’ দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে কোনো ব্যবধান ছিল না। অধিকাংশ জনগণের ধর্মবিশ্বাস ও আকিদা ছিল এক ও অভিন্ন। তবে উভয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে ছিল অনেক বৈপরীত্য। ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে অনুন্নত ও বঞ্চিত ছিল। মুক্তিকামী বাঙালিরা এ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পরপরই এদেশের কৃষক সমাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু হয় ১৮৩১ সালে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। তিতুমীর গ্রামের অসহায় কৃষকদেরকে নিয়ে ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ দখলদার বাহিনী বেশ কয়েকবার তিতুমীরের কাছে পরাজিত হয়। অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংরেজদের ভারী অস্ত্রের কাছে সাধারণ তলোয়ার এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে মরণপণ যুদ্ধ করে তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। এরপর ১৮৫৭ সালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিপাহীদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় সশস্ত্র বিদ্রোহ। ইংরেজদের দ্বারা এদেশের মানুষের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা এবং এদেশীয় সৈন্যদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ দেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচিত হয়। বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয় পশ্চিমবাংলার ব্যারাকপুরে একজন সিপাহী। সিপাহীর নাম মঙ্গলপান্ডে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চে সূচিত এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতে। বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, দিনাজপুর, পাবনা ইত্যাদি শহরও শামিল হয় এ বিদ্রোহে। এ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন মৌলভী আহমাদুল্লাহ, অযোধ্যার বেগম হযরত মহল, নানাসাহেব ও রানী লক্ষ্মীবাঈর মতো রাজপরিবারের বঞ্চিত, নির্যাতিত ও উপেক্ষিত অনেক লোকজন। বিদ্রোহীরা দিল্লি দখল করে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতবর্ষের বাদশাহ ঘোষণা করে। কিন্তু সুচতুর ও ধূর্ত ইংরেজদের রণকৌশল আর বিচক্ষণতার কাছে সিপাহী-জনতা পরাজয় বরণ করে। অনেকে শাহাদাত বরণ করে। সিপাহীদের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেক সৈনিকের লাশ। আর বাহাদুর শাহকে নির্বাসিত করা হয় মায়ানমারে। ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে এভাবেই থেমে যায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সিপাহী-জনতার স্বাধীনতা আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলন শেষ হয়ে গেলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। অবশেষে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট। ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। আর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে থাকে। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম এবং হিন্দু নেতারাই এ দুই স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব দান করতে থাকেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনে শাসিত ও শোষিত এসব নেতার অনেকেই তখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে পারেননি। তাই নিজ রাষ্ট্রের ভেতরেই রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য আর সাংস্কৃতিক গোলামী চাপিয়ে দেয়ার হীন প্রয়াস শুরু হয়। ফলে পাকিস্তানে শোষিত ও বঞ্চিত বাঙালিরা দুঃশাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করে। পাকিস্তানি শাসকেরা সর্বপ্রথম আঘাত হানে পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। তারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে এবং উর্দু ভাষাকে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করা হবে বলে ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার বিক্ষুব্ধ জনগণ প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝরা রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই স্বাধীন দেশে আবার শুরু হয় রক্ত ঝরার ইতিহাস।
ব্রিটিশ আমল থেকেই পূর্ববাংলা ছিল অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত। পাকিস্তান আমলে এই বঞ্চনা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পোশাক কারখানা ছিল ১১টি আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৯টি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পোশাক কারখানা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬টিতে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৫০টিতে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে পূর্ব বাংলার সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫%। এরমধ্যে কমান্ড পদে ছিলেন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা কর্মরত বাঙালি সৈনিকদের সাথে যথার্থ ব্যবহার করতো না; তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করতো। তারা পূর্ব পাকিস্তানিদের যুদ্ধে যাবার অযোগ্য বলে বিবেচনা করতো।
জনসংখ্যা বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সমগ্র পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ। অথচ, শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের এই ষড়যন্ত্র ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই। আর এই ষড়যন্ত্রের প্রধান নায়ক ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের কোনো ব্যক্তি যখনই রাষ্ট্রের কোনো পদে নেতা নির্বাচিত হতেন ঠিক তখনই তারা নানারকম তালবাহানা শুরু করতো। কোনো না কোনো অজুহাতে তার পদচ্যুতি ঘটাতো এই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করেন। দীর্ঘ ১১ বছর পাকিস্তানে চলে তার স্বৈরশাসন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর এ অবৈধ ক্ষমতা দখল, শোষণ ও নির্যাতনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব বাড়তে থাকে। আইয়ুব খানের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ, গঠন করে সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন একসময় রূপ নেয় গণআন্দোলনে। গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পদত্যাগ করে। ক্ষমতা গ্রহণ করেন তারই উত্তরসূরী জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ইতিহাসের ভয়াবহতম জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে ৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। জলোচ্ছ্বাসের পরেও যারা বেঁচে ছিলেন তাদেরও অনেকে খাদ্য ও পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করে। ইতিহাসের ভয়াবহতম এ দুর্যোগেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনো ধরনের ত্রাণকার্য পরিচালনা করেনি। জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ১৬৭টিতে। প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৮.৩%। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি জয় লাভ করে ৮৮টি আসনে। প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৯.৫%। উভয় পাকিস্তানের হিসাবে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে। দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ অন্য নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করণীয় নির্ধারণে রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র শুরু হয় জনবিক্ষোভ। এ বিক্ষোভে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চিন্তিত হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই তারা ৩ তারিখের অধিবেশন বাতিল করে। অধিবেশন বাতিলের ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে পাঁচ দিনের হরতালের ডাক দেন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে। ২ মার্চ ১৯৭১, কারফিউ ভেঙ্গে জনগণ রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে। একদিকে নগরবাসীর ভয়াল গর্জন, মিছিল, হরতাল, সমাবেশ, অন্যদিকে গুলিবর্ষণ। ৩ মার্চ গুলিবর্ষণে ঢাকা ২৩ জন এবং চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হয়। ৪ মার্চ চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২১ আর খুলনায় ৬ জন। ৫ মার্চ চট্টগ্রাম নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ১৩৮ জনে আর টঙ্গীতে নিহত হয় ৪ জন। ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়ার ভাষণ আর জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের একাত্মতা ঘোষণা। ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সকল সরকারি অফিস অচল। ১০ মার্চ সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত হয়। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর তারবার্তা: ঢাকায় আসতে সম্মতি জ্ঞাপন। ১২ মার্চ জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সপরিবারে স্বদেশে প্রেরণ। ১৩ মার্চ সামরিক বাহিনীর ১১৫ নম্বর মার্শাল ল’ আদেশ জারি। বেতনভুক্ত কর্মচারীদেরকে কাজে যোগদানের নির্দেশ। ১৪ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফর্মুলা: দুই পাকিস্তানে দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন। সফরসূচিতে গোপনীয়তা অবলম্বন। ১৬ মার্চ মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক। জামালপুরে হাজার হাজার লোকের লাঠি ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল। ১৭ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় বৈঠক। ভারতের উপর দিয়ে বাংলাদেশগামী সকল বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা। ১৮ মার্চ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন, আওয়ামী লীগের প্রত্যাখ্যান। ১৯ মার্চ শুধুমাত্র মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। জয়দেবপুরে জনতা সেনাবাহিনী সংঘর্ষ। ২০ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী চতুর্থ দফায় বৈঠক। আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে অনুমান। মুজিবের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন বলবৎ। ২১ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া পঞ্চমদফার অনির্ধারিত বৈঠক। কঠোর সেনা পাহারায় ভুট্টোর ঢাকা আগমন। জয়দেবপুরে কারফিউ প্রত্যাহার। ২২ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া আবার বৈঠক। অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। পাকিস্তানের জাহাজ ও বিমান মালদ্বীপের ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক। ২৩ মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন। বাংলাদেশের সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস ভবনে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। ২৪ মার্চ আবারো পাকিস্তানিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক। নতি স্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত বঙ্গবন্ধুর। সামরিক প্রহরায় পাকিস্তান বাহিনীর ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃবৃন্দের ঢাকা ত্যাগ। রংপুরে সেনাবাহিনী-জনতা সংঘর্ষ। নিজ বাসভবনের সামনে জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙালির উপর কাপুরুষোচিত হামলা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের এ হামলাকে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা বলা হয়। হত্যাকান্ডের খবর বিশ্ববাসী যাতে জানতে না পারে সে লক্ষ্যে তারা আগে থেকেই বিদেশি সাংবাদিকদেকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হামলা চালায়। জগন্নাথ হল পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে। এতে প্রায় ৭০০ ছাত্র নিহত হয়। মধ্যরাতের আগেই তারা সমস্ত ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেয়। ওই রাতেই পাকিস্তানিদের হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানিরা ১০ এপ্রিলের মধ্যে সারাদেশ তাদের দখলে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য, সাধারণ ছাত্রজনতা ও সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা চট্টগ্রাম কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর বিদ্রোহের মাধ্যমে শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানিরা বিমান হামলার মাধ্যমে এ সমস্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়। বীর বাঙালি জীবনের বিনিময়ে অঞ্চলগুলোর পুনঃনিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় অস্থায়ী সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমেদের উপর। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেন। শুরু হয় অনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পঠিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।