পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ক্রমশ জনগণের আস্থাহীনতার সংকটে পতিত হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো সকল পক্ষের অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং বেশীরভাগ স্থানে বিএনপি জোটের প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়তে শুরু করেছিল। ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক পাক্ষিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচনী সংস্কৃতির সে ইতিবাচক ধারায় ছেদ বা ব্যত্যয় ঘটতে শুরু করে। এমনকি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপের ফলাফল বিরোধী দলের অনুকূলে যাওয়ার পর পরবর্তী ধাপগুলোতে সরকারী দল ও প্রশাসন যৌথভাবে নির্বাচনকে নিজেদের মত করে পরিচালিত করার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রথমবারের মত দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতার প্রভাব, জবরদখল ও কারচুপির নজিরবিহীন রেকর্ড তৈরী হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের বেশীরভাগ স্থানেই ক্ষমতাসীনদের প্রভাবের কারণে বিএনপি তাদের প্রত্যাশিত প্রার্থীকে মনোনীত করতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। শত শত ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এক নতুন ট্রেন্ড স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে যখন দলীয় প্রতীকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নতুন প্রত্যাশা জেগে উঠেছে, তখন ২৮ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জেলা পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী ব্যবস্থার এক ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথমত, আমাদের জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক নির্দেশনা (সংবিধানের আর্টিকেল ৫৯ ও ৬৫ অনুসারে) থাকলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনে আইয়ুবী আমলের মৌলিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটি শুরু থেকেই বিতর্কিত হয়েছে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে জেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট দেবেন শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। আগের প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধীদল ও জোট অংশ নিলেও এই নির্বাচনে তারা অংশ নিচ্ছে না। এ হিসেবে নির্বাচনটি হচ্ছে এমনিতেই একদলীয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ সাম্প্রতিক সময়ের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে যেনতেন প্রকারে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে জেলা পরিষদে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথকে আগেই নিষ্কণ্টক করা হয়েছে। এরপরও জেলা পরিষদ নির্বাচনের এক-তৃতীয়াংশের বেশী জেলায় চেয়ারম্যান এবং ৩ শতাধিক সদস্য পদে সরকারী দলের প্রার্থীদের ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিতব্য জেলা পরিষদ নির্বাচনেও নানাবিধ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক থেকে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একপাক্ষিক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। জনগণের ভোটের অধিকার সংরক্ষণ ও আস্থাপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে খোদ নির্বাচন কমিশনকে যেমন সচেষ্ট দেখা যায়নি, এরই ফলে সাধারণ জনগণও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি যেন আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাহ্যত যতই স্বচ্ছ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা থেকে জনগণ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে একই নির্বাচনী সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি অব্যাহত আছে। শুধু তাই নয়, একপাক্ষিক জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোটার লিস্টে বড় ধরনের গলদ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, নির্বাচিত সহস্রাধিক জনপ্রতিধির নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলেও আইন লঙ্ঘন করে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের জেলা পরিষদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের নাম গেজেটেড হলেও জেলা পরিষদের ভোটার তালিকায় সহস্রাধিক নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এবং অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নাম ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে ভোটের আগেই নির্বাচনটিকে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। যে নির্বাচন কমিশন দেশের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত ও গেজেটেড জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৬৭ হাজার ভোটারের নামই ঠিকমত তালিকাভুক্ত করতে পারেনা, সে নির্বাচন কমিশন দেশের ১০ কোটির বেশী মানুষের ভোটার লিস্ট সঠিকভাবে তালিকাভুক্ত করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। নানা উপায়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, ভোটারবিহীন ও ভোটকেন্দ্র দখলের নির্বাচনের পাশাপাশি ভোটার লিস্টে গলদ সৃষ্টির যে নির্বাচনী সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তা দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকেই জনগণের কাছে আস্থাহীন করে তুলেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই নির্বাচনী সংস্কৃতির অবক্ষয় রোধ করে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দেশের সরকার এবং সকল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মতৈক্য ও সমঝোতার প্রত্যাশা করছে জনগণ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।