Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাখাইনে গণহত্যা-নির্যাতন-উৎসাদন বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা বাড়লেও মিয়ানমার সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। এখনো সেখানে সেনা ও উগ্রবাদীদের হত্যাকান্ড, নির্মূল ও বিতাড়ন অভিযান চলছে। কী ধরনের হত্যা-নির্যাতন-বিতাড়ন রাখাইনে চলছে তা এখন আর বিশ্ববাসীর অবিদিত নেই। রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হত্যা-নির্যাতনের নির্বিচার শিকার হয়েছে বহু নারী-পুরুষ-শিশু। মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছে গণহারে। ৩০ হাজার মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। কম করে হলেও ২২ হাজার মানুষ বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সরকার ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের এই যুগপৎ অভিযানকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও ব্যক্তি জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে অভিহিত করেছে। আশা করা গিয়েছিল, মিয়ানমারের সামরিক সরকার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তার অবসান ঘটবে এবং রোহিঙ্গারা তাদের জন্মগত ও নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে। এ আশা চরম হতাশায় পরিণত হয়েছে। গত দু’মাস ধরে রাখাইনে যা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। সামরিক সরকারের সময়ও রোহিঙ্গাদের ওপর এমন অত্যাচার, নির্যাতন হয়নি। ঢালাও হত্যাকা- ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এবং সেই সরকারের প্রধান গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি। অথচ সেই সরকারই সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছে। এ ব্যাপারে সুচির ভূমিকা ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। দীর্ঘদিন বলতে গেলে নীরব থাকার পর তিনি সম্প্রতি যা বলেছেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেছেন, ‘অভিযোগ অতিরঞ্জিত এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ তাঁর এ কথার পর জাতিসংঘ তাকে রাখাইনে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসার অনুরোধ  জানিয়েছে। জাতিসংঘের মিয়ানমার সংক্রান্ত বিশেষ উপদেষ্টা বিজয় নাবরিয়ার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা না নিয়ে অভিযান শুরু করায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। সুচিকে বলছি, মংডু ও বুথিডংয়ে গিয়ে সেখানকার বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।’
জাতিসংঘের এই বক্তব্য ও আহ্বান সুচির মধ্যে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারবে কিনা, আমাদের জানা নেই। তবে এ পর্যন্ত তার নীরবতা দেখে এবং কথিত বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, রাখাইনে যা কিছুই ঘটেছে ও ঘটছে তার পেছনে সুচির দৃঢ় সমর্থন রয়েছে। এর আগে তার কোনো কোনো বক্তব্যে মুসলিম বিদ্বেষ লক্ষ্য করা গেছে। এমতাবস্থায়, রোহিঙ্গাদের হৃত অধিকার তিনি বা তার সরকার স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দেবে, এমনটি মনে করার কারণ নেই। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি রোহিঙ্গারা হত্যা-নির্যাতনের এই তা-ব থেকে রেহাই পাবে না? তারা কি নির্মূল হয়ে যাবে? তাদের জন্মগত ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি এগিয়ে আসবে না? শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তেমন কোনো সাড়া লক্ষ্য না করা গেলেও এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে রোহিঙ্গাদের চলমান মানবিক বিপর্যয় রোধের কোনো উপায় নেই। হত্যা, ধ্বংস, পীড়ন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্র হারাবে, উৎসাদিত হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। আশার কথা এটুকু যে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায় বিষয়টির গভীরতা আস্তে আস্তে অনুধাবন করতে পারছে। তাদের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া তারই প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪টি দেশ মিয়ানমার সরকারকে মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে তাগিদ দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা মোচনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ৭০ জন পার্লামেন্ট সদস্য সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যে সব রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়েছে তাদের জরুরি ভিত্তিতে সুরক্ষা দরকার।’ দাবী করা হয়েছে, ‘তাদের ওপর নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’ সেখানে মানবিক বিপর্যয় রোধে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য মিয়ানমার সরকারকে চাপ সৃষ্টি করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়ের কার্যকর চাপ সৃষ্টি ছাড়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতির অবসান হওয়া সম্ভব নয়। এটা অবশ্যই অস্থায়ী সমাধান। এই ইস্যুর স্থায়ী সমাধান জরুরি ও অপরিহার্য। সেটা হতে পারে, রোহিঙ্গাদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারের ভূমিপুত্র। কয়েকশ’ বছর ধরে সেখানে তারা বংশ পরম্পরায় বসবাস করছে। স্বাধীনতার পর সে দেশের প্রেসিডেন্ট উনু রোহিঙ্গাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নেন। ’৪৭ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গারা ভোট দেয়। ’৫৪ সালে তাদের পরিচয়পত্রও দেয়া হয়। সামরিক শাসকরা তাদের এসব অধিকার হরণ করে। তারা দেশের অধিকার যেমন তেমনি সকল প্রকার অধিকার ও সংরক্ষণ হারিয়ে নিরালম্ব হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের এসব অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই দীর্ঘদিনের এ সমস্যা বা ইস্যুর অবসান হতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়কে স্থায়ী সমাধানের দিকেই যেতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করবো, বিলম্ব না করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের স্থায়ী সুরক্ষা ও সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এখনই নেবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন