পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধদের সম্মিলিত হামলায় যখন সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, যখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে অসহায় নিরস্ত্র মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, যখন রোহিঙ্গা নারীদের ঘর থেকে বের করে পাইকারী হারে ধর্ষণ করা হচ্ছে, যখন তাদের এই মহাবিপদে কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছে না, তখন একটি বৃহৎ শক্তি মৌখিকভাবে হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এই বৃহৎ শক্তিটি হলো গণচীন। বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছে, যখন বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের পুশ ব্যাক করে মিয়ানমারে ঠেলে দিচ্ছে, তখন চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আরো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে চীন ঘোষণা করেছে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত। সফররত মিয়ানমার প্রতিনিধিদলকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং রি একথা বলেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত যেন অস্থির হয়ে না ওঠে সেজন্য মিয়ানমারের সাথে চীন কাজ করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। একজন ডুবন্ত মানুষ ভাসমান খড়কুটা ধরে হলেও বাঁচতে চায়। রাখাইন এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা যখন জীবন নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে ছুটছে তখন গণচীনের এই আহ্বান কিছুটা হলেও রোহিঙ্গাদের স্বস্তি দিতে পারে। আজ আমেরিকা এবং পশ্চিমা দুনিয়া স্বীকার করছে যে, বর্তমানে পৃথিবীতে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি। বিশ্ববিখ্যাত মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বীকার করেছে, তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য উপগ্রহ থেকে ছবি তুলেছে। ঐসব ছবি থেকে দেখা যায় যে, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বর্মী সেনারা রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐসব ছবি থেকে আরো দেখা যায়, রোহিঙ্গারা তাদের বাপ-দাদার ভিটা মাটি ছেড়ে পালাচ্ছে। হাই ডেফিনেশন ছবি থেকে দেখা যায়, হাজার হাজার রোহিঙ্গা পদব্রজে এবং নাফ নদীতে নৌকাযোগে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। এখন তারা এতোদূর বলছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনী যে জুলুম করছে সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
পরিস্থিতি যেখানে এতো গুরুতর সেখানে সেই পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাশিয়া তথাকথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গালভরা বুলি নিয়ে সিরিয়ায় বোমা মেরে চলেছে। অথচ মিয়ানমারে নিরস্ত্র জনতাকে একটি সামরিক চক্র বছরের পর বছর ধরে নিধন করে যাচ্ছে, মানবতার এতো বড় অপমানেও এবং মানবাধিকার এমন ভয়াবহ রূপে লঙ্ঘিত হলেও রাশিয়ার কোনো বিকার নাই। ভারত নিজ দেশে এবং বিদেশে মানবাধিকারের বড় ফেরিওয়ালা। বাংলাদেশে সম্প্রদায় বিশেষের সামান্য ক্ষতি হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা সে ব্যাপারে নাক গলায়। এই তো কয়েক বছর আগেও ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য সমস্যায় নাক গলিয়েছিলো। অজুহাত ছিলো, তার সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তার নাকি নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। মিয়ানমারও ভারতের প্রতিবেশী। অথচ সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ২৫ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানের মধ্যে ১২ লক্ষকেই ঘরছাড়া করেছে। এসব উদ্বাস্তুদের মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৫ লাখ, পাকিস্তানে ২ লাখ, সউদী আরবে ৪ লাখ এবং থাইল্যান্ডে ১ লাখ। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক গত অক্টোবর মাস থেকে আরাকানে যে জাতিগত নিধন চলছে তার ফলে মাত্র ২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাস্তুহারা হয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে চোরা পথে বাংলাদেশে ঢুকছে। জাতিসংঘই বলেছে, সঠিকভাবে গণনা করলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। বলা হয় যে, মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানের ফলে ৩০ হাজারেরও বেশী মানুষ ছিন্নমূল হয়েছে। এদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের জন্য সুযোগ খুঁজছে। জাতিসংঘ তাকিদ দিয়েছে, এসব ছিন্নমূল নির্যাতিত মানুষের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত যাতে করে তারা তাদের চরম দুর্দিনে প্রাণে বেঁচে থাকার একটি অবলম্বন পায়। তাদের এই উদ্বেগ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তারা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসছে না। অথবা এই জাতিগত নিধন ও গণহত্যা বন্ধের জন্য মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না।
এমন একটি পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের প্রকৃত ক্ষমতার আধার অং সান সূচি সিঙ্গাপুরে বলেছেন যে, তিনি মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু কোন কোন জাতিগোষ্ঠী সেটি তিনি মোটেই পরিষ্কার করে বলেননি। উল্লেখ করা যেতে পারে, মিয়ানমারের রয়েছে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারা তাদের অন্যতম। বার্মার মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ হলো রোহিঙ্গা মুসলমান। এই ২৫ লাখ মুসলমানের সমস্যা এবং তাদের গণহত্যা সম্পর্কে সূচি এখনো সম্পূর্ণ উদাসীন। এমন পটভূমিকায় সামরিক শক্তির পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার যে আহ্বান গণচীন করেছে সেটি শুধু মুখে বললেই চলবে না। সেটিকে কার্যকর করার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর গণচীনের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সকলে সকলের ওপর চাপ দিতে পারে না। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে গণচীনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আজ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার করছে সেটিও সরবরাহ করেছে চীন। বাংলাদেশের মানুষ তাই আশা করে মিয়ানমার সরকারের এই গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ করার জন্য চীন সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।