শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে,কোথা থেকে শুরু করা যেতে পারে– এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। কারণ,বাংলাদেশ নামের ভূখÐ বিনির্মাণ ও এখানকার জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় সহ,অধিকার আদায়ের প্রতিটি যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা এতই বিস্তৃত এবং সর্বব্যাপী এক প্লাবন যে,তার তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোথায় নেই তিনি? বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। এ-কারণে,তিনি ও তাঁর কর্মব্যাপ্তি নিয়ে বৈচিত্র্যময় আলোচনার সূত্রপাত নানান দিকে,নানান মাধ্যমে।
পৃথিবীতে জন্মের পর,মানুষ ক্রমে নিজেকে চেনার জানার চেষ্টায় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত শ্রমনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে থাকে। প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে তার নিজস্ব সুনির্দিষ্ট অবস্থানরেখাটি কোথায়– তারই অনুসন্ধানে,জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এক নিরন্তর আবিষ্কারের ভেতর দিয়ে যায়। আত্ম-আবিষ্কারের এই প্রচেষ্টা সকল মানুষের ক্ষেত্রে,সকল দেশ-সংস্কৃতিতে,কাল থেকে কালান্তরে– এক অমোঘ সত্য। আমাদের বাংলায়ও,এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। নদী,বৃক্ষ,জল-কাদা ও সবুজ ফসলের মাঠ তথা বাংলার উদার অবারিত প্রকৃতি এই জনপদের মানুষকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ইতিহাস থেকে উঠে আসে বার বার এই স্বতঃসিদ্ধ,প্রত্যয়– বাঙালি,বাংলা ও বাংলাদেশ।
নিজেকে চেনা,নিজেকে নির্মাণ ও বিশ্বমানবসভায় স্থাপন করবার এক উজ্জ্বতম উদাহরণ পাই আমাদেরই সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত ইতিহাসে,চর্যাপদে– এই বাংলারই আদি কাব্য তথা দোঁহায়,যেখানে বাঙালি আদি কবিতা-শ্লোক নির্মাতা চর্যাপদের সিদ্ধপুরুষ ভুসুকু,(যদিও তিনি বাঙালি কি-না,এই তর্ক প্রচলিত) যখন লিখলেনঃ বাজ ণাব পাড়ী পউআ খালে বাহিউ। অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।।/আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী। ণিঅ ঘরিণী চন্ডালেঁ লেলী।।/ডহিঅ পাঞ্চ পাটণ ইন্দি বিসআ ণঠা।/ণ জানমি চিঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ।
নিঅ পরিবারে মহাসুহে থাকিউ।।/চউকোড়ি ভন্ডার মোর লইআ সেস।/জীবন্তে মইলেঁ নাহি বিশেষ।।
অর্থাৎ“বজ্রনৌকা পাড়ি দিয়ে পদ্মানদীতে গেলাম। নির্দয় দস্যু দেশ লুট করে নিয়ে গেল। নিজের গৃহিনীকে (কামতৃষ্ণাকে) চÐালে নিয়ে যাবার পর ভুসুকু আজ তুমি বাঙালি হলে। পঞ্চপাটন(স্কন্ধ,দগ্ধ,ইন্দ্রিয়ের বিষয় বিনষ্ট। জানি না আমার চিত্ত কোথায় গিয়া প্রবেশ করলো। আমার সোনা রূপা কিছুই থাকলো না,নিজের পরিবারে মহাসুখে থাকলাম। আমার চৌকাটি ভান্ডার নিঃশেষ হলো,জীবনে মরণে আর ভেদ নেই।” ৪৯ নং শ্লোকে ভুসুকুই প্রথম বাঙালি শব্দটি ব্যবহার করলেন। সম্ভাবনা এই,কবি ভুসুকু বেঁচে ছিলেন ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। যা ছিল ৭৭০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এই ভূখÐের মানুষের ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার ইচ্ছের লিখিত রূপই প্রায় সাড়ে ১২০০ বছরের। নিশ্চয় বলা যায়,এর আরম্ভ আরো আগে,আলো যেখানে ফেলা যায়নি এখনও। এতো প্রাচীন ইতিহাস পৃথিবীর মধ্যে খুব কম জাতিরই রয়েছে। এ আমাদের গর্ব করার মতো এক অনন্য উদাহরণ।
ভুসুকু বর্ণিত পদ্মার উপমা যদি হয়,অধুনা আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ,তবে নির্দয় দস্যু,সে তো বহিরাগত, শক,হুন,পর্তূগিজ,পাঠান,মোঘল,ইংরেজ এবং সবশেষে পাকিস্তানী শাসন-শোষণ নির্যাতন-নিপীড়ন। মানব নিপীড়নের এই জায়গাটিতেই গর্জে উঠে গণমানুষের কণ্ঠস্বর তথা স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন যুগমানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রাচীন কবি ভুসুকুর প্রচেষ্টাকে যদি একজন ব্যক্তির বাঙালি হয়ে ওঠার একক চেষ্টা হিসেবে গণ্য করি তাহলে আধুনিক বাংলা ভূখÐে সর্বকালের মধ্যে একজনই হয়ে উঠেছিলেন সকল বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা-কন্ঠ-প্রতিভূ– আত্মপরিচয়ের দর্পণ– বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যক্তি মুজিব হয়ে উঠলেন স্বাধীনতা,সাম্য,শান্তি ও ন্যায়ের জীবন্ত উদাহরণ।
তাঁর জীবনও,বাংলা জনপদ,নদী,নৌকা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমÐিত। তার অবিস্মরণীর উচ্চারণঃ ‘জয়বাংলা।’ তাঁর কাছেই দেশবাসী এই অমোঘ আত্মপরিচয়ের পাঠ নিয়েছিল– বাংলা আমার দেশ,বাংলা আমার ভাষা। বুঝতে শিখেছিল বাংলাদেশ কেন শুধুমাত্র একটি দেশ হবে না,এটি হবে একটি ‘বিশেষ সভ্যতা’ যা এদেশের অসাধারণ ভাষা,সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস-সংগ্রাম,কারো সাথে শত্রæতা নয়,সকলের সাথে বন্ধুত্ব– এই আদর্শ তথা বিশ্বমানবতাবোধ। সুতরাং তিনি এক মহাজীবন।
“সবার উপরে মানুষ সত্য”– চÐীদাস তথা বাংলার মানুষের এই চিরন্তন সত্যোচ্চারণটি তিনি তাঁর জীবনে ধারণ করেছিলেন বিধায়,চেয়েছিলেন– “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” এইভাবে তিনি তাঁর কাল ও কালের মানুষকে সুসংবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সীমার মাঝে অসীম এক সম্ভাবনাকে জাগ্রত করেছিলেন।
অতীতে,বাঙালির খÐ খÐ স্বপ্ন কখনও একতাবদ্ধ,সামগ্রিক হয়ে উঠতে পারেনি ১৯৭১ এর আগে। এর কারণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দেখাচ্ছেন এইভাবে– “ঈর্ষা,দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন,সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে,কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই,ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্তে¡ও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবু এরা গরিব। কারণ,যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না,আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী,শেখ মুজিবুর রহমান..পৃষ্ঠা-৪৮)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাটি ও মানুষের ভিতর থেকে উঠে এসে হয়ে উঠেছিলেন তাদের সকলের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর,এ-কারণেই তাঁকে বলা হয় জনগণের নেতা,যে-নেতা রাষ্ট্রীয় অন্যায়,শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন দৃঢ়তা,প্রজ্ঞা,সাহস ও সত্যবাদিতার শক্তিতে শুধু নয়,মানুষকে ভালোবেসেও। ভিন্ন প্রকৃতির এই মানুষটির বাঙালি জাতির প্রতি ছিল অকৃতিম ও পরম ভালোবাসা। ফলে তিনি দেখিয়েছিলেন কোথায় কিভাবে তাঁরা ঘুমিয়ে আছে। প্রতিবাদহীনতার ঘুম,বিচ্ছন্ন ক‚পমÐুক হয়ে থাকার ঘুম থেকে জেগে ওঠা যে প্রয়োজন– এই কথাটি তাঁর মতো করে কেউ কখনও উচ্চারণ করেনি এই বাংলায়। অতএব তিনি হয়ে উঠলেন কোটি জনতার কন্ঠস্বর। অদম্য সৎ সাহস,অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন প্রতিবাদী মানসিকতা,গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা,তাদের দুঃখ-দৈন্য-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার সংকল্প তাঁকে অল্প বয়সে অবধারিতভাবেই রাজনীতিতে নিয়ে আসে এবং তিনি হয়ে ওঠেন মানুষের নেতা। এরকম বিস্ময়কর নেতৃত্ব পৃথিবীতে বিরল।
তিনি বললেন,এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা। ‘জয়বাংলা’ শব্দটিই হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার আদায়,নিজস্ব ভূমি ও ভাষার দাবী এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন সকল নিপীড়িতের জন্য এক সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা নির্মাণের মহাশিরোনাম।
উল্লেখ্য,দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘নেতা’ হয়ে-ওঠা এই মানুষটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই বুঝেছিলেন,পাকিস্তানী শাসকদের এই ভূখÐের মানুষকে শোষণ বঞ্চনার হীন কৌশলগুলো। অতএব,তিনি লক্ষ্য স্থির করলেন– শুধুমাত্র রাজনৈতিক মুক্তিই নয়,অর্থনৈতিক মুক্তিও। আমরা দেখি,বিখ্যাত ছয়দফা দাবির মধ্যে তিনটিই ছিল অর্থনীতি সম্পর্কিত। স্বাধীনতার পর তিনি শুরু করতে চেয়েছিলেন সাংস্কৃতিক মুক্তির পথও। সেটা হয়নি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আকস্মিকভাবে স্তম্ভিত,স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিল জেগে-ওঠা বাংলা।
বিশ্বস¤প্রদায়ও তাঁর প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল যা এমনি এমনি আসেনি। এসেছে তাঁর কর্মের মাধ্যমে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্টপতি প্রণব মুখার্জী তাঁর আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন এভাবে– “তিনি ছিলেন অসা¤প্রদায়িক,শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক আর একজন পরিপূর্ণ বাঙালি। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে একটি জাতিকে মুক্ত করা এবং বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য।” প্রণব মুখার্জী আরও বলছেন,“নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমার প্রথম শিক্ষা।” দেশ ও জাতির উপর তাঁর বিশ্বাস স্থাপিত ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে। তাই বিশ্বনেতৃবৃন্দ তাঁর জীবন সংশয়ের সতর্কতা দিলেও,বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “ওরা আমারই সন্তান।আমাকে কেন হত্যা করবে?”
নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেও,অতিক্রম করে চলেছেন কালের পরিধি। এর গতি থামানো অসম্ভব। ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে করে তুলেছে আরো বেশী অপ্রতিরোধ্য,দিয়েছে মহাকাব্যিক বীরত্ব ও অমরতা। এমন দিন কখনও আসবে না যেদিন তাঁর নাম উচ্চারিত হবে না। এটিই কালের বিধান। এখানেই মানববিদ্বেষী অপশক্তির পরাজয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।