Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আঞ্চলিক জিঙ্গোইজম পশ্চিমা প্রক্সি এবং ইউক্রেনের বিপর্যয়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দুইটি দেশের মধ্যে একটি সীমিত আকারের যুদ্ধ হলেও এর পেছনে বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব থাকায় এটি এখন বৈশ্বিক ¯œায়ুযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহে বড় ধরণের প্রভাব সৃষ্টি এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এ যুদ্ধ ইতিমধ্যে অনেকটা সীমিত আকারে প্রথম মহাযুদ্ধের মত আঞ্চলিক মহাযুদ্ধে পরিনত হয়েছে। এখানে ইউক্রেনের বাইরে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ না হলেও কার্যত সারাবিশ্বে এই যুদ্ধের আঁচ লেগেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজ দেশের সামগ্রিক বাস্তবতার নিরীখে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে যুদ্ধ হয়তো এত দীর্ঘায়িত হতনা। কোনো পরাশক্তির দ্বারা কোনো ক্ষুদ্র, দুর্বল প্রতিবেশি দেশ আক্রান্ত হোক, দখল হয়ে যাক তা কারো প্রত্যাশা হতে পারেনা। কিন্তু বিষয়টা যখন রাষ্ট্রশক্তিসমুহের পুরনো আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বৈরীতা ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির নীলনক্সার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে তখন সাধারণ প্রবণতা অসাড় হয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া এবং ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙ্গে যাওয়ার পর গত তিরিশ বছরে ন্যাটোকে ক্রমাগত শক্তিশালী আক্রমনাত্মক এবং সম্প্রসারণশীল করে তুলেই ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিরা ক্ষান্ত হয়নি, আফগানিস্তান, ইরাক দখল করেছে। সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে গণবিরোধী যুদ্ধ চাপিয়ে পুরো অঞ্চলে একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে জায়নবাদি ইসরাইলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর আগ্রাসন চালানোর বøাঙ্কচেক দিয়ে রেখেছে। ওরা সারা বছর ধরে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইরানসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য বা বিশ্বের যে কোনো স্থানে গোয়েন্দা তৎপরতা, বিমান-ড্রোন হামলা ও টার্গেটেড কিলিং চালিয়ে যাচ্ছে। এসব তৎপরতার জন্য যে মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের বাজেট থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে মার্কিন ফেডারেল বাজেট থেকে ইসরাইলকে বছরে গড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের নি:শর্ত সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। জায়নবাদি ইসরাইলকে মার্কিন সরকারের এই সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

প্রথম মহাযুদ্ধে প্রায় হারতে বসা বৃটিশরা ইহুদি ব্যাংকারদের সমর্থন পাওয়ার শর্তে তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি স্বতন্ত্র আবাসভ’মি গড়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। ধর্মীয় জনসংখ্যাতাত্তি¡ক বাস্তবতায় ১৯১৭ সালে বালফোরের সেই ঘোষণাটি ছিল অবাস্তব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকষ্টের প্রপাগান্ডা ব্যবহার করে ইহুদিদের প্রতি যুদ্ধবিজয়ী পশ্চিমা বিশ্বের বাঁধভাঙ্গা দরদের খেসারত দিতে হল ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানদের। ১৯৪৮ সালে ইরোপ-রাশিয়া থেকে ইহুদিদের অগ্রবর্তী দলে সশস্ত্র হাগানা মিলিশিয়ারা জাহাজ বোঝাই হয়ে ফিলিস্তিনের মাটিতে অবতরণ করে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের জায়গাজমি-বাড়িঘর দখল করে পুরনো সবকিছু বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটায়। এই অনৈতিক বর্বরতা আরবরা মেনে নেয়নি। ইঙ্গ-মার্কিন বøুপ্রিন্ট এবং ব্যাপক সামরিক সহায়তায় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে আরববিশ্বের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইসরাইল। ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি, যুদ্ধবিমান, সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইল প্রতিবারই আরবদের সম্মিলিত প্রতিরোধে পরাস্ত হওয়ার মুখে পশ্চিমা ক’টনৈতিক তৎপরতা ও যুদ্ধবিরতির ছদ্মাবরণে জায়নবাদিদের পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গেছে। গত তিন দশকে আফগানিস্তান-ইরাক দখল থেকে শুরু করে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধের নেপথ্যে জায়নবাদী ইসরাইলী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও প্রপাগান্ডা মেশিনারিজমের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভ’মিকা ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে তা নতুন মাত্রায় হাজির হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউরোপে যে কয়টা নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল ইউক্রেন তার মধ্যে অন্যতম ও বৃহত্তম। এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পারমানবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ কৌশলগত অঞ্চল। ইউরোপের সাথে রাশিয়ার পুরনো বিবাদের কারণেই ইউক্রেনকে পারমানবিক অস্ত্রসজ্জিত করে ইউরোপের সবচেয়ে নিরাপদ সুগভীর বাঙ্কারে সমৃদ্ধ করা হয়েছিল। এখন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে টিকে থাকতে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরী বাঙ্কারগুলো যথেষ্ট ভ’মিকা পালন করছে। জেলেনস্কি ও তার সভাসদরা সে সব বাঙ্কারের সামরিক দফতর থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনার অনেক আগে থেকেই রাশিয়া বার বার ইউক্রেনে তার নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থের প্রশ্নে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে রাশিয়া যে বার্তা দিয়েছিল, ইউরোপ-আমেরিকা এবং জেলেনস্কি তা বুঝতে অক্ষম হওয়ার কথা নয়। ইসরাইলের বশংবদ ইহুদি জেলেনস্কিকে ইউক্রেনের ক্ষমতায় বসানো এবং কট্টর রাশিয়া বিরোধী ভ’মিকা গ্রহণের মাধ্যমে পশ্চিমাদের পক্ষাবলম্বন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক তৎপরতার পেছনে তাদের যে পরিকল্পনাই থাক না কেন, তাদের হিসাব ও পরিকল্পনায় যে মারাত্মক ভুল ছিল তা ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে। ইরাকে-আফগানিস্তানে আমেরিকা ও ন্যাটোর ২০ বছরের যুদ্ধে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে পরাজয়ের গøানি নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হলেও ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থান সম্পুর্ন আলাদা। পশ্চিমা বিশ্লেষকরাই এখন স্বীকার করে নিয়েছেন, মাত্র চার মাসের মধ্যেই ইউক্রেনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরাজয় ঘটে গেছে। ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় একের পর এক শহর রাশিয়ার বাহিনীর হাতে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার জনসাধারণের একটি বড় অংশই রাশিয়ান বংশোদ্ভুত। তারা রাশিয়ান দখলদারিত্ব সমর্থন করছে। যুগ যুগ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকা ইউক্রেনের সাথে আমেরিকা-ন্যাটোর ইরাক-আফগানিস্তান দখলের মধ্যে পার্থক্যটা এখানেই। আশির দশকের শেষদিকে সোভিয়েত বাহিনীকেও আফগানিস্তান থেকে পরাস্ত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। ¯œায়ুযুদ্ধকালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয়, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে যেরূপ ভ’মিকা রেখেছিল, এখন ইউক্রেনে ইঙ্গ-মার্কিনীদের কৌশলগত পরাজয় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের পতনে অনূরূপ ভ’মিকা রাখবে। ইউক্রেনে ইসরাইল ও পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট জেলেনস্কি বাহিনীর পতনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের পতন ঘনিয়ে আসার ইঙ্গিত বহন করছে। এমন মন্তব্য করেছেন বুশের ইরাক দখলের অন্যতম সহযোগি সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেøয়ার। যুদ্ধের শুরুতেই জেলেনস্কি বাহিনীর পরাজয়ের আশঙ্কায় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত নিজে নিজে মধ্যস্থতাকারির ভ’মিকা নিয়ে রাশিয়া-কিয়েভে বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। পশ্চিমাদের বশংবদ শিখন্ডীরা কখনো পশ্চিমা মতামতের বাইরে যেতে পারেনা। ইসরাইলের আয়রনডোম রুশ বাহিনীর কাছে জেলেনস্কির বাহিনীর পতন ঠেকাতে পারছেনা।

পশ্চিমা তথা মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জায়নবাদী ইসরাইলী লবিস্ট ও আইপ্যাকের মত সংস্থার প্রভাব যতই থাকুক। প্রেসিডেন্ট বুশ বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একপেশে বর্ণবাদী নেতাদের পাশাপাশি সেখানে জনপিলজার, নোম চমস্কি, পেপে এস্কোবার, স্কট রিটার বা ক্রিস হেজেস’র মত মুক্তবুদ্ধির অ্যাকাডেমিসিয়ান-বুদ্ধিজীবী ও ভেটারান সাংবাদিক তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবিক দায়বদ্ধতার আপসহীন ভ’মিকা মার্কিন জনগণের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য আলোকবর্তিকার মত পথ দেখাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মূল্যায়ণ নিয়ে তিন মার্কিন গবেষক-সাংবাদিক লেখক নোম চমস্কি, ক্রিস হেজেস এবং জন পিলজারের করা তিনটি উদ্ধৃতি সামনে রেখে একটি নিবন্ধ লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ান কলামিস্ট- সাহিত্যিক কেইতলিন জনস্টন। চলতি সপ্তাহে আইসিএইচ বøগে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। বিরাশি বছর বয়ষ্ক বর্ষিয়ান সাংবাদিক জন পিলজার তার সারাজীবনের যুদ্ধ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে ইউক্রেন যুদ্ধকে জিংগোইজম এবং প্রপাগান্ডা যুদ্ধের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় অভিন্ন মত দিয়েছেন নবতিপর দার্শনিক অ্যাকাডেমিসিয়ান নোম চমস্কি। তিনি বলতে চেয়েছেন, পশ্চিমা মেইনস্ট্রীম মিডিয়া ও গুগলের মত তথ্য সম্প্রচার মাধ্যমে নির্বিচারভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানকে ‘আনপ্রোভক্ড ইনভেশন’ বা বিনা উস্কানিতে দখল বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটা বলতে অনেকটা বাধ্য করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের প্রপাগান্ডার চরিত্র ফুটে উঠেছে। চমস্কি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রচারণা ঘিরে সেন্সরশিপের যে বাড়াবাড়ি চলছে তার জীবনের প্রায় শতাব্দীকালের অভিজ্ঞতায় মার্কিন সমাজে আর কখনো এমনটা দেখা যায়নি। মার্কিন ফ্রি-ল্যান্সার সাংবাদিক ক্রিস হেজেস মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে চলমান বিশ্ব একটি পারমানবিক যুদ্ধের খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে। সেই কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ব কখনো এতটা পারমানবিক যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। ইউক্রেনের যুদ্ধবাদি জিঙ্গোইজমের নেতা জেলেনস্কি মূলত পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নীলনকশার আওতায় তার দেশের জনগনকে রাশিয়ার মুখোমুখি একটি প্রক্সিযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক, অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক, ক’টনৈতিক ও প্রপাগান্ডা যুদ্ধ শুরুর একমাসের মধ্যেই পশ্চিমাদের কৌশলগত পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে।

পশ্চিমা কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও ইউনিপোলার আধিপত্যের দিন শেষ হওয়ার যে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন, তার পেছনের শক্তি হিসেবে চীন-রাশিয়ার সামরিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ঐক্য ও সহযোগিতার কথা বলেছেন। তাঁর এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা প্রমানিত হতে চলেছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙ্গে দেয়া হলেও ন্যাটোর সম্প্রসারণ, আগ্রাসী চরিত্র নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উপর একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্যপূর্ণ নীতির বদলে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি, নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধের পাশাপাশি সরাসরি সামরিক হুমকি চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমাদের বদ মতলব আঁচ করে চীন-রাশিয়া তাদের প্রতিবেশিদের নিয়ে অভিন্ন পশ্চিমা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্মিলিত সামরিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত শক্তি প্রয়োগে সমন্বিত উদ্যোগের নাম সাংহাই কো-অপারেশন চুক্তি। ২০০১ সালের জুনমাসে ঘোষিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন পূর্নাঙ্গরূপে সংগঠিত হওয়ার আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টুইনটাওয়ারে সন্ত্রাসি বিমান হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে পরাজিত হয়ে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই যুদ্ধের অনানুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বে জিঙ্গোইজমের নজিরবিহিন বা সুনামির কথা বলেছেন প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিস্ট জন পিলজার। জিঙ্গোইজম শব্দটির উৎস ওরা বিশ্লেষণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, মূলত বৃটিশদের মধ্যে একদল লোক যারা নিজেদের দেশকে শ্রেষ্ঠ, শক্তিশালী প্রমান করতে সব সময় যুদ্ধের উন্মাদনায় থাকে। জিঙ্গোইজম শব্দটির প্রায় সমার্থক আরেকটি শব্দ হচ্ছে শোভিনিজম, এখন বৃটিশদের গন্ডি পেরিয়ে সে সব রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক শক্তিকে বোঝানো হয়, যারা নিজেদের জাতি, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে এবং এটা প্রমান করতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর আক্রমনাত্মক মনোভাব পোষণ করে এবং প্রতিপক্ষ ও প্রতিবেশীদের সাথে সব সময় যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে থাকে। পশ্চিমা প্রক্সি হিসেবে জেলেনস্কির উগ্র জাতীয়তাবাদী দেশাত্মবোধ, জায়নবাদী শক্তির প্রোপাগান্ডার পাশাপাশি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উগ্রবাদী মতাদর্শগুলো মুক্তবুদ্ধি মানুষের কাছে নতুনভাবে ধরা পড়তে শুরু করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের হিন্দুত্ববাদ বর্তমান বিশ্বে জিঙ্গোইজম ও শোভিনিজমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। সেখানকার প্রায় তিরিশকোটি মুসলমান নাগরিক এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পতিত হয়েছে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ পুরো উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও আন্ত:সীমান্ত নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নোম চমস্কির মত বুদ্ধিজীবীরা ভারতের মুসলমানদের উপর একটি গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমা প্রক্সি ইউক্রেন যুদ্ধ যেমন সারাবিশ্বের জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। একইভাবে ইউক্রেন-রাশিয়ার সম্মিলিত জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বড় ভারতের মুসলমানরা উগ্র হিন্দুত্ববাদের গণহত্যা শিকার হলে, পাকিস্তান বা চীনের সাথে সংঘাত দেখা দিলে তার পরিনতি আরো বেশি ভয়াবহ হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে আপস-সমঝোতার বদলে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক সহায়তা যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা হচ্ছে। এর ফলে কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগের বিনিময়ে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্রবাণিজ্য জমে ওঠা ছাড়া আর কোনো দেশ বা জনগণের কোনো লাভ নেই। ইঙ্গ-মার্কিন প্যাক্ট, ন্যাটো এবং ইসরাইলের প্রক্সি যুদ্ধকে ১০-২০ বছর দীর্ঘায়িত করে বিশ্বজুড়ে মানবিক বিপর্যয় বাড়িয়ে তোলা ছাড়া ইতিবাচক কোনো অর্জন নিশ্চিত করতে পারছে না। বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সামরিক জোট, সব অঘটনের মূল ন্যাটো ও জায়নবাদের জিঙ্গোইজম ও উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক ঐক্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেন


আরও
আরও পড়ুন