শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাতাসের ঢেউয়ে ভেসে আসছে মোহের মতো একটি তীব্র ঘ্রাণ। সে ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে প্রকৃতি। কীসের ঘ্রাণ এটি? নিশ্চয়ই কোনো ফুলের । কিন্তু কোন ফুল? মনে পড়ছে না তো । তবে মনে হচ্ছে এ ঘ্রাণ তার চেনা । এবং এ ঘ্রাণের ভিতর একটি সম্মোহনী শক্তি আছে। কী ফুল এটি ? কী ফুল? কী ফুল? ভেবে দিশেহারা হয় মুশফিক। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর রাজত্ব। আজ যেন চাঁদের অভিষেক।জোছনায় ঝলমল করছে চরিদিক । পৃথিবী যেন এক বিয়ের কণে । বিউটি পার্লারে যেয়ে যেন সে সেজে এসেছে ।অপরূপ লাগছে আজ তাকে। চিরচেনা প্রকৃতি আজ অচেনা লাগছে মুশফিকের কাছে। তার ঘরের সামনের নারকেল গাছটির উপ চাঁদের আলো ঠিকরে পড়েছে।গাছটিকে আজ একটি অলৌকিক বৃক্ষ বলে মনে হচ্ছে মুশফিকের। রাত কটা হবে? ৯টা? মুশফিক হাত ঘড়িরর দিকে তাকায়। ঘড়ি যেন তার সাথে কথা বলে ওঠে- কী হলো মুশফিক? সময জানতে চাও? ওই একটি কাজের জন্যই তো আমার কদর। তাও সবসময় নয়। শোনো এখন বাজে রাত ১০টা। শহরে এটা আবার কোনো রাত হলো? অবশ্য গ্রামের কথা আলাদা। গ্রামের রাত ৮টা বাজার সাথে সাথে খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ১০টা বাজলো সবার এক ঘুম হয়ে যায়। শহরে তা নয়। শহরে সবাই রাত জাগে। ফেস বুক টুইটার, বার, আরও অনেক কিছুর সাথে সঙ্গ দিতে দিতে তারা ভোর রাতে ঘুমায়।শহরের মানুষ নিশাচর। দিন যেন তাদের কাছে রাত। আর রাত যেন দিন। ঘ্রাণটা কোন ফুলের এবং কোন দিক থেকে আসছে তার সন্ধান করতে হবে । এ-অদ্ভুত অথচ অভাবনীয় স্বাপ্নিকঘ্রাণ তাকে যেন পাগল করে দিচ্ছে। মুশফিক দরোজা খুলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়। ঘ্রাণটা কোন-দিক থেকে আসছে, সে বোঝার চেষ্টা করে। শহরের বাড়ি হলেও তাদের বাড়িটি গ্রামের বাড়ির মতো বেশ জায়গা নিয়ে।বাবা বলতেন, শহর হোক আর গ্রাম হোক, বাড়ির চার পাশে জায়গা না থাকলে সেটা বাড়ি নয়, মনে হয় মুরগীর খোপ।আর এজন্য বাবা ১বিঘা জমির উপর এ বাড়িটে করেন। বিল্ডিং করার পর যে জায়গা রয়েছে সেখানে কিছু গাছ লাগিয়েছেন। একটি পুকুর কেটে ঘাট বাঁধিয়েছেন।গরমের সময় অবশ্য পুকুরে পানি খুব কম থাকে, প্রায় শুকিয়ে যায়। কিন্তু বরষার সময় পুকুরটি জলে টইটুম্বর থাকে। তখন তাকে গ্রামের পুকুরের মতেই মনে হয়।পুকুরে মুশফিকের বাবা বিভিন্ন জাতের মাছে ছেড়েছেন। বাজার থেকে তাই তাদের মাছ কিনতে হয় না। মুশিফিকের মনে হলো পুকুর ঘাটের দিক থেকে ঘ্রাণটা আসছে। সে ধীরে ধীরে পুকুর ঘাটের দিকে এগোতে থাকে।হঠাৎ তার মনে পড়ে এটা তো ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ।ছোট বেলায় মুশফিকরা যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতো, তখন বাড়ির উঠানের দক্ষিণ কোণায় একটি ছাতিম গাছ ছিলো। যখন তার ফুল ফুটতো, সে কী ঘ্রাণ। একদিন সে মাকে জিজ্ঞেস করে- মা এ ঘ্রাণ কীসের? মা ঘরের দাওয়ায় বসে আঙুল তুলে বলে –ওই যে গাছটি দেখছিস, ওটার নাম ছাতিম গাছ। আর এ ঘ্রাণ ওই গাছের ফুলের অর্থাৎ ছাতিম ফুলের। এ কথা বলে মা সতর্ক করে দিলেন- খবরদার ফুল ফুটলে ওগাছের কাছে যাবি না। কারণ, ফুলের গন্ধে গাছে জ্বিন পরীরা আসে।ওখানে সারা রাত নাচ গান করে। ওখানে কেউ গেলে তাকে পরীরা ধরে নিয়ে যায় কোহেকাফ শহরে। সেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারে না। তুই কোনো সময় ও গাছের কাছে যাবি না কিন্তু। মুশফিক মাকে নিশ্চিন্ত করতে বলে – আচ্ছা। মুশফিক জিজ্ঞেস করে, ‘মা কোহেকাফ শহর কোথায়? সেখানে কারা থাকে? ‘কোহেকাফ শহর সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারে। ওখানে জ্বিন আর পরীরা থাকে। কোহেকাফ শহর হলো জ্বিন রাজ্যের রাজধানী’ মা বলেন।মুশফিক আবার প্রশ্ন করে,কোহেকাফ শহর তো অনেক দূর, তাই না?‘ হ্যাঁ’ – মা বলেন। ‘ তাহলে অত দূর থেকে জ্বিন পরীরা আমাদের বাড়িতে আসবে কী করে? মায়ের মুখে হাসি-‘জ্বিন পরীরা আগুনের তৈরী। তাদের পাখা আছে। তারা বাতাসের বেগে উড়তে পারে।‘ও, তাহলে ঠিক আছে’-বলতে বলেতে ঘুমিয়ে পড়ে মুশফিক।
ছোট বেলা মায়ের এ কথা বিশ্বাস হলেও এখন তা আর হয় না।এখন তার মনে হয় রাতে ছাতিম ফুলের ঘ্রানের টানে যাতে মুশফিক ঘর থেকে না বের হয় সেজন্যই এ কথা বলেছিলেন।মুশিফিক ধীরে ধীরে পুকুর ঘাটে যায় । সান বাধাঁনো ঘাটের পাশে একটি ছাতিম গাছ।বেশ ফুল ফুলেছে। এখানে গাছটি হলো কবে? কই সে আগে তো দেখেনি? আবার ভাবে, সে দেখবে কী করে। পিএইচডি করার জন্য সে ৫বছর বিদেশে ছিল। এ সময় গাছটি হয়েছে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ তাকে মাতাল ঢেউয়ের মতো যেন দোলাচ্ছে।যেন এক অপার্থিব পরিবেশ ।বর্ষাকাল।পুকুরের পার ছুঁই ছুঁই জল। পুকুরকে তার মনে হচ্ছে একটি ভরা কলসি । কোনো রূপসি রমনী এইমাত্র যেন কলসিটি ভরেস্নানে নেমেছে জলে। হঠাৎ করে মিতাকে তার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে এখন যদি মিতা তার পাশে থাকতো । দুজনে কথায় কথায় হারিয়ে যেতে স্বপ্নের রাজ্যে। কিন্তু মিতাদের বাড়ি তো অনেক দূর।শহরতলীতে।হঠাৎ তার মনে হলো এমুহূর্তে সে মিতাকে কাছে না পাক কিন্তু একটা ফোন করে তো কথা বলতে পারে । যদিও বিদেশে থাকার সময় রুটিন করে সকালে রাতে প্রতিদিন মুশফিকের কথা হতো। আজ বিদেশ থেকে ফেরার সময় এয়ার পোর্টে বসে মিতাকে ফোন করে মুশফিক।দীর্ঘ সময় কথা হয় তাদের । এ-বাসায় এসেও দু বার কথা হয়। মুশফিক বলে- দেখো মিতা, তোমার তো মাস্টারর্স কমপ্লিট হয়েছে। পিএইচডি কারার ইচ্ছে ছিলো তোমার ।আমার শেষ হয়েছে, এবার তোমাকে পাঠাবো। তবে তার আগে আমাদের বিয়েটা শেষ করতে চাই । এবার আর কোনো আজুহাত শুনবো না। ফোনের ওপাশ থেকে হাসির মিহিসুর । রেশমি কাপড়েরর মতো। এ-সুর মুশেফিকের অনেক দিনের চেনা।
হ্ঠাৎ মুশিফিকের ফোন বেজে ওঠে । ফোনের ওপাশ থেকে যেনো বেজে উঠলো হারমোনিয়ামের সুর-হ্যালো। কেমন আছে মুশফিক? –হ্যাভালো, তুমি কেমন আছো? ভালো আছি। আমার কথা তোমার এখন খুব মনে পড়ছে, আর আমারও, তাই তোমোকে ফোন করলাম। মুশফিক অবাক হয়ে যায়। যখনই মিতার কথা ওর মনে হয় তখনই ওর ফোন বেজে ওঠে। মিতা ফোন করে ওকে। মুশফিক যে ৫ বছর বিদেশে ছিলো প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটেছে। প্রথম প্রথম টেলিপ্যাথি মনে করে মুশফিক বিষয়টি নিয়ে ভাবেনি। কিন্তু বছরের পর বছর যখন এ ঘটনা ঘটছে তখন একদিন সে মিতাকে জিজ্ঞেস করে – সত্যি করে বলোতো মিতা, তুমি কী করে টের পাও, যে তোমার কথা আমার মনে পড়ছো? মিতা হাসে। সেই চিরচেনা হাসি। তাকে না দেখে যে হাসি শুনেই তাকে ভালোবেসেছিলো।
সেদিনের ঘটনা এখনও চোখের সামনে ভাসছে মুশিফিকের ।থার্ডইয়ারের পরীক্ষা ।পরীক্ষা শুরু হতে আরও আধা ঘন্টা বাকি। ছেলেমেয়েরা সব জড়ো হয়েছে। হলের একপাশ থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠের হাসির আওয়াজ আসছে। মুশফিকের ওই হলে পরিদর্শকের দায়িত্ব ছিলো। সে হলের দিকে যাবার সময় হাসির শব্দ শুনেত পায়। এমন হাসি সে কোনো দিন শোনোনি। কৌতুহল বশত সে মেয়েটিকে দেখার জন্য হলের পাশে যায় । চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি বলে – ‘সরি স্যার’। -সরি কেন? কী বলবে ভেবে পায় না মিতা। ‘স্যার হলে যাই’। - ‘ওকে , যাও’ মিতা তার বান্ধবীকে নিয়ে হলের দিকে যায়। মুশফিক বলে- তোমার নাম কী? – স্যার, মিতা। সোনিয়া আক্তার মিতা। এপর থেকে তারা দুজন ধীরে ধীরে কাছাকাছি চলে আসে।মুশফিক বলে- আমি তোমাকে ভালো বাসি মিতা। মিতা কিছু বলে না একটু হাসে। - কিছু বললে না ? মুশফিক বলে। -বলিনি বুঝি? আমি বলিছি তো ? আপিনি শোনেননি’।আবারও হাসে।–কখন বলেলে? ‘যখন হাসলাম। মেয়েদের হাসিওযে তার বুকের ভাষা। তা পড়তে পারেন না স্যার? মুশফিক বোকা মনে যায়। প্রেমে পড়লে মানুষ নাকি বোকা হয়ে যায়, সে যত জ্ঞানী হোক না কোন। এ কথা এত দিন জানতো সে, আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
তুমি আমার মনের কথা কীভাবে টের পাও মিতা? মুশফিক বলে। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই’। আবার হেসে ওঠে মিতা । মুশফিকের মনে হয় সে হাসি যেন মোবাইল ফোন ছাড়িয়ে ছাতিম ফুলের গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাতাসে ঢেউ হয়ে ভাসছে সে হাসি।‘তুমি তো আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসো না। যদি তুমি আমাতে গভীরভাবে ভালোবাসতে তাহলে আমার মনের কথা বুঝতে পারতে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমার মনের কথা বুঝতে পারি। দূরে বা কাছে যেখানে থাকো না কেন। মুশফিক অবাক হয়ে বলে–তাই? আমি তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসি না? ‘না বাসো না। বাসলে তো বুঝতে পারতে’। মুশফিক মজা করে বলে – তুমি কী অশরীরী, যে আমার সব কিছু জানো’। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে সেই অপূর্ব হাসি। মিতা বলে-হ্যা, আমি তো অশরীরী, তুমি জানো না? আবার হেসে ওঠে। মুশফিকের ভেতর কেমন যেন কিউরিসিটি বেড়ে যায়। সে মিতাকে বলে- আচ্ছা বলো তো আমি এখন কোথায় আছি? ‘তুমি তোমাদের পুকুর ঘাটে। মুশফিক অবাক হয়ে যায়। মিতা বলে-তোমার পিছনে একটি ছাতিম গাছ আছে। আমি ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ টের পাচ্ছি। মুফিক বলে –সত্যি করে বলোতো তুমি কোথায়? মিতা বলে- তোমার কাছে ।‘মানে, কোথায় তুমি?-মুশফিক বলে। ‘বললাম না আমি তোমার কাছে আছি। তোমার পিছনে তাকিয়ে দ্যাখো।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।