শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
প্রেম, কাম, বিরহ-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয়। আর এ তিনটির সাথে নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীতে প্রেম, নারীতেই বিরহ। ভালোবাসার নৌকায় ওঠার সৌভাগ্য হয়তো সবারই হয়ে থাকে। কিন্তু নারীর ভালোবাসা মানেই ঝড়, এই ঝড়ে কার নৌকা কখন ডুবে যায় বলা যায় না। ঝড়ে পড়ে কেউ ঝরে যায়। কেউ সাঁতরায়। কেউ বা হারায়, কেউ তীর পায়। যুগে যুগে এমন সব নিদর্শন নিয়েই সাহিত্যে বিরহগাঁথা। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও ভালোবাসার এমন সব সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার চিত্র লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাস, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে বর্তমানে বিরহের কবি হেলাল হাফিজ প্রমুখ মনের গভীরে বিরহের প্রোথিত অনুভূতিকে ভাষা ও ছন্দে বিভিন্নভাবে নিয়ে এসেছেন।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রেম ও বিরহ নিয়ে লেখা অগণিত কবিতা, গল্প ও গান বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বলা হয়ে থাকে, নজরুলের হৃদয়ে যদি বিরহের সুর না বাজতো, তাহলে হয়তো তাঁর কালজয়ী কিছু গান-কবিতা থেকে বঞ্চিতই থাকতে হতো উপমহাদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের। তাঁর সময়ের মানুষ তাঁকে নারীবাদী বা নারীঘেঁষা কবি হিসেবে বলতো। কবি নিজেই তার কবিতায় তুলে ধরেছেন-‘নর ভাবে আমি বড় নারীঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!’ (কৈফিয়ত; সর্বহারা)। নারীবাদী, নারী বিদ্বেষী, কিংবা নারী বিরহী-যাই বলা হোক না কেন, নারীর বিরহেই নজরুল থেকে বিদ্রোহী নজরুল হয়েছিলেন। কেননা নারীর প্রেম ও বিরহই তাঁকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ দিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তাঁর প্রেমের প্রকাশ পাওয়া গেছে। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিচিত্র নারী-চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছেন, বারবার প্রেমে পড়েছেন। ভালোবেসে বারবার বিরহে কাতর হয়েছেন। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেও তিনি কাঙ্খিত মানুষকে অভিশাপ দেননি। বরং রচনা করেছেন কালজয়ী সাহিত্য। যেমন লিখেছেন-‘বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে/এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।’ নজরুল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নার্গিস, প্রমীলা ও ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়েছেন। এছাড়াও উমা মৈত্রের নামও শোনা যায়। কবি তাঁর ‘শিউলিমালা’ গল্পে ‘শিউলি’ রূপক নামে উমা মৈত্রের কথা তুলে ধরেছেন। ফজিলাতুন্নেসাকে ভালোবেসে না পেয়ে কবি লিখেছেন-‘বুকে তোমায় নাই বা পেলাম, রইবে আমার চোখের জলে। ওগো বধূ! তোমার আসন, গভীর ব্যথার হিয়ার তলে।’ ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘অভিশাপ’ কবিতায় লিখেছেন-‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে/অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে/বুঝবে সেদিন বুঝবে!’ ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে নজরুল কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছেন। বলা হয়ে থাকে, এগুলো নার্গিসকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। এসব কবিতায় বিরহের সুর পাঠক-হৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয়। ‘তোমারে পড়িছে মনে’ কবিতাই এর প্রমাণ। নার্গিসের একটি চিঠির উত্তরে নজরুল লিখেছিলেন-‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে, ভুলে যাও ভুলে যাও তারে একেবারে’। এরকম শত শত গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস রয়েছে নজরুলের, যা বাংলাসাহিত্যে বিরহের অমূল্য সৃষ্টি। এরপর আসি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহ-সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে প্রেম ও বিরহ অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি কামনা থেকে প্রেমকে মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর প্রেম দেহজ অনুভূতিতে পাওয়া দুষ্কর। বিশ্বকবি প্রেমে পড়েছিলেন কৈশোরেই। তাঁর জীবনের প্রথম প্রেমের শেষ পরিণতি আত্মহত্যা। কবির চেয়ে বয়সে বড় তাঁরই বৌদি কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের জীবনে এসেছিলেন সতের বছর বয়সে। পাঠশালা থেকে ফিরে কাদম্বরীকে দেখতে না পেলে কবি ক্ষিপ্ত হতেন। বলা হয়ে থাকে, ‘আকাশ প্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধু’ কবিতা কাদম্বরীর সাথে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিমূলক রচনা। রবীন্দ্রনাথ বিয়ের করার চার মাসের মাথায় কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছেন-‘নয়নের সন্মুখে তুমি নাই/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। প্রচলিত রয়েছে, কাদম্বরীর বিরহে কবিও আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে ‘কড়ি ও কোমল’ কবিতায় কবি লিখেছেন-‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।’ বিলেতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ দুই সহোদরা লুসি ও ফ্যানির প্রেমে পড়ছিলেন। দেশে ফেরার পর ফের যখন তিনি বিলেত যান তখন তাঁদের সাথে আর দেখা করার সুযোগ পাননি। হতাশা নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরেন। তাঁদের নিয়ে ‘বসন্ত বর্ষা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-‘যত অশ্রু বরিষেছি এই দুই দিন/যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন/এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি/হৃদয়ে স্থাপিবে, দিবে চির হাসি অশ্রু।’ বাঙালি কবিদের অধিকাংশই একাধিক প্রেম ও বিরহে কাতর হয়েছেন। হয়তো বা কবিদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার বিকাশের প্রধান মাধ্যম প্রেম ও বিরহ। জীবনানন্দ দাস ‘বনলতা সেন’ কবিতায় বিরহে যে উপমা তুলে ধরেছেন আজো তা বাংলাসাহিত্যে অতুলনীয় হয়ে আছে। তাঁর কবিতা প্রথম জনপ্রিয়তাই পায় ‘বনলতা সেন’ প্রকাশের পর। তার আগে প্রকাশিত জীবনানন্দের অন্যকোনো বই পাঠকদের এতটা আগ্রহের সৃষ্টি করেনি। শামসুর রাহমানের অনেক বিরহ-কাব্য অমরগাঁথা হয়ে আছে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে বিখ্যাত কিছু বিরহের কবিতা আছে। যেমন ‘কোথাও কেউ নেই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-‘আকাশে চঞ্চল মেঘের কারুকাজ, বর্ষা-সেতারের বাজালো ঝালা আজ।/একটি সুর শুধু শুনছি ঘুরে ফেরে-সে সুর বাজে যেন আঁধার চিরে চিরে।/বাইরে কিছু আর যায় না জানি দেখা, কোথাও কেউ নেই, ত্রিলোকে আমি একা।’ এ কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘তোমার-না আসাগুলো। অসমাপ্ত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।