পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি’র মুখপাত্রদের অসম্মান ও কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্যের জেরে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় দেখা দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে মুসলমান বিদ্বেষী আস্ফালন ও বিদ্বেষমূলক কর্মকান্ড কোনো নতুন বিষয় নয়। বিজেপি দিল্লীর ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে মুসলিম বিদ্বেষ একটি কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপ নিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় তারা সে দেশের মুসলমানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে মুছে দিয়ে ভারতে একটি একচ্ছত্র হিন্দুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটি ভারতের গণতান্ত্রিক সংবিধান ও মাল্টিকালচারালিজমের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং সম্প্রীতির ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে মুসলমানদের রাজনৈতিক টাগের্টে পরিণত করার নানামুখী পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বিশ্বের সামনে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র মুসলিম বিদ্বেষ ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার পূর্বাভাস হিসেবে বর্ণনা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচ। বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নেতাদের অনবরত হিংসাত্মক বক্তব্য এবং যখন তখন তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলমানদের উপর সংঘবদ্ধ হামলা, নিরপরাধ মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করার মতো অসংখ্য ঘটনা থেকে বিজেপি সরকারের মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডা স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তরফ থেকে এ সব বিষয়ে কদাচিৎ নিন্দা-প্রতিবাদ জানানো হলেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোকে ভারতের মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে খুব একটা দেখা যায়নি। এবার বিজেপি মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের ইসলাম বিদ্বেষী মন্তব্যে এক ব্যতিক্রমী আবহ তৈরি হয়েছে।
শত শত বছরের মুসলিম শাসনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ভারতের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। এখন মুসলমানরা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনশক্তি। ভারতের মুসলমানরা একীভূত রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে গড়ে তোলা এবং বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামেও অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছে। বৃটিশদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির নেপথ্য ক‚টচালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ও দাঙ্গার সূত্রপাত হলেও সাতচল্লিশের স্বাধীনতাত্তোর সংবিধান সব নাগরিকের সম অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। বিজেপি সরকার সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ স্পিরিটকে ধ্বংস করে সবার উপর হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দিতে প্রথমেই নতুন নাগরিকত্ব আইন করে কোটি কোটি মুসলমান ভারতীয়কে রাষ্ট্রহীন অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে। মুসলিম স্থাপত্য ধ্বংস করা, মসজিদে মন্দিরের অস্তিত্ব খোঁজা এবং মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান ও নামচিহ্নগুলোকে মুছে দেয়ার অপতৎপরতা ভারতের মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বিজেপির এই রাজনৈতিক এজেন্ডা ভারতকে ভেতর থেকে দুর্বল, অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুর করে তুললেও সেখানকার প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, উদার গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দল বা গণমাধ্যমকেও কখনো সোচ্চার ভ‚মিকায় দেখা যায়নি। এবার বিজেপি মুখপাত্রদের রাসুল সা.কে উদ্দেশ্য করে অবমাননাকর বক্তব্যের পর এতদিন নিরব ভ‚মিকা পালনকারী মধ্যপ্রাচ্যসহ অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্রে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে বিজেপি সরকার নতজানু হওয়ার পর ভারতের সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং মিডিয়া কিছুটা যেন নড়েচড়ে বসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের জনশক্তি রফতানি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হলে ভারতের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও কাতারের মতো ভারতের মিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার বিজেপির ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সেখানকার সাধারণ নাগরিকরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়ার পর ব্যবসায়ীরা ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতকে বয়কটের হ্যাশট্যাগ ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করছে।
মূলত ধর্মপ্রাণ মুসলমান নাগরিকদের তীব্র ক্ষোভ ও অব্যাহত চাপের মুখেই ওআইসিসহ মুসলমান দেশগুলো ভারতের বিজেপি সরকারের এহেন ন্যাক্কারজনক ভ‚মিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হওয়া সত্তেও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়েও ভারতের পক্ষ থেকে নাক গলানো ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা কারো অজানা নেই। ভারতে বিজেপির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ও মুসলিম বিদ্বেষী কর্মকান্ড যেমন এ দেশের সাধারণ মানুষকে সংক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত করে তোলে একইভাবে এসব ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের নিরবতাও জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে। গতকাল পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি মুখপাত্রদের পয়গম্বর সংক্রান্ত নিন্দনীয় মন্তব্যের জেরে মোদি সরকার পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং ইসলামি সংগঠন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর রোষানলে পড়লেও ব্যতিক্রম শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘রাসুলের অপমানে যদি কাঁদে না তোর মন, মুসলিম নও মুনাফিক তুই রাসুলের দুশমন’। এ দেশের কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সমাজে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ইসলামি দলগুলোও লাগাতার প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যাচ্ছে, অথচ, সরকার চুপ। সরকারের এই নিরবতায় মানুষের ক্ষোভ বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহদ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে অবশ্যই উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। ইতোমধ্যে কথিত আল কায়েদার তরফ থেকে ভারত ও বাংলাদেশে হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে। জনগণের সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে কোনো নেপথ্য শক্তি দেশকে যেন উগ্রবাদের হুমকির মুখে ঠেলে দিতে না পারে সেদিক বিবেচনা করেও সরকারকে জনগণের ভাবাবেগের মূল্য দিতে হবে। ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদের ইতিবাচক দিক অবশ্যই প্রণীধানযোগ্য। ভারতের জন্যও সেটা উপকারী হতে পারে, তার নেতাদের সচেতনতা জাগাতে পারে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে বুঝতে হবে মুসলমানদের কোণঠাসা করে কিংবা তাদের রাসুল সা.-এর প্রতি কটূক্তি করে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও মানবিক ভারত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।