পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘দোষে গুণে মানুষ’, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। মানুষকে সৃষ্টির সেরাও বলা হয়। অথচ, শারীরিক দিক থেকে পৃথিবীর অনেক প্রাণীর চেয়ে মানুষ দুর্বল। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মশার কামড়ে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। করোনা নামক একটি অদৃশ্য ভাইরাস গোটা মানবজাতিকে ধরাশয়ী করে ফেলেছে। আবার শারীরিকভাবে দুর্বল এই মানুষ পৃথিবীকে ছাড়িয়ে অন্যান্য গ্রহে নভোযান পাঠাচ্ছে। মানুষের বিবেকবুদ্ধি এতটা উন্নত মানের যে, তা পৃথিবী ছাড়িয়ে নভোমÐলেও কার্যকর হচ্ছে। অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে এটা নেই।
অন্যদিকে এই মানুষই হিংস্রতায় অন্য যে কোনো হিংস্র পশুকে হার মানায়। যে গুণাবলির জন্য ‘মানুষ’ থাকার কথা বা ‘মানুষ’ নামটি হয়েছে। তা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ায় পৃথিবীতে আজ মানুষে মানুষে এত সংঘাত। সম্মান ও ক্ষমতা পাওয়ার অতিরিক্ত বাসনা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরা, প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করা, হিংসা, অহঙ্কার প্রভৃতি মানুষের নিত্যদিনের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। যে মানুষটি অনর্গল ‘মিথ্যা’ কথা বলে সে মনে করে যে, সবাইকে ঠকিয়ে সে ফায়দা লুটছে। ধর্মে পরনিন্দা, পরচর্চা করার জন্য মানবজাতিকে নিষেধ করা হয়েছে। তদুপরি একজন আর একজনের সাথে দেখা হওয়া মাত্রই পরনিন্দা, পরচর্চা করেই বেশি আনন্দ উপভোগ করে। এ উপভোগের মানসিকতা উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেশি রয়েছে।
রাজ্য শাসন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় ঈমানদারির চেয়ে বেঈমানির ইতিহাস অনেক বেশি। বিশ্বস্ততার চেয়ে বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী অনেক অনেক বেশি। রাজ্য শাসন বা রাজনীতি ছাড়াও পারিবারিক জীবনেও বিশ্বস্ততার অভাব ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে, পুত্র পিতাকে খুন করছে, ভাই ভাইকে করছে খুন। রক্তের এই খেলা পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই দেখা গেছে। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের একজনের হাতে অপরজনের খুনের ঘটনার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতার জন্ম হয়, যা অদ্যাবদি সব জাতি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে; যা এখন অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণহীন, শত আইন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারছে না। কোনো কোনো খুন অকস্মাৎ হয়ে থাকে। অনেক পরিকল্পিত খুনের লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে, যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। পৃথিবীতে মানুষের প্রধান শত্রæ মানুষ। ক্ষুধার্ত না হলে বাঘ আক্রমণ করে না। ব্যথা না পেলে বিষাক্ত সাপ আক্রমণ করে না। আঘাত না পেলে কুকুর কামড়ায় না। কিন্তু মানুষ যখন শত্রæতা শুরু করে তখন হিংসা-বিদ্বেষের আগুনে অন্ধ হয়ে যায়, মৃত্যু ঘটে তার বিবেকের।
একজন মানুষ আর একজনকে শুধু খুন বা শারীরিকভাবে জখম করে না, বরং যখন সুযোগ পায় তখনই মানসিক, নৈতিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি যদি কোথাও আশ্রয় প্রার্থনা করে তাকে আশ্রয় দেয়ার আগে নিজ স্বার্থকে বেশি করে চিন্তা করে। নারীরা পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীদের দ্বারাই বেশি নির্যাতিত। শাশুড়ির নির্যাতনে গ্রামবাংলার অনেক পুত্রবধূ আত্মহত্যা করেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন করেও এর নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে এখনো আছে, যার সংখ্যা এতই কম যে, গোনার মধ্যে পড়ে না।
অথচ শহর-বন্দর, গ্রামাঞ্চলে মসজিদে নামাজির অভাব দেখা যায় না। সয়াবিন তেল যথেষ্ট থাকলেও কালোবাজারি-মজুদদাররা বেশি লাভ করার উদ্দেশ্যে গোপনে গোডাউনে মজুদ করে রেখেছে। মজুদদারের গোডাউন থেকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন সবাই মিডিয়ার কল্যাণে দেখেছে, এরাও মানুষ। অনেক স্বনামধন্য ব্যবসায়ীর গোপন গোডাউন থেকে সয়াবিন উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন, হজেও গেছেন একাধিকবার এবং নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
যারা বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি দায়িত্বে রয়েছেন বা ক্ষমতায় আছেন যাদের দায়িত্ব ভুক্তভোগীর প্রার্থনা নিষ্ঠা ও ইনসাফের সাথে বিবেচনা করা। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্বল মানুষগুলো ইনসাফ ও ন্যায্য বিচার পায়। সাধারণত প্রাপ্তির পরিবর্তে তারা বঞ্চিত হয়ে আসছে। একজন সরকারি কর্মচারী অবসর গ্রহণ করার পর সাধারণত তারই সহকর্মীকে ঘুষ দেয়া ছাড়া পেনশনের টাকা তুলে নিতে পারেন না। চাকরি অবস্থায় যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তবে তার বিধবা স্ত্রী ও সন্তানরা একই অফিসে থেকে প্রাপ্য টাকা তুলতে টের পেয়ে যান যে, কত ধানে কত চাল। এ প্রতিবন্ধকতা তারাই সৃষ্টি করেন, যারা মরহুমের সাথে দীর্ঘদিন পাশাপাশি টেবিলে কাজ করেছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৭ মোতাবেক ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তারপরও ভিআইপি ও ভিভিআইপি নামে বাংলাদেশে দুটি শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছে, যাদের জন্য বাংলাদেশ একটি স্বর্গরাজ্য। যারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রশ্নে অনুরূপ ‘ভিভিআইপি’ পদবি থাকলে আপত্তি নেই। তবে পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুরূপ সুযোগ ভোগের এখতিয়ার নেই। রাস্তায় যানজট ঘটলে রাষ্ট্রীয় প্রটেকশন ও প্রটোকল ছেড়ে বাসে চড়তেও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গেছে। এ বিষয়টি বাস্তবতার কোনো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই না, তবে শিক্ষার প্রশ্নে এটা একটি উদাহরণ হতে পারে। ভিআইপি স্বয়ং বা তার রেফারেন্স ব্যতীত সরকারি দফতরে কোনো কাজ আগায় না। আমলাদের থেকে ইনসাফ পাওয়া তো দূরের কথা রেফারেন্স ছাড়া দেখা করাও দুষ্কর। স্বউদ্যোগে মানুষ মানুষকে মর্যাদার সাথে দেখা সমাজ থেকে যেন উঠে গেছে।
সাধারণ মানুষ যেন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, অবিচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলেই যেন কোমর ভেঙে পড়ে। প্রভাবশালী ও সবলদের কাছে মাথানত করাটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘জি হুজুর, জাঁহাপনা’ সংস্কৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জেগে ওঠার অনেক ইতিহাস থাকলেও এখন যেন প্রতিবাদ করা অত্যন্ত ভয়ের কাজ বলে জনমনে প্রবেশ করেছে। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, মনীষী, রাজনীতিবিদ, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে গণজাগরণের চেষ্টা করে অনেক ক্ষেত্রেই সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো মানুষ সমষ্টিগতের চেয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে নিরাপদে বাঁচতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, পার্শ্ববর্তী বাড়িতে যখন আগুন লাগে তখন প্রতিবেশীর মনে এ মর্মে বোধোদয় হয় না যে, আগুনের লেলিহান অগ্নিশিখা তার বাড়িও গ্রাস করতে পারে। এমনিভাবে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ দূরে সরে গেছে। ঢাকা মহানগরীতে এমনও দেখা গেছে যে, একটি হাই রাইজিং অ্যাপার্টমেন্টের ১৫ তলায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে কান্নাকাটি হচ্ছে, একই অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তালায় জন্মদিন উপলক্ষে জমকালো অনুষ্ঠান চলছে। এ সংস্কৃতি ইতোপূর্বে বাঙালি সমাজে ছিল না।
আপনার সময় যখন ভালো তখন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব, সঙ্গী-সাথীর কোনো অভাব হয় না। যখনই কোনো কারণে আপনার দুঃসময় আসে বা পা পিছলে আপনি পড়ে যান তখন আপনার সাথে আঠার মতো লেগে থাকা সঙ্গী-সাথীরাও আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং সম্ভব হলে আপনাকে ডোবানোর জন্য যতটুকু সম্ভব ততটুকু ভ‚মিকা রাখবে এবং প্রতিপক্ষের সাথে হাত মেলাবে। এ চরিত্র বন্যপ্রাণীদের মধ্যেও দেখা যায় না, যা মানুষ অভ্যাসগতভাবে করে থাকে। আত্মমর্যাদাই একজন মানুষকে সঠিকভাবে পথ চলার সহায়ক হয়, যার আত্মমর্যাদা বোধ আছে, তার আঘাত থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নিরাপদ থাকে। নিজের অতিরিক্ত সম্মান, সম্পদ ও ক্ষমতা পাওয়ার লোভে ওই ব্যক্তি নিজেকে বিকিয়ে দেয়। এতে এমন এমন ঘটনার জন্ম হয় যা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এ জন্য পরশ্রীকাতরতা দায়ী। পরশ্রীকাতর মানুষের সংখ্যা এখন অনেক। সমাজ রাজনীতি ও ক্ষমতার অঙ্গনকে ‘তেলবাজরা’ কলুষিত করে ফেলেছে। যাদের হাতে ‘তেলের বাটি’ রয়েছে তারাই সমাজে সোনার হরিণ ধরতে পেরেছে। কিন্তু সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পরিবেশ যতই প্রতিক‚ল থাকুক না কেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষই মানুষের মধ্যে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।