দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পৃথিবীতে অনেক মানুষ রয়েছে। তাদের কেউ ভালো। কেউ মন্দ। কিন্তু একজন মানুষও এমন নেই যে নিজেকে মন্দ মনে করে। প্রতিটি মানুষই নিজেকে ভালো মনে করে। উত্তম ও শ্রেষ্ঠ মনে করে। তবে কেউ নিজেকে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও ভালো বলে মনে করলেই সে উত্তম, ভালো কিংবা শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। আবার বহু লোক মিলে কোন ব্যক্তিকে মন্দ বলতে থাকলেও সেই ব্যক্তি মন্দ বলে গণ্য হয় না; যদি না কুরআন হাদিসের মানদণ্ডে সে মন্দ বলে প্রমাণিত হয়। কুরআন-হাদিসে ভালো ও মন্দ লোকের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই মানদণ্ডের নিরিখে নির্ণয় করা যায় কে ভালো কে মন্দ। আজকের নিবন্ধে আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে ভালো মানুষের পরিচয় লাভের কতিপয় মানদণ্ড তুলে ধরছি।
ঈমান আনয়ন ও সৎকর্ম সম্পাদন আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সব সময় লালন পালন করে চলেছেন। বাঁচিয়ে রাখছেন। রিজিক প্রদান করছেন। প্রভূত নেয়ামতে ডুবিয়ে রাখছেন। সৃষ্টি করা, অস্তিত্ব দান করা, বাঁচিয়ে রাখা, লালন-পালন করা ও অগণিত নেয়ামতে ডুবিয়ে রাখার দাবি হলো মানুষ তার প্রতিপালক ও স্রষ্টাকে চিনবে। মহামহিম আল্লাহর পরিচয় লাভ করবে। তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে। তার নির্দেশিত সৎকর্মসমূহ পালন করবে। সুতরাং পরম দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহ যেহেতু মানুষকে সৃষ্টি করে লালন পালন করে যাচ্ছেন তাই তাদের জন্য কর্তব্য হলো মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করা ও সৎকর্ম সম্পাদন করে যাওয়া। যেসব লোক অনুগ্রহকারী ও অনুকম্পাকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না বা তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলে না তাদেরকে ভালো মানুষ বলা যায় না। অনুরূপভাবে যেসব লোক আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনয়ন করে না এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে না তাদেরকেও ভালো মানুষ বলা যায় না। আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ তারাই যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা বাইয়্যিনা, আয়াত : ০৭)
কুরআন শেখা ও শেখানো: পৃথিবীতে প্রচুর জ্ঞানভাণ্ডার রয়েছে। রয়েছে বিপুল গ্রন্থসম্ভার। এসব গ্রন্থের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন । পৃথিবীর সকল গ্রন্থের উপর এর অধিষ্ঠান। কুরআন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন গ্রন্থ এমন নেই যা দাবি করতে পারে, আমার মধ্যে কোনো ভুল নেই। আমার সত্যতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ ও সংশয় নেই। কুরআন পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ জানা যায়। মহান আল্লাহ যা করার আদেশ করেছেন তা জেনে আমল করা যায় এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা হতে নিবৃত্ত থাকা যায়। ইহ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের পথ সুগম হয়। তাই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আলকুরআন যারা শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয় তারা ভালো মানুষ। এসব মানুষকে হাদিস শরিফে ভালো বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘হজরত উসমান রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে ভালো যে কুরআন শেখে ও অপরকে শেখায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০২৭)
চরিত্রবান হওয়া: চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান। যার স্বভাব-চরিত্র ভালো সে প্রকৃত অর্থেই ভালো মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের অভাব নাই। কিন্তু চরিত্রবান মানুষ কয়জন পাওয়া যায়? চরিত্রবান মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় পৃথিবীতে বিভিন্ন বিপর্যয়, বিশৃংখলা, অশান্তি, অরাজকতা, দুঃখ ও কষ্ট দেখা দিচ্ছে! নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ বিবর্জিত চরিত্রহীন মানুষগুলোর দ্বারাই সুদ, ঘোষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, মানবপাচার, ছিনতাই, মাদক, সন্ত্রাস, রাহাজানি, নির্যাতন, নিপীড়ন, ইভটিজিং, খুন, গুম ও ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে! তাই ভালো মানুষ তারাই যারা স্বভাব চরিত্র ও আচার-আচরণে ভালো। ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে ভালো যে স্বভাব-চরিত্রে সবচেয়ে ভালো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৫৯)
সুন্দরভাবে ঋণ পরিশোধ: মানুষ সামাজিক জীব। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদেরকে একে অপরের দ্বারস্থ হতে হয়। ঋণ করতে হয়। কিন্তু ঋণ করার পর অনেক মানুষ ভুলে যায়, এই ঋণ শোধ করতে হবে। এসব লোক ঋণ পরিশোধ করার সময় এলে পাওনাদারদের এড়িয়ে চলে। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করে না। টাকা-পয়সা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করতে গড়ি-মসি করে। শোধ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করে। পাওনাদারদের পেরেশান করে। তাগাদা দিতে এলে এ কথা সে কথা বলে ফিরিয়ে দেয়। দিনের পর দিন ঘুরাতে তাকে। এমন স্বভাবের লোকদেরকে কোনক্রমেই ভালো মানুষ বলা যায় না। ঋণ করার পর পাওনাদারকে যথাসময়ে তা পরিশোধ করা ভালো মানুষের পরিচায়ক। ‘হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পাওনার জন্য তাগাদা দিতে এসে রূঢ় ভাষায় কথা বলতে লাগল। এতে সাহাবিগণ তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা পাওনাদারদের কড়া কথা বলার অধিকার রয়েছে। তারপর তিনি বললেন, তার উটের সমবয়সী একটি উট তাকে দিয়ে দাও। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটা নেই। এর চেয়ে উত্তম উট রয়েছে। তিনি বললেন, তাই দিয়ে দাও। তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে ভালো যে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ভালো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩০৬) (চলবে)
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।