বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
পুলিশ সদস্য কর্তৃক কপালে টিপ পরা কলেজের শিক্ষিকাকে কটূক্তি করার ঘটনায় উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে সবাই।
শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় কপালে টিপ পরে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই শিক্ষক।
ইতোমধ্যেই জিডির সেই কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর প্রতিবাদে কপালে টিপ পরা ছবি পোস্ট করছেন অসংখ্য নারী। শুধু নারীরা নন, পুরুষরাও কপালে টিপ পরে ছবি তুলছেন। আর তা ফেসবুকে পোস্ট করছেন। জানাচ্ছেন প্রতিবাদ।
শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায়ই নয়, এ ঘটনায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা।
এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ ‘টিপ নিয়ে টিপাটিপি’ শিরোনামে এই পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘নন ইস্যুকে ইস্যু বানানোর বেলায় বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। পহেলা রমজানের ইফতারি বানানোর জন্য চুলায় গ্যাস নেই, কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ নেই, পানিও নেই। তবুও বাড়ল গ্যাসের দাম। বাজার লাগামহীন। কিন্তু নেটাগরিক বাঙালির জীবনে হঠাৎ ইস্যু হয়ে এলো 'কপালের টিপ'। উৎস বা ইতিহাস না জানলেও বাঙালি নারী কপালে টিপ পরতে ভালোবাসে। শিশুকাল থেকে চারপাশে এভাবেই দেখে এসেছি। হিন্দু নারীরা সিঁদুরের টিপ পরেন। আর মুসলিম নারীরা পূর্বে লিপিস্টিক দিয়ে টিপ এঁকে পড়তো, এখন বাজার থেকে কেনা টিপ পরে। শুধু বাঙালি নারীরা নয়, বাঙালি মায়েরাও শিশুদেরকে নানা ধরনের 'কুদৃষ্টি' থেকে রক্ষা করতে কপালে কাজলের টিপ এঁকে দেন। আর ছড়া কাটেন- 'আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা / চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।' শিশুকালে আমার মা ও আমার কপালে কাজলের এঁকে দিতেন। এটা এক ধরনের সংস্কার। তবে আলেমগণ বলেন, মুসলিম নারীর কপালে টিপ পরা হারাম। এটা বিজাতীয় সংস্কৃতি। তাদের মতে, ইসলামে নাকি এর একটি ইতিহাস আছে। সেটা হলো- হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন নমরুদ চড়কে তুলে আগুনে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করেন, তখন আল্লাহর নির্দেশে রহমতের ফেরেশতাগণ এসে চড়ক এর উপরে চড়ে বসেন। ফলে নমরুদের অনুসারীরা অনেক চেষ্টা করেও চড়ক ঘোরাতে পারছিল না। এ সময় ইবলিস এই খবর নমরুদকে জানিয়ে দেয় এবং তাকে পরামর্শ দেয় কিছু নারীকে নগ্ন করে চড়কের কাছে এনে জড়ো করতে। শয়তানের নির্দেশে নমরুদ রাজ্যের বারবনিতাদের নিয়ে এসে চড়কের কাছে নগ্ন করে জড়ো করে। এরকম পরিস্থিতিতে রহমতের ফেরেশতাগণ ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে নমরুদের পক্ষে ইব্রাহিম আলাইহি সালামকে আগুনে নিক্ষেপ করা সহজ হয়। এই ঘটনার পর নমরুদ উল্লিখিত নারীদের রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানের জন্য তাদের চিহ্নিত করতে কপালে টিপ পরিয়ে দেন। তবে বাঙালি নারীর টিপ পরার সাথে এই ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা আমার জানা নেই। আলেমগণের এই ফতোয়ার পরেও বাঙালি নারীরা অনেকেই কপালে টিপ পরেন, আবার অনেকে পরেন না। আধুনিক, শহুরে এবং কর্পোরেট নারীদের বিশেষ কিছু উৎসব ছাড়া কপালের টিপ পরতে দেখা যায় না বললেই চলে। এ নিয়ে কোথাও কোনো জোরাজুরি দেখিনি। হঠাৎ করে কোথা থেকে কোন এক ' লম্বা দাঁড়িওয়ালা' পুলিশ সদস্য লতা সমাদ্দার নামে এক শিক্ষিকাকে কপালে টিপ পরায় কটুক্তি বা ইভটিজিং করেন। এরপর এক শ্রেণীর নাগরিক সোশ্যাল মিডিয়ায়, রাজপথে ও সংসদে এই ইস্যু নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছেন। যেসব মিডিয়া এ ধরনের ইস্যুর জন্য পিপাসার্ত থাকে, তারা শ্রাবণের বানের মতো দু'কূল ভাসিয়ে দিচ্ছে মিডিয়া জগত। বাজারের লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, রমজানে গ্যাসের অভাবে ইফতার বানাতে না পেরে রেস্টুরেন্টের সামনে লাইন প্রভৃতি নানা জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছাপিয়ে 'কপালে টিপ পরা' এখন জাতির সবচেয়ে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। বাঙালি নারী কপালে যে টিপ পরে তা মূলত ভারতীয় সংস্কৃতি। টিপ শব্দটির হিন্দি প্রতিশব্দ বিন্দি। বিন্দি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত বিন্দু শব্দ থেকে। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, ভারতীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তিলক বা বিন্দি। সনাতনী ষোলা শৃঙ্গারের অন্যতম অঙ্গ বিন্দি, যা হিন্দু সংস্কৃতিতে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। মানুষের শরীরে যেখানে তৃতীয় চক্ষু থাকে বলে হিন্দুধর্ম বিশ্বাস, কপালের ঠিক সেই পয়েন্টে টিপ পরার প্রথা প্রচলিত। তিলক বা বিন্দির ফলে তৃতীয় চক্ষু উন্মোচিত হয় এবং শুভ শক্তির বিকাশ ঘটে বলে বিশ্বাস। পৌরাণিক মতে দেবী কালিকা বা পার্বতী বা দুর্গার ললাটে চক্ষু রয়েছে। তাই তাকে ত্রিলোচনা বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ, দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ। ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে! তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥ দুই ভুরুর মাঝখানে এই টিপ আগেকার দিনে হলুদ গুড়ো, চন্দন, সিঁদুর বা ভষ্ম দিয়ে পরা হত। এর ফলে তৃতীয় চক্ষু জাগরিত হয়ে সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত হয় বলে বিশ্বাস। কসমিক এনার্জিকে জাগাতে এই তৃতীয় চক্ষুস্থল সবসময় খোলা ও সবরকম বাধা থেকে দূরে রাখা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে অনেক পুরুষ সেলিব্রেটিকে কপালের টিপ পরে ছবি দিতে। এদেরকে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল কুমারকে কান ধরানোর প্রতিবাদে জাতীয় কান ধরার মিছিলে শরিক হতে দেখেছি। কিন্তু অন্য অনেক শিক্ষককে বিভিন্ন সময় এর চেয়েও বেশি লাঞ্ছিত করা হলেও তাদের কাউকে 'রা' শব্দ করতে দেখিনি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের হিজাব পরার কারনে যখন ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়, তখন এদের কোনো প্রতিবাদ করতে দেখিনি। ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাংবিধানিক অধিকার, নারী অধিকার, পোশাকের স্বাধীনতা ও লাঞ্ছনা নিয়ে সোচ্চার হতে শুনিনি। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের পোশাক পরার স্বাধীনতা দিয়েছে। কাজেই কে টিপ পরবেন, কে হিজাব পরবেন, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে অন্যের মাথা ঘামানোর কোন আইনি অধিকার নেই।’
কপালে টিপ পরা ছবি দিয়ে অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি লিখেছেন, ‘লতা সমাদ্দার একা নয়। এ অসম্মানের দায়ভার অবশ্যই নিতে হবে। আমরা অপেক্ষা করছি সেটা দেখার। আমরা পলকহীন ভাবে অপেক্ষা করছি ! আমার টিপ,আমার বোধ,আমার সৌন্দর্য্য,আমার নিজের দিকে ফিরে তাকাবার একটা অবসর,আমার অস্তিত্ব স্বারক……..’
ইসলামিক বক্তা আহমাদুল্লাহ লিখেছেন, ‘কপালে টিপ দেওয়া নারীকে রাস্তায় কেউ হেনস্থা করলে সেটা নিন্দাযোগ্য কাজ। কোনো নারীকে হিজাবের কারণে হেনস্থা করা হলে সেটাও নিন্দনীয় ও অন্যায় কাজ।’
কেউ কেউ লিখছেন, ‘কপালে টিপ পরা কলেজের শিক্ষিকাকে হেনন্থা করা নিয়ে যেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে, সমাজের অন্যান্য অসংগতি নিয়ে যদি এভাবে প্রতিবাদ জানানো হতো; তাহলো হয়তো দেশে আর কোন সমস্যাই থাকতো না।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।