Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরাতে হবে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০২২, ১২:০২ এএম

কেমিক্যাল
গত এক যুগে কয়েকশ’ মানুষ জীবন্ত আগুণে পুড়ে আঙ্গার হলেও পুরান ঢাকা থেকে পকমিক্যাল গোডাউন আর বিপজ্জনক পলিথিন কারখানা সরানো হয়নি। একের পর এক আগুন লাগলেও সংশ্লিষ্টদের বোধোদয় হচ্ছে না। কেমিক্যাল গোডাউন আর বিপজ্জনক পলিথিন কারখানা পুরাতন ঢাকাতে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। বোধ করি, বিশে^র কোথাও এমনটা নেই। ফলে বারবার ঘটছে আগুনের ঘটনা। গত ১২ ফেব্রæয়ারী রাতে ঘনবসতিপ‚র্ণ ও সরু গলিপথের পুরান ঢাকায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগে। এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কত কাল চলবে? ২০১০ সালে নিমতলী এর পর চকবাজার, চুড়িহাট্টাসহ আরও অনেক জায়গায় আগুন লেগে জানমালের ক্ষতি হলেও পুরোনো ঢাকা থেকে প্লাস্টি কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন সরেনি। কোন ঘটনা ঘটলে তখন কারখানা এবং কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর নির্দেশ আসে। কিন্তু গত এক যুগেও তা বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাস্তবায়ন করলে বারবার আঙ্গার হওয়া লাশ আমাদের দেখতে হতো না।

আমরা দেখেছি, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়াচড়া শুরু হয় সংশ্লিষ্টদের। সব অব্যবস্থাপনা দ‚র করার আশ্বাস দেয়া হয়, কিন্তু কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। ফলে আগুন ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার মধ্যেই মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরান ঢাকার মানুষ। তারা আশ্বাস নয়, উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা চায়। নিমতলির মর্মান্তিক ঘটনার পর কেমিক্যাল গোডাউন সরনোর দাবি ওঠে। সরকারও নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন এ নিয়ে কথাবার্তা চলে। তারপর আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। গোডাউন সরানোর পরিবর্তে বরং দিনদিন তার সংখ্যা বেড়েছে। নতুন করে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।

ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কথা কেরানীগঞ্জে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে কিন্তু অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৮ সালে। পুরান ঢাকায় ছড়িয়ে আছে, প্রায় ৪ হাজার কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানা। এর মধ্যে পলিথিন কারখানাগুলো সবচেয়ে বিপজ্জনক। নিমতলী থেকে চকবাজোরের চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডি পর্যন্ত কয়েক বছরে মন্ত্রী, মেয়র, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় গুদাম সরানোর ঘোষণা, আশ্বাস ও নির্দেশ দেন। কোনো নির্দেশ আলোর মুখ দেখেনি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে থাকা শতাধিক পলিথিন কারখানা, ৪ হাজার কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। নিমতলীর ঘটনার পর তৎকালনি বাণিজ্য মন্ত্রী ক্যামিকাল গোডাউনগুলো শহর থেকে সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। নীমতলির ঘটনার সময় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং এসব স্থানান্তরের কথা বললেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

বাস্তবতা হচ্ছে, প্রশাসন কঠোর নয় বলেই বারবার আগুন লাগার মতো মর্মান্তি ঘটনা ঘটছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে সোশ্যাল করপোরেট রেসপনসিবিলিটি যেভাবে গড়ে ওঠার কথা, তা সেভাবে হয়নি। যারা স্টেক হোল্ডার, তারাও সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি। ভবন মালিকদেরও দায় আছে। তারা বেশি ভাড়া পাওয়ার জন্য গোডাউন (রাসায়নিকের জন্য) ভাড়া দেয় এবং ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখে। রাসায়নিকের মজুতের সনদ দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনের আরও কঠোর হওয়া উচিত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে? নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ে সরকার চাপের মুখে পড়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে, তখন পুরনো ঢাকায় ৮০০-এর বেশি অবৈধ রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশির ভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে তারা মনে করেন। তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী এবং এই এলাকার ভোটব্যাংক হিসাবে নানাদিকে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে রসায়নিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদফতর তারাও সেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা এসব ব্যবসার লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করে না।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পর এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ, স্থপতিসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পুরান ঢাকাকে আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের উদ্যোগ নেয় রাজউক। প্রাথমিকভাবে বকশীবাজার, চাঁদনীঘাট, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরাতন জেলখানা এলাকা, ইসলামবাগ, রহমতগঞ্জ ও বাবুবাজার এলাকায় তা বাস্তবায়নের চিন্তা করে। মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালানোর পর ২০১৬ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বংশালের দুটি এলাকাকে রিডেভেলপমেন্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। শুরু হয় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময়। রাজউক এলাকাবাসীকে রিডেভেলপমেন্টের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করে। অনেকে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করেন। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের মতামত প্রত্যাশা করে রাজউক। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর রাজউক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। মেয়রও এ উদ্যোগের ভ‚য়সী প্রশংসা করেন। তবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে সভা করে এলাকাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরে আরমানিটোলায় পুরান ঢাকার বাসিন্দা, স্থানীয় পাঁচটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজউকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সভা হয়। সভায় কিছু বাসিন্দা রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বিষয়ে রাজউকের ওপর আস্থাহীনতার কথা ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকতে চান। এলাকাবাসীর বেশিরভাগ মতামত রাজউকের বিরুদ্ধে গেলে স্থগিত হয়ে যায় রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কার্যক্রম। এ জন্য দায়টা কিন্তু স্থানীয়দেরও আছে। স্থানীয়দের মধ্যে অর্থ আর সম্পদের লোভ কাজ করে। তাদের বোঝানো না গেলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। শহরকে নিরাপদ করতে হলে যা যা দরকার তাই করা উচিৎ। বরাবরই দেখা গেছে, পুরনো ঢাকায় অগ্নিকাÐের পর অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা থাকে না। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট করলে রাস্তা প্রশস্ত হতো, আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যেত। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কারণে এটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। অথচ রিডেভেলপমেন্ট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কেমিক্যাল

২১ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন