পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত মঙ্গলবার আমি এই কলামে বলেছি যে, ওপরে ওপরে আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে যত মাখামাখিই দেখা যাক না কেন, রাশিয়া এবং ভারত হলো রসুন। দুই রসুনের গোড়া এক। তাই দেখা গেল, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল সেখানে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। অর্থাৎ ভারত পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে সমর্থন করলো এবং আমেরিকার বিরোধিতা করলো। এটাই ভারতের আসল চরিত্র। আমরা এখন আজকের আলোচনায় চলে যাচ্ছি।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষের মনে যে বিষয়টি জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে ঘোরাফেরা করছে সেটি হলো, কোথায় গিয়ে থামবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন? তিনি কি ২ লক্ষ ২৫ হাজার বর্গমাইলের সমগ্র ইউক্রেনকে দখল করবেন? নাকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে সরিয়ে একজন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট গদিতে বসিয়ে ক্ষান্ত দেবেন? তিনি ইতোমধ্যেই ইউক্রেনকে তিন টুকরা করেছেন। দোনেৎস্কো ও লুহানস্ককে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি দেশটিকে দুই টুকরা করেন। তার ২৪ ঘণ্টা পরেই পুতিন ইউক্রেনের অবশিষ্টাংশের ওপর সাঁড়াশী আক্রমণ চালান। তিনি ২০১৪ সালে সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রিমিয়া দখল করেন। এভাবে ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে বিচ্ছিন্ন করে এবার মূল ভূখন্ড ইউক্রেনের স্থল, জল ও অন্তরীক্ষে একযোগে সাঁড়াশী হামলা চালিয়েছেন। রাশিয়ার সামরিক শক্তির কাছে ইউক্রেন অতি নগন্য একটি দেশ। রাজধানী কিয়েভের চার পাশে ইতোমধ্যেই রুশ সৈন্য পৌঁছে গেছে। কিয়েভের পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। রবিবার এই লেখা লিখছি। মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে। এই ৪৮ ঘণ্টায় আরো অনেক ডেভেলপমেন্ট হবে। তবে আমার ধারণা, পূর্ণ সামরিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনকে পূর্ণ দখলে নেবে না। কারণ, তাহলে তাকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হবে।
একথা বলার প্রয়োজন নাই যে, কোনোরূপ যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই রাশিয়া তার সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র এবং হীনবল ইউক্রেনের ওপর। ইউক্রেনের একমাত্র অপরাধ: কেন সে ন্যাটোতে যোগ দিতে চেয়েছিল? কেন সে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মাখামাখি করতে চেয়েছিল? এই অজুহাত তুলে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর এমন হামলা চালিয়েছে যে হামলা ইউরোপের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, অর্থাৎ বিগত ৭৫ বছরেও দেখা যায়নি।
ইউক্রেনের পরাজয় রাশিয়ার বিজয় বলে চিহ্নিত হবে না। এই সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যকে পুতিন উবসরষরঃধৎরুধঃরড়হ এবং উবহধুরভরপধঃরড়হ রূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি তার সম্পূর্ণ উল্টা। সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট ডিক্টেটর জোসেফ স্ট্যালিন যে নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, সেটি ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিল। অনেকেরই প্রশ্ন: পুতিন কি জোসেফ স্ট্যালিনের পথেই হাঁটছেন?
॥দুই॥
প্রেসিডেন্ট পুতিন কি তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে ১৯৯১ পূর্ব বৃহত্তর সোভিয়েট ইউনিয়ন কায়েমের স্বপ্ন লালন করছেন? ইউক্রেন আক্রমণ কি তারই ড্রেস রিহার্সেল? কারণ, কিছুদিন আগে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন: সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলো উপযুক্ত সময়ের আগেই স্বাধীন হয়েছে। বিষয়টি বুঝতে হলে, আসুন, একটু পেছনে ফিরে যাই।
১৯১৭ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর রুশ ও ট্রান্সককেশিয়ান সোস্যালিস্ট রিপাবলিক, ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েট সোস্যালিস্ট রিপাবলিক এবং বেলারুশ সোভিয়েট সোস্যালিস্ট রিপাবলিক মিলে ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় সোভিয়েট ইউনিয়ন। ১৫ টি প্রদেশ মিলে গঠিত ইউনিয়ন অব সোভিয়েট সোস্যালিস্ট রিপাবলিক (টঝঝজ)। আয়তন হয় ৮৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৫০০ বর্গমাইল। বিভিন্ন কারণে ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ে এবং তার জঠর থেকে জন্ম নেয় ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র। এরমধ্যে বৃহত্তম হলো রুশ ফেডারেশন (রাশিয়া)। আয়তন ৬৬ লক্ষ ১ হাজার ৬৭০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৫৪ লক্ষ ৭৮ হাজার ৯৭। দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র হলো ইউক্রেন। আয়তন ২ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬২ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৪ কোটি ১১ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৩ জন। উল্লেখ্য সমগ্র সোভিয়েট ইউনিয়নের জনসংখ্যা ২৮ কোটি ৬৭ লক্ষ ৩০ হাজার ৮১৯।
এই পটভূমিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলা বিবেচনা করতে হবে। এটি সাম্রাজ্য বিস্তারের মানসিকতা প্রকাশ। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন যে, সর্বশেষ সোভিয়েট নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ছিলেন একজন দুর্বল রাষ্ট্রনায়ক। তার নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফলে বিশাল সোভিয়েট সাম্রাজ্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। তাঁর মনে হয়তো রয়েছে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের ইচ্ছা।
সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে ১৫টি রাষ্ট্র স্বাধীন হয়, তারমধ্যে ইউক্রেনও ছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি ট্রান্সকন্টিনেন্টাল, অর্থাৎ আন্তঃমহাদেশীয় দেশ। এত বিশাল একটি দেশ, যে ছিল আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরাশক্তির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, সেই দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নের ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হওয়াকে মেনে নিতে পারছিলেন না পুতিন। তখন তিনি ছিলেন সোভিয়েট গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন অফিসার। সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে ক্ষমতা সংহত করার পর তিনি ভাঙ্গা সোভিয়েট ইউনিয়নকে জোড়া দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকতে পারেন।
রাশিয়ার সীমান্ত এশিয়া এবং ইউরোপÑ দুই মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। কিন্তু ইউক্রেন সম্পূর্ণভাবে একটি ইউরোপীয় দেশ। এর উত্তরে বেলারুশ, পশ্চিমে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী এবং স্লোভাকিয়া, দক্ষিণে রোমানিয়া এবং মলডোভা। এছাড়া এটি অ্যাজভ সাগর এবং কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এটি ইউরোপে অষ্টম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমন ভৌগোলিক অবস্থান সম্পন্ন একটি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? ইউরোপীয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ যদি ৩০ জাতি ন্যাটোরও সদস্য হতে চায় তাহলেই বা দোষ কোথায়?
আসলে এই স্বাধীন ইচ্ছাই হয়েছে ইউক্রেনের কাল। একবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ন্যাটোর সদস্য হতে পারলে তাকে আর কেউ স্পর্শ করতে পারতো না। সেই সুযোগটাই নিলেন পুতিন। ইইউ এবং ন্যাটোতে জয়েন করার আগেই তিনি হিট করেছেন ইউক্রেনকে।
॥তিন॥
ইউক্রেনের লড়াই আত্মরক্ষার লড়াই। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। ৩০টি দেশের যৌথ বাহিনী ন্যাটো। আর লিবিয়ার অবস্থান সুদূর আফ্রিকায়। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার গাদ্দাফি ন্যাটোর কোনো পাকা ধানে মই দিয়েছিলেন যে সামরিকভাবে হীনবল লিবিয়ার মতো একটি দেশের ওপর সাঁড়াশী হামলা চালিয়ে দেশটিকে তছনছ করে দিতে হলো? গাদ্দাফি কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা কোন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ঘর ভেঙ্গেছিলেন যে তাঁকে সুড়ঙ্গের মধ্যে ধাওয়া করে নৃশংসভাবে হত্যা করতে হলো? সাদ্দাম হোসেন কোন মার্কিন নেতার বা মার্কিন মুল্লুকের ক্ষতি করেছিলেন যে তাদের অঙ্গুলি হেলনে সাদ্দামকে ফাঁসির দড়িতে লটকাতে হলো? কোন অপরাধে পশ্চিমারা, বিশেষ করে মার্কিনিরা ইরাক এবং লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ দুটি দেশের ১২ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো? আর স্বচ্ছল দুটি দেশকে বিরান করা হলো? আফগানিস্তান তো মার্কিনিদের মৌরসী পাট্টা নয় যে ২০ বছর ধরে মার্কিনিরা দেশটিকে ছিঁড়ে কুড়ে খেল? কোন অধিকারে তারা আফগানদের ৭ বিলিয়ন ডলার আটকে রাখলো? গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে ডাহা মিথ্যা কথা বলে তারা ইরাকে সামরিক অভিযান চালালো। কিন্তু জাতিসংঘ সেখানে এক বিন্দু গণবিধ্বংসী অস্ত্রও পেল না। মিথ্যা কথা বলে পররাজ্য গ্রাস এবং লক্ষ লক্ষ বেসামরিক মানুষকে হত্যার দায়ে মার্কিনিদের যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় কে দাঁড় করাবে?
আজ ইইউ তাদের ঘরের বাসিন্দা ইউক্রেনের সাহায্যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসছে না কেন? কারণ, সেখানে রাশিয়া আছে বলে? যত নীতি কথাই ওরা আওড়াক না কেন, ওরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। যেখানে রাশিয়া আছে, সেখানে আমেরিকা যায় না। আর যেখানে আমেরিকা আছে সেখানে রাশিয়া যায় না। ঐ যে কথায় বলে, কারা কারা যেন মাসতুতো ভাই? রাশিয়ার এই নির্লজ্জ বিভৎস হামলার মুখে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের ভূমিকা হলো, পানিতে নামবো, কিন্তু চুল ভেজাবো না।
॥চার॥
এই যুদ্ধ কোথায় গিয়ে থামবে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কারণ, লেখাটি শেষ করছি রবিবার রাতে। সোমবার আরো কিছু ঘটনা ঘটবে। তবে পুতিন কোথায় গিয়ে থামবেন সেটা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। একদিকে পুতিন এবং জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠকের কথা হচ্ছে, অন্যদিকে পুতিন তাঁর পারমাণবিক বোমা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ঐ দিকে ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সাথে সাথে তাঁর সেনাবাহিনীও জনগণকে অস্ত্র হাতে রুশদেরকে মোকাবিলার নির্দেশ দিচ্ছেন। ইউক্রেন হেরে যাবে। কিন্তু তারপরেও সেই ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’, অবস্থা হবে কি? অবশেষে ইউক্রেন কি গেরিলা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে? সেটি নির্ভর করছে আমেরিকা এবং ইইউ এর অ্যাটিচুডের ওপর।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।