পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক দুর্ঘটনায় কিছুতেই লাগাম পরানো যাচ্ছে না। দেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়াও দুষ্কর। দুর্ঘটনাকবলিতরা অনেক সময় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করেন না। অনেক সময় অভিযোগ করলেও সেটি চলে যায় গোপনীয়তার স্তরে। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র প্রকাশ্যে আসছে তা আতঙ্কজনক।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২১ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যার সংখ্যা ২ হাজার ৭৮। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ, এতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের। যা মোট দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫২৩ জন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। যা মোট মৃত্যুর ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ না করাসহ নানা কারণে পথচারীরা সড়কে মারা যাচ্ছেন। রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা ও সড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে তোলা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলো করোনাকালেও ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময়ে প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর গড়ে ৮ হাজার পরিবার অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। হতাহতদের সিংহভাগই পরিবারের একমাত্র আয়ক্ষম ব্যক্তি। এ ট্র্যাজেডির অবসানে যানবাহন চালক, যাত্রী, পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বাবার শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেরিয়েছিলেন সাত ভাই এক বোন। ১০ দিন আগে তাঁদের বাবা মারা যান। হঠাৎ সবজিবোঝাই দ্রুতগামী একটি পিকআপ তাঁদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান চার ভাই। আহত হন তিন ভাই ও এক বোন।
বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আরো এক ভাই। আরো কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থেকে মারান অপর এক ভাই। মৃণালিনী শীল ১০ দিন আগে বিধবা হয়েছিলেন। এরপর বিধবা হলেন তাঁর ছয় পুত্রবধূ। এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা এক ভাই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তারা মহাসড়ক থেকে অন্তত দুই ফুট দূরে নিচু এলাকায় এক কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ সড়ক পারাপারও করেননি। কিন্তু ঘাতক চালক তাদের ওপর দিয়ে গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান।
দেশের সড়ক-মহাসড়কে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ডও বলা যায়। বেপরোয়া গতি, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ বহু অনিয়ম ঘটে রাস্তায়। যেসব কারণে রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল লেগেই আছে। যেমন ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পুলিশের সংকেত না মেনে পালানোর চেষ্টায় ছিলেন ধানবোঝাই এক চাঁদের গাড়ির চালক। রাস্তা পার হওয়ার সময় সেই গাড়ির চাপায় মৃত্যু হয়েছে দুই স্কুলছাত্রীর। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুকে হত্যা বলেই মনে করেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে দেশজুড়ে। আমাদের দেশে চালকদের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তাঁদের অনেকেই আধুনিক সড়ক নির্দেশনা বুঝতে অক্ষম। ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। গাড়িচালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্তত এসএসসি নির্ধারণ করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন ও নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। আদালতের সেই নির্দেশনা কি মানা হচ্ছে? মালিকরাও সাধারণত চালকের দক্ষতা, কল্যাণ ও শৃঙ্খলার প্রতি উদাসীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে মৃত্যু কমছে না।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয় হাজার ২৮৪ জন। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দুর্ঘটনা ঘটে তার সবই ঘটে অবহেলার জন্য। আর এই অবহেলা হচ্ছে মূলত পরিচালনা বা প্রায়োগিক স্তরে। একটা কিছু উন্নয়নের পর এর পরিচালনার দিকে নিবিড় নজর দিতে হয়। সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে কারা যানবাহন চালাবে, মাঠ পর্যায়ে যানবাহন ও রুট নজরদারি কারা করবে, তাদের কে নিয়ন্ত্রণ করবে, ওপরের দিকে কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব কতটুকু থাকবেÑ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করা দরকার। আমাদের সড়কে যেমন নছিমন-করিমন বা ভটভটিসহ আরো অনেক রেজিস্ট্রিবিহীন যান আছে, তেমনি আছে যান চলাচলে স্বেচ্ছাচারিতা। এর বিপরীতে আমাদের কর্মকর্তাদের কি কোনো জবাবদিহি আছে?
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের সচেষ্ট হওয়া জরুরি। গাড়ির ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো আপোশ করা যাবে না। নজরদারি জোরদার করতে হবে। অনিয়মকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
দুর্ঘটনায় কী পরিমাণ যানবাহন বা সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর ক্ষতি হওয়া মানবসম্পদের আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেশের জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ হতে পারে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।